সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে গঠিত হয় নতুন ‘জঙ্গি মঞ্চ’
নব্য জেএমবির মতো জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ সমমনারা ফিরছে নতুন প্লাটফর্মে। নব্য জেএমবিসহ অধিকাংশ জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ হওয়ায় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন প্লাটফর্ম যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালে। এর নামকরণ হয় ২০১৯ সালে। ২০১৭ সাল থেকেই তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে এই নতুন মঞ্চে ভেড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়। তাদের পরিকল্পনা ও কতজন তরুণ উদ্বুদ্ধ হয়ে এ প্লাটফর্মে ভিড়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা না গেলেও ঘরছাড়া তরুণদের ভোলার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি দেশের কুমিল্লা ও অন্য অঞ্চল থেকে বাড়ি ছেড়ে কথিত হিজরত করে ঘড় ছেড়েছে অর্ধশতাধিক যুবক। যাদের মোটিভেশন, প্রশিক্ষণসহ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেএমবি, নব্য জেএমবি, হিজবুত তাহরীরসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন থেকে আসা নেতৃস্থানীয়রা।
কুমিল্লা ও অন্য অঞ্চল থেকে বাড়ি ছেড়ে কথিত হিজরত করে ঘড়ছাড়া চার জনসহ সাত জনকে মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় নিখোঁজ সংক্রান্তে গত ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতয়ালী থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। র্যাব নিখোঁজের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের উদ্ধারে ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরছাড়া চার তরুণকে হেফাজতে নিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর পরিবারের কাছে ফিরিয়েও দেয় র্যাব।
আরও পড়ুন: এটি ভুল পথ, এ পথে যেন কেউ পা না বাড়ায়
গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১ এর অভিযানে মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে হোসাইন আহম্মদ (৩৩), নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের (৩৪), বণি আমিন (২৭) ও চার নিরুদ্দেশ তরুণ ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), হাসিবুল ইসলাম (২০), রোমান শিকদার (২৪), সাবিতকে (১৯) গ্রেপ্তার করে র্যাব। এসময় নব্য জঙ্গি সংগঠনের প্রচারপত্র, বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশিকা, নব্য জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, উগ্রবাদী বই, জিহাদী ভিডিও সম্বলিত একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়।
কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ আট তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামের তরুণ গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। র্যাব ফিরে আসা নিলয়কে তার পরিবারের হেফাজতে রেখে নিখোঁজ বাকি সাত সদস্য ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করে। গত ২৩ আগস্ট সকাল ১০টায় নিলয়সহ নিখোঁজ পাঁচ তরুণ নিজ বাড়ি ছেড়েছিল।
কুমিল্লা টাউন হল এলাকা থেকে সোহেলের নির্দেশনায় তারা দুই ভাগ হয়ে লাকসাম রেল ক্রসিংয়ের কাছে হাউজিং স্টেট এলাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। সেখান থেকে তাদের অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি লাকসামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে নিলয়, নিহাল, সামি ও শিথিলকে কুমিল্লা শহরের একটি মাদ্রাসার মালিক নিয়ামত উল্লাহ’র কাছে পৌঁছে দেয় সোহেল।
তার তত্ত্বাবধানে একদিন থাকার পর সোহেল চার জনকে নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং নিহাল, সামি ও শিথিলকে অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিলয়কে পটুয়াখালীর একটি লঞ্চের টিকিট কেটে পটুয়াখালীতে পাঠায়। পটুয়াখালীতে গ্রেপ্তার বনি আমিন নিলয়কে গ্রহণ করে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় নিয়ে যায় এবং গ্রেপ্তার হুসাইন ও নেছার ওরফে উমায়েরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বণি আমিন নিলয়কে তিন দিন তার বাসায় রাখে। তার বাসায় অতিথি আসায় পরে নিলয়কে হুসাইনের মাদ্রাসায় রেখে আসে। নিলয় মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর কল্যাণপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে।
নিলয়ের দেওয়া তথ্যমতে বনি আমিন, নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়েরকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক থেকে, হুসাইন আহমদ, রিফাত, হাসিব, রোমান শিকদার ও সাবিতকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার হাসিব ও রিফাত এক বছর আগে কুমিল্লার কোবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে সংগঠনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা পায়। হাবিবুল্লাহ তাদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে ফাহিম ওরফে হাঞ্জালার কাছে নিয়ে যায়। ফাহিম তাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়। এভাবে তাদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে।
গ্রেপ্তার রোমান স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ৪০ দিন আগে নিরুদ্দেশ হয় এবং গ্রেপ্তার সাবিত দুই মাস আগে পটুয়াখালী থেকে নিখোঁজ হয়।
জানা যায়, সোহেল নামক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের বিভিন্ন সেফ হাউজে রেখে পটুয়াখালী এলাকার সিরাজ ওরফে রবি নামক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় সশস্ত্র হামলা, বোমা তৈরি, শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তার হোসাইন আহম্মদ পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। নিষিদ্ধ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কিছু সদস্যদের একীভূত করে ২০১৭ সালে এই নব্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) হিসেবে সংগঠনটির নামকরণ করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজি’র বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা ও কর্মীরা একত্রিত হয়ে এই উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেপ্তার হোসাইন সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধান, তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ২০১৪-১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে সিরাজ নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। এখন পর্যন্ত ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
গ্রেপ্তার নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের ভোলায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের আগে উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হন। তিনি হিজরত সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ৯-১০ জন সদস্যের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
গ্রেপ্তার বণি আমিন উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে পটুয়াখালী এলাকায় কম্পিউটার সেলস অ্যান্ড সার্ভিসের ব্যবসা করে। সে সদস্যদের আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিল। সে ২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। সে ২২-২৫ জন সদস্যকে আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে জড়িত ছিল।
গ্রেপ্তার রিফাত কুমিল্লাতে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিল। গ্রেপ্তার হাসিব উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এবং একটি অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা হাবিবুল্লাহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হতে গত ২৩ আগস্ট বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়।
গ্রেপ্তার রোমান পূর প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করে গোপালগঞ্জে ইলেকট্রিক্যাল ও স্যানিটারি বিষয়ক কাজ করত। সে অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনটি সম্পর্কে ধারণা পায়। পরে সে প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়।
গ্রেপ্তার সাবিত উত্তরা এলাকায় প্রায় এক মাস আগে একটি ছাপাখানায় স্টোর কিপারের কাজ করত। সে তার একজন আত্মীয় ও অনলাইনে ভিডিও দেখার মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়। সে জুন মাসে ঢাকায় সিরাজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রায় দুই মাস আগে নিখোঁজ হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে নিখোঁজ তরুণদের সম্পর্কে পরিবারকে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, তারা কাটআউট পদ্ধতিতে কাজ করছিল। অনেক সদস্য এখনো ধরা পড়েনি। হয়ত কেউ কেউ পরিবারে ফিরেও যেতে পারে। আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। আর জঙ্গি হামলা হবে না— এমনটা আমরা কখনো বলিনি। আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান আছে। হিন্দুদের বড় উৎসব গেল। তেমন কিছু ঘটেনি। এই নতুন মঞ্চের দক্ষিণাঞ্চলের নেতাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। এখন পর্যন্ত কতজন সদস্য সক্রিয় সে সম্পর্কে শক্ত কোনো তথ্য আমরা এখনো পাইনি।
তিনি বলেন, স্টেপ টু স্টেপ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একটি স্তর পার হওয়ার পর পরের স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘড়ছাড়া তরুণদের মূলত সুপ্ত চিন্তাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে জঙ্গিবাদে। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে চরাঞ্চলে। তাদের আরও নতুন নতুন প্রশিক্ষণের পরই উপরের ধাপে উত্তীর্ণ করার প্রক্রিয়া চলছিল।
কাদের উপর হামলা চালানোর জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ বা মোটিভেট করা হচ্ছে— জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণদের মোটিভেট করা হচ্ছিল। হিজরত করা তরুণদের আইসোলেশনে রেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধের জন্য ক্রোধ-ক্ষোভকে কাজে লাগানোই ছিল প্রথম কৌশল। আমরা নতুন এই সংগঠনের মধ্যম সারির বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছি। তারা বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন থেকে এখানে এসে নেতৃত্বে গেছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে। এই সংগঠন নিষিদ্ধ নয়, অন্য সংগঠনের চেয়ে এটা শক্তিশালী। তারাই মূলত মানিয়ে চলার জন্য পেশাদারি ও কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের মতপার্থক্য রয়েছে। নতুন এই মঞ্চ পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার কেন বলছেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সংগঠনে যদি যুক্ত হয় তরুণরা তাহলে উদ্দেশ সফল হবে। বনি আমিন, হোসাইন ও নেছাররা আনসার আল ইসলামে উদ্বুদ্ধ ছিল। কিন্তু আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হওয়ায় জঙ্গিবাদের প্রচার-প্রচারণার জন্য নতুন মঞ্চে যোগ দিয়ে নেতৃত্বে যায়। তাদের কার্যক্রমের বড় অংশ চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় চলছে বলে জানান তিনি।
জেইউ/এসএসএইচ