হাসপাতালে ঢুকেই দেখি সালাউদ্দিনের ডেডবডি, সামনেই মারা গেল রবিউল
২০১৬ সালের ১ জুলাই, গুলশান-২ এর লেকপাড়ের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলা। নারকীয় ওই হত্যাযজ্ঞে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন। সেদিন রাত ৮টা ৫০মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস এক জঙ্গি হামলার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছিল গোটা জাতি।
২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার, নিহত হয় হামলাকারী জঙ্গিরা। অভিযানটি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হলেও সেদিন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পুলিশ সদস্যরা।
গুলশান-বনানী থানা ও গুলশান বিভাগের সব ফোর্স যুক্ত হয়েছিল গুলশানে, ছিল সোয়াত, ডগ স্কোয়াডের মতো বিশেষায়িত বাহিনী। ঘটনার পর থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। ঢাকা পোস্টের কাছে তিনি সেদিনের স্মৃতি তুলে ধরেছেন।
শহীদুল হক বলেন, তখন রমজান মাস ছিল। আমি নিয়মিত রোজা রাখি এবং খতম তারাবিহ পড়ি। আমি সেদিন পুলিশ লাইনস মসজিদে তারাবিহ পড়ছিলাম। নামাজ পড়ে বের হয়ে আমি যখন গাড়িতে উঠি তখন ওয়্যারলেসে হামলার কথাবার্তা শুনছিলাম। পরে আমি কন্ট্রোল রুমে কল দিই। তারা আমাকে বিস্তারিত জানাল। সাথে সাথে আমি গুলশান থানায় যাই। গিয়ে দেখি ওখানে কেউ নেই। তখন ওয়্যারলেসে শোনা যাচ্ছিল, ‘কয়েকজন গুরুতর আহত। ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’ তখন আমি গাড়িতে সরাসরি ইউনাইটেড হাসপাতালে যাই।
হাসপাতালে ঢুকেই দেখি সালাউদ্দিনের ডেডবডি
হাসপাতালের অবস্থার কথা স্মরণ করে শহীদুল হক বলেন, হাসপাতালে ঢুকেই দেখি বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিনের (সালাউদ্দিন খান) ডেডবডি একটি স্ট্রেচারে রাখা। তার সামনে যেতেই একজন অফিসার বললো, ‘স্যার উনি মারা গেছেন’। পাশের রুমে রবিউল (ডিবির সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম) ছিল। দেখলাম তার অবস্থা মুমূর্ষু। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।
আমি ডাক্তারদের বললাম, যেভাবেই পারেন তাকে স্ট্যাবল করেন। আমরা অ্যাম্বুলেন্সে তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাব। ট্রাফিক পুলিশকে বললাম, বারিধারা থেকে সিএমএইচের রাস্তা ফাঁকা করো যাতে অ্যাম্বুলেন্স এক টানে নিয়ে যেতে পারে। তবে রবিউলকে আর স্ট্যাবল করা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে সে আমার সামনেই মারা গেল। আমি আইজিপি, আমার সামনে আমার পুলিশ পরিবারের সদস্য মারা গেল, আমি বাঁচাতে পারলাম না, খুবই কষ্ট লেগেছে। এরপর একের পর এক আহত পুলিশ সদস্য আসছিল, অতিরিক্ত কমিশনার মারুফ এলেন, গুলশানের এডিসি আহাদ, গুলশানের এসআই ফারুক এলেন। কী যে এক করুণ দৃশ্য ছিল, সেটা বলে বোঝানো যাবে না।
তাদের অবস্থা দেখে আমি ডাক্তারদের বললাম, যেসব ডাক্তার বাসায় আছেন, যাদের ডিউটি শেষ তাদের সবাইকে হাসপাতালে ডাকেন। সবার সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট দরকার।
হাসপাতাল থেকে আর্টিজানের দিকে রওনা
হাসপাতাল থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলশানের হলি আর্টিজানের উদ্দেশে রওনা হলাম। তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া আমাকে বললেন, স্যার ঘটনাস্থলে যাওয়ার দরকার নেই। পাশের একটি বাসায় আমরা সিনিয়ররা অবস্থান নিয়েছি। ওখানে ডিবি-র্যাবসহ সব সংস্থার লোকজন ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন। আপনি ওখানে আসেন, সিদ্ধান্ত দেন।
‘সেখানে গিয়ে আমি সবার সাথে কথা বললাম। একেক জন একেক কথা বলছিল। তাদের সাথে আলোচনার পাশাপাশি আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বারবার ফোন দিয়ে পরিস্থিতি বর্ণনা করছিলাম। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, তুমি আসো। আর্মি চিফও আসবেন। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো সেনাবাহিনী অপারেশন করবে। পুলিশ ও র্যাব তাদের সহযোগিতা করবে।’
জঙ্গিদের বিষয়ে কী জেনেছিলেন?
শহীদুল হক বলেন, জঙ্গিদের সাথে আমার কথা হয়নি। তবে, হলি আর্টিজানের আশপাশে যেসব পুলিশ সদস্য ডিউটিতে ছিল তারা জঙ্গিদের হাঁটাচলাসহ মুভমেন্ট দেখেছে। আমি তাদের কাছেই আপডেট জানতে চেয়েছি। তারা শুধু বলেছে, পাশের বাসা থেকে জঙ্গিদের অবস্থান এবং তাদের হাঁটাচলা দেখা যায়।
গুলশান হামলার আগেই গোয়েন্দা তথ্য ছিল— জানিয়ে সেসময়কার আইজিপি বলেন, ‘আমরা হামলার বিষয়ে বিভিন্ন আভাস পাচ্ছিলাম। গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পেরেছিলাম ঢাকায় জঙ্গিরা একটা ঘটনা ঘটাবে। তবে, ঢাকার কোথায়, কী ঘটাবে তা স্পেসিফিকভাবে আমরা পাচ্ছিলাম না। তথ্য শুনেই আমি ডিএমপি কমিশনারকে গোটা শহর সুইপিং করতে বললাম, কমিশনার তাই করেছে। চেকপোস্ট বাড়িয়েছে, অভিযান করেছে। জঙ্গিরা বসুন্ধরায় ছিল, তারা মেইন রাস্তা দিয়ে না এসে ছোট গলি দিয়ে ঢুকেছে। তাই তাদের খেয়াল করা যায়নি। তবে, এ ধরনের একটি হামলা তারা করবে বা করতে পারে, এ ধরনের উড়ু উড়ু সংবাদ আমরা পেয়েছিলাম।’
পুলিশ যখন শুনেছে ঘটনা ঘটেছে, টহল দল গিয়ে এলাকা ঘেরাও করে ফেলে। তাদের ঘেরাওয়ের কারণে জঙ্গিরা আর বের হতে পারেনি। তবে, ঘেরাও করা অবস্থায় তারা পুলিশকে ভেতর থেকে বোমা (গ্রেনেড) মেরেছে। বোমায় অনেক পুলিশ আহত হয়, দুজন মারা যান। পুলিশ যদি তাৎক্ষণিকভাবে ঘেরাও না করতো তাহলে তারা ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যেত।
গুলশান হামলার সময় মিডিয়ার ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেদিন টেলিভিশনগুলো অভিযানের লাইভ দেখিয়ে অপেশাদার কাজ করেছে। এ ধরনের ঘটনা টেলিভিশনে লাইভ না দেখানোই ভালো। কাজটা ঠিক হয়নি। ওই ঘটনার পরপরই আমি অভিযান পরিচালনার জন্য একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) করে দিয়েছি। এ ধরনের ঘটনা হলে পুলিশ কোথায় থাকবে, মিডিয়া কোথায় থাকবে, কার ভূমিকা কী হবে ইত্যাদি সেখানে দেওয়া আছে। এসওপি তৈরির পর থেকে আমরা আর এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হইনি।
দেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম ওই জঙ্গি হামলায় ২২ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের অধিকাংশই ছিলেন বিদেশি নাগরিক।
ওই হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন- হামলার মূল সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানারও আদেশ দেন আদালত। রায়ে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নামে এক আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
হামলার মূল অভিযুক্ত তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জের একটি বাড়িতে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন।
এআর/এনএফ