বেড়েছে খরচ, বুঝে-শুনে চামড়া কেনার পরামর্শ
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কোরবানির পশুর চামড়া ‘বুঝে-শুনে’ কেনার পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। তারা বলছেন, এ বছর লবণের দাম বেড়েছে অনেক। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন ও শ্রমিকসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়। সেই অনুযায়ী চামড়ার দাম বাড়ছে না।
রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক মোখলেছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তবে দাম সেভাবে বাড়েনি। এটি মাথায় রেখে চামড়া কেনার পরামর্শ দেন তিনি।
দাম না বাড়ার কারণে আগেভাগে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দিয়েছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। তারা বলছেন, বেশি দামে চামড়া কিনলে গত বছরের ন্যায় এ বছরও লোকসানের মুখে পড়তে হবে। এছাড়া চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের অন্যতম উপাদান লবণ। এর দামও বাড়তি। এদিকে, গরমও পড়েছে বেশ। অতিষ্ঠ জনজীবন। এ গরমে দ্রুত কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ করতে না পারলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে আলাদা করার পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছেন আড়তদাররা।
রমজানের সময় এক বস্তা (৭৪ কেজি) লবণের দাম ছিল ৬৫০ থেকে ৬৬০ টাকা। কোরবানি আসার আগেই সিন্ডিকেট করে তা বাড়িয়ে ৯৪০ থেকে এক হাজার টাকায় নেওয়া হয়েছে। এখনও অস্থির লবণের বাজার। এই আছে তো এই নাই। কোনো কারণে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এর দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এটি হলে কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াকরণ বাধাগ্রস্ত হবে
রমজানের সময় এক বস্তা (৭৪ কেজি) লবণের দাম ছিল ৬৫০ থেকে ৬৬০ টাকা। কোরবানি আসার আগেই সিন্ডিকেট করে তা বাড়িয়ে ৯৪০ থেকে এক হাজার টাকায় নেওয়া হয়েছে। এখনও অস্থির লবণের বাজার। এই আছে তো এই নাই। কোনো কারণে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এর দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এটি হলে কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াকরণ বাধাগ্রস্ত হবে। এছাড়া শ্রমিক ও পরিবহন ব্যয়ও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এসব কারণে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করাই ভালো।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে সমিতির ১১২ জন সদস্য চামড়া কিনতেন। এখন কেনেন মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ জন। লোকসান হওয়ায় অনেকেই অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন। এছাড়া ঢাকার ট্যানারি ব্যবসায়ীদের কাছে অনেকে টাকা পান। তারা ঠিক মতো টাকা দেন না। আমারও পাওনা আছে। সেই ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, কয়েক লাখ টাকা পড়ে আছে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে।
শুধু কাঁচা নয়, লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণের পর ওই দামই আপনি পাবেন। তাই যারা চামড়া কিনবেন, বিষয়টি মাথায় রাখবেন। এছাড়া এখন প্রচণ্ড গরম পড়ছে। তাই চামড়া সংগ্রহের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিতে হবে। তা না হলে চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এগুলো ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। তাহলে পরেও বিক্রি করা যাবে।’
এসব নিয়ম মেনে চললে ২০১৯ ও ২০২০ সালের মতো চামড়া নষ্ট হবে না। আর্থিক ক্ষতির মুখেও পড়তে হবে না’— বলেন মুসলিম উদ্দিন।
সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে কাঁচা চামড়ার এ আড়তদার বলেন, সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আমরা চার লাখ চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিয়েছি। লবণ, লোকবল, গুদাম— সব ঠিক করা হয়েছে।
লবণ নিয়ে কারসাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বছর লবণের দাম অনেক বেড়েছে। গত বছর কোরবানির সময় এক বস্তা (৭৪ কেজি) লবণের দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৫৬০ টাকা। চলতি বছরের রমজানে তা বেড়ে হয় ৬০০ টাকা। সেই লবণ এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকায়। বিসিক বলছে পর্যাপ্ত লবণ আছে। এরপরও কারসাজি করে লবণের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে ফের কারসাজি হবে না— তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন এ ব্যবসায়ী।
‘এক বস্তা লবণ সাত থেকে আটটি চামড়ায় দেওয়া যায়। অর্থাৎ প্রতি পিস চামড়ায় লবণবাবদ খরচ পড়বে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। এছাড়া শ্রমিকের মজুরি, পরিবহন ব্যয় তো আছে। এগুলোও আগের চেয়ে বেড়েছে। সবমিলিয়ে এক পিস কাঁচা চামড়ার পেছনে ব্যয় হবে ২০০ টাকার মতো। সঙ্গে চামড়ার মূল্য তো আছেই।’
সবকিছু বিবেচনা করে মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া ও চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ, বুঝে-শুনে চামড়া কিনবেন। গত বছর থেকে চামড়ার দাম কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। কেনা চামড়া কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। দ্রুত বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। কম দামে কিনে অল্প লাভে ছেড়ে দিতে হবে। বেশি লাভের আশা করা যাবে না। চামড়া যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য দ্রুত লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে— বলেন চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি।
চামড়ার ন্যায্য মূল প্রাপ্তির বিষয়ে মুসলিম উদ্দিনের দাবি, প্রতি বছরই সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। লবণযুক্ত চামড়া যেন আমরা সেই দামে বিক্রি করতে পারি, ট্যানারিগুলো যেন সরকার নির্ধারিত দাম দেয়— এ বিষয়ে সরকারের মনিটরিং থাকতে হবে। কারণ, ট্যানারিগুলো সরকারনির্ধারিত দাম দিতে রাজি হয় না। নানা কারসাজি করে তারা চামড়ার মূল্য কমিয়ে দেয়।
চট্টগ্রামের চামড়া আড়তদার সমিতি জানায়, চলতি বছর প্রায় চার লাখ পশু কোরবানি দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ। এর মধ্যে তিন লাখ গরুর চামড়া। ছাগলসহ অন্যান্য পশুর চামড়া ধরা হয়েছে এক লাখ।
এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে লবণ দেওয়া প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত বছর (২০২১ সাল) ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি মো. আব্দুল কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের চামড়া কেনার সব প্রস্তুতি শেষ। তবে, টাকার সংকট রয়েছে। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে অনেক টাকা পাওনা আছে। তারা টাকা দিচ্ছে না। সরকার ও ট্যানারি মালিকদের থেকেও তেমন সহযোগিতা পাচ্ছি না। ব্যাংকঋণও মিলছে না। তারপরও লাখ পাঁচেক টাকার চামড়া সংগ্রহের ইচ্ছা আছে।
দীর্ঘ সময় চামড়া কীভাবে সংরক্ষণ করা যাবে— এ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত গ্রাম ও উপজেলা থেকে অনেকে চামড়া সংগ্রহ করেন। চামড়া সংগ্রহের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর সেগুলো ঠাণ্ডা স্থানে রেখে ঈদের দু-তিনদিন পর আড়তে নিয়ে আসতে হবে। সময় মতো লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করলে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আমরাও ধীরেসুস্থে চামড়া কিনতে পারব।
চট্টগ্রামের রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা আছে। গত বছর থেকে চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তবে, চামড়ার মূল্য সেভাবে বাড়েনি।
‘চলতি বছর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে লবণ। কারণ, লবণের দাম অনেক বাড়তি। কোরবানির আগে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এর দাম আরও বাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের জোর নজরদারি প্রয়োজন’— দাবি করেন তিনি।
কেএম/এমএআর/