প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আবারও অনুরোধ করছি কোনো খাদ্যের অপচয় নয়, যার যেখানে যতটুকু জমি আছে তা চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বাড়ান। সারা বিশ্বে যে দুর্যোগের আভাস আমরা পাচ্ছি, তা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করুন। আমি বিশ্বাস করি, সবার প্রচেষ্টায় এটা করা সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ (সোমবার) সকালে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২’ উপলক্ষ্যে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হন তিনি। কৃষি মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা বলেন, পুষ্টিকর খাদ্য, সুষম খাদ্য, নিরাপদ খাদ্য- এটাই আমরা নিশ্চিত করতে চাই। যা কেবল আমাদের দেশের মানুষ নয়, সারাবিশ্বের মানুষেরই একান্তভাবে প্রয়োজন।
খাদ্যের চাহিদা কোনোদিন কমে না, বরং বাড়ে- সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই আমি যত উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারি আর যত বেশি খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারি ততই আমাদের মঙ্গল হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এটা আমাদের অর্থনীতিতেও বিরাট অবদান রাখতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে সরকার-প্রধান বলেন, সেই সঙ্গে আমি বলব, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা, খাদ্যের অপচয় বন্ধ করা এবং উদ্বৃত্ত খাদ্য সংরক্ষণ এবং পুর্নব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া সারা দেশে গড়ে তোলা ১শ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে যাতে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও গড়ে ওঠে সেই বিষয়টাতেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নিজের খাবার নিজেরা উৎপাদন করার চেষ্টা করবেন, যাতে পরিবেশের ওপর চাপ কমে, বাজারের ওপর চাপ কমে। সবাই মিলে আমরা কাজ করলে অবশ্যই আমাদের বাংলাদেশের ওপর কোনো রকম আঘাত আসবে না, এটা আমার দৃঢ বিশ্বাস।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী।
স্বাগত বক্তব্য দেন কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে বিশ্ব খাদ্য দিবস এবং কৃষি খাতের উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
• আরও পড়ুন : বাঙালি জাতিকে কেউ আর দাবায়ে রাখতে পারবে না
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি অর্জনে ৬টি থিম্যাটিক এরিয়াতে কাজ করে যাচ্ছি। প্রথমত কৃষি গবেষণা এবং উন্নয়ন, দ্বিতীয়ত কৃষি উপকরণ সরবরাহ, তৃতীয়ত কৃষি সম্প্রসারণ, চতুর্থত সেচ কাজে পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার, পঞ্চমত জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব মোকাবিলা এবং ষষ্ঠত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন।
এই বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রেখেই তার সরকার প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কতৃর্পক্ষ প্রতিষ্ঠাসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান তৈরি করেছে এবং ২০১৮ সাল থেকে নিরাপদ খাদ্য দিবস পালন শুরু করেছে। পাশাপশি ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে ‘অন দ্যা স্পট স্ক্রিনিং,’ ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে এবং যারা খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে মানুষ নিরাপদ খাদ্য পেতে পারে। আর এই নিরাপদ খাদ্যটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিরাপদ খাদ্য কতৃর্পক্ষের প্রধান কার্যালয় স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় ল্যাবরেটরি স্থাপনে পূর্বাঞ্চলে ৫ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। আটটি বিভাগে আটটি রেফারেন্স ল্যাবরেটরি স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং নিরাপদ খাদ্য কতৃর্পক্ষের হটলাইন চালু করা হয়েছে। ‘কৃষি সম্প্রসারণ নীতি- ২০২০’ আমরা প্রণয়ন করেছি এবং এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাতে নিরাপদ খাদ্যটা আমরা মানুষকে দিতে পারি, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এগুলো করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের যারা কৃষিবিদ তাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাদের বিরাট অবদান রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের কৃষকদেরও আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, যেহেতু আজকে তারা আমাদের এই খাদ্যের যোগানটা দিচ্ছে। কাজেই তাদের সম্মান ও সহযোগিতা করাটা একান্তভাবে অপরিহার্য।
প্রবাসে কর্মরতদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদের যারা আজকে বিদেশে চাকরি বা কাজ করেন বা উপার্জন করেন, তারা নিজের দেশ, গ্রাম ও মাটিকে ভুলে যাবেন না। নিজের যদি কোনো পতিত জমি থাকে সেটাকেও চাষের আওতায় নিয়ে আসুন। তাহলে দেখবেন আমাদের দেশ কখনো পিছিয়ে থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সব ধরনের ভর্তুকি দিয়েই কৃষি ব্যবস্থাকে সচল রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কেননা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিবহন এবং খাদ্য প্রাপ্তির যে সমস্যা বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে, এই সমস্যা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখতে হবে। কারণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোই আজকে বলছে বিশ্বে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। কাজেই আমাদের বাংলাদেশে যেন কোনোরকম খাদ্যাভাব দেখা না দেয়, তার জন্য এখন থেকেই সকলকে সচেতন হতে হবে। যার যতটুকু সামর্থ আছে, জমি আছে, সবাই সেখানে কিছু না কিছু উৎপাদন করেন। যে যেভাবে পারেন নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে সকলেই একটু মনযোগী হন, সাশ্রয়ী হন।
পতিত জমি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আসবে না, বরং বিশ্ব খাদ্যসংকটে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশকে খাদ্য সহায়তা করতে পারবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এজন্য তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, কোনো দুর্যোগে আমাদের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হলেও আমরা যেন জমানো খাদ্যটা ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারি, সেদিকে আমাদের সকলকে নজর দিতে হবে।
• আরও পড়ুন : দুর্যোগ আঘাত হানার আগেই পদক্ষেপ নিলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব
যে সমস্ত পণ্য এখনও আমাদের আমদানি করতে হয়, যেমন- ভোজ্য তেল অথবা ভুট্টা, গম ইত্যাদি উৎপাদনেও তিনি মনযোগী হওয়ার মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্বারোপ করে বলেন, ইতোমধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনের মাধ্যমে সে সংকটকে আমরা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি আশা ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের যে মাটি ও মানুষের শক্তি রয়েছে তা নিয়ে আমাদের কৃষকদের একটু সহায়তা দিলেই আমরা ভোজ্যতেল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব। আর তার সরকার মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষির ওপর গুরুত্বারোপ করে দেওয়া এক ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন,
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।’
তিনি বলেন, আমিও এটা বিশ্বাস করি যে, আমাদের মাটি ও মানুষ, আমাদের প্রকৃতির সাথে মিল রেখেই আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আমাদের দেশকে আরও উন্নত করব, এটাই আমাদের লক্ষ্য।
বাসস।
এনএফ