বীর নিবাস পাবেন ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা
# ৮ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণে ব্যয় হবে ৪৮ লাখ টাকা
# পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্টে যাচ্ছে আড়াই কোটি টাকা
# অফিস ও বাড়ি ভাড়ায় ব্যয় হবে ১ কোটি ৭২ লাখ
# বীর নিবাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়বে
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সারাদেশে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’ দিতে মনস্থির করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ‘অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পে আট কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ৪৮ লাখ টাকা (জনপ্রতি ৬ লাখ টাকা) ব্যয় হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ‘অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি আগামী ১৬ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রত্যেক উপজেলার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা ‘বীর নিবাসের’ মাধ্যমে আবাসনের নিশ্চয়তা পাবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১২২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। একনেক সভায় অনুমোদনের পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৩ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের ৮টি বিভাগের ৬৪টি জেলার সব উপজেলা ও মহানগরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ৬৩৫ বর্গফুটের একটি বীর নিবাস করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকটি নিবাসে দুইটি শয়নকক্ষ, ডাইনিং, ড্রইং, রান্নাঘর ও দুইটি বাথরুম থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে এখনও অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির স্বাদ লাভ করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকারের বহুমাত্রিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি নিয়ে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়েছে। সেখানে উপস্থাপিত ডিপিপিতে ১৪ হাজার বীর নিবাসের সংস্থান এবং মোট ব্যয় ছিল ২ হাজার ৮১৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ হিসাবে মূল ডিপিপিতে প্রতিটি বীর নিবাস নির্মাণের সংস্থান ছিল ২০ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৫ টাকা। কিন্তু পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৩০ হাজারটি বীর নিবাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি বীর নিবাস নির্মাণের ব্যয় কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৮ টাকা। পুনর্গঠিত ডিপিপিতে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ হাজার ১২২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের বছরভিত্তিক ব্যয় বিভাজনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) এ প্রকল্পের অনুকূলে ৮৪১ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এরইমধ্যে অর্থবছরের নয় মাস পার হতে চলেছে। প্রকল্পে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৪ কোটি টাকা ৫৯ লাখ ৫২ হাজার টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ২৩৬ কোটি ৯২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (পরিকল্পনা) যুগ্মসচিব ড. মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, এ প্রকল্প বিষয়ে আমি কোনো মতামত দিতে পারব না, সচিব স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি অথরাইজড না।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মো. মামুন-আল-রশীদ একনেক কার্যপত্রে উল্লেখ করেছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা বা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী ও সন্তানদের স্থায়ী আবাসন নিশ্চিত হবে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৩০ হাজারটি বীর নিবাস উপহার হিসেবে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
কোন খাতে কত ব্যয়
অফিসারদের ১০৮ জনের বেতন বাবদ মাসে মোট ৭৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, কর্মচারীদের ৩৬ জন মাসে ৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা, ১৪৪ জনের শিক্ষা ভাতা মাসে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, ১৪৪ জনের বাড়ি ভাড়া মাসে ৪১ লাখ ২৯ হাজার টাকা, ১৪৪ জনের চিকিৎসা ভাতা মাসে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা, ১০৮ জনের মোবাইল ও সেলফোন ভাতা মাসে ২ লাখ টাকা, ১৪৪ জনের উৎসব ভাতা মাসে ১৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, নববর্ষ ভাতা ১ লাখ টাকা, অন্যান্য ভাতা (গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, টেলিফোন নগদায়ন ভাতা, প্রকল্প ভাতা ইত্যাদি) ৯২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ভাতা ১ লাখ টাকা, আপ্যায়ন ভাতা (উপজেলা ও মহানগর সংশ্লিষ্ট জেলাসহ) ৮২ লাখ ২৯ হাজার টাকা, অডিট সোর্সিং সেবা অনুযায়ী সাকুল্য বেতন (সরকারি কর্মচারী ব্যতীত) ৮ কোটি ৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও কনফারেন্স ব্যয় ২৪ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ ৮ লাখ টাকা, পানি ২ লাখ টাকা, কুরিয়ার ৫১ হাজার টাকা, ইন্টারনেট/ফ্যাক্স/টেলেক্স/ডিসে ১ লাখ টাকা, ডাকে ১ লাখ টাকা, টেলিফোনে ২ লাখ টাকা, প্রচার ও বিজ্ঞাপন ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং অফিস ভবন ভাড়া (ঢাকা ও বিভাগীয় সদর) বাবদ ১ কোটি ৩১ লাখ ৪০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া, যানবাহন ব্যবহারে (চুক্তিভিত্তিক গাড়ি ভাড়া) ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ব্যাংক চার্জ ৫ লাখ টাকা, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ (এক্সপোজার ভিজিট ৮ জন করে ২ ব্যাচ) ৪৮ লাখ টাকা, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয় (প্রকল্প পরিচালকের সদর দফতর ও আউটসোর্সিং স্টাফ) ১ কোটি ৩৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, পেট্রোল, অয়েল অ্যান্ড লুব্রিকেন্ট (উপজেলা-৪৯৪, জেলা-১০) খাতে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, কম্পিউটার সামগ্রী ৭৫ লাখ টাকা, মুদ্রণ ও বাঁধাই ৩৬ লাখ টাকা, স্ট্যাম্প ও সিল ৫০ হাজার টাকা, অন্যান্য মনিহারি ২৫ লাখ টাকা, জরিপ ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন বাবদ ২৮ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে।
ডিপিপিতে, সম্মানী/পারিতোষিক খাতে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, আসবাবপত্র, কম্পিউটার, অফিস সরঞ্জাম, অফিস ভবন মেরামত/ডেকোরেশন খাতে ৪৬ লাখ টাকা, আবাসিক ভবন ৩০ হাজারটি ৪ হাজার ৩০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং আনুষঙ্গিক (অল ইন অল) ৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, কম্পিউটার এবং আনুষঙ্গিক (প্রিন্টার) বাবদ ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
এসআর/আরএইচ/জেডএস/এমএমজে