চাপ কমাবে রিং রোড, যানজট ঠেকাবে আইটিএস
স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। আগামী ২৫ জুন এই সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উন্মুক্ত হবে যোগাযোগের নতুন দ্বার।
তবে, সেতু চালু হলে পদ্মার উত্তর পাড়ে যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত সড়কে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যানবাহনের চাপ বাড়বে। ঢাকার ধোলাইপাড় থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে থাকলেও এতে উঠতে গেলে ঢাকার অসহনীয় যানজট অতিক্রম করে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, চার লেনের সড়কের কাজ শেষ না হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যানবাহনের চাপ পড়তে পারে দক্ষিণ পাড়ের শরীয়তপুর অংশেও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে গাড়িগুলো ঢাকায় প্রবেশ করবে। এমনিতেই ঢাকার প্রবেশমুখ যাত্রাবাড়ী ও বাবুবাজার এলাকায় যানজট লেগে থাকে। পদ্মা সেতু চালুর পর নতুন করে গাড়ির চাপ এসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি করবে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে যেসব গাড়ি সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান ও চানখারপুল এক্সিট পয়েন্টে নামবে; এসব এলাকায় নতুন করে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলবে।
তবে, এত সব দুশ্চিন্তার মাঝেও আছে স্বস্তির খবর। রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ এবং পদ্মার ওই পাড়ে (দক্ষিণ পাড়) চার লেনের সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে এই চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে— বলছেন সংশ্লিষ্টরা। বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে গাড়ি নিয়ে রাজধানীর একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে অনায়াসে বের হওয়া যাবে। আটকে থাকতে হবে না কোনো যানজটে। কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে গন্তব্যে। সেজন্য দ্রুত আউটার রিং রোড নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
একই সঙ্গে পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে দ্রুত শেষ করতে হবে চার লেনের সড়কের নির্মাণকাজ। এর বাইরে গাড়ির চাপ সামাল দিতে বসানো হবে ‘ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’ (আইটিএস)। এর মাধ্যমে সড়কের কোথাও যানজট হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবে হাইওয়ে পুলিশ বা ট্রাফিক বিভাগ।
গত বছর (২০২১ সাল) যানজট নিরসনে রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে তিনটি রিং রোড বা বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় সরকার। সেগুলো হলো- আউটার রিং রোড, মিডেল রিং রোড ও ইনার রিং রোড। এর মধ্যে স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ফর ঢাকার (আরএসটিপি) আওতায় রাজধানীর যানজট কমাতে পদ্মা সেতু থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বাইপাস হিসেবে রিং রোডের দক্ষিণ অংশের উন্নয়ন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। যদিও এর নির্মাণকাজ এখনও শুরু হয়নি।
আউটার রিং রোড
সাভারের হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে কালাকান্দি-তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু, মদনপুর, ভুলতা হয়ে গাজীপুরের কড্ডা থেকে ঢাকা-ইপিজেড বাইপাইল দিয়ে হেমায়েতপুর পর্যন্ত হবে এই সড়ক। মোট ১৩৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা আউটার রিং রোডের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার নতুন করে নির্মাণ করবে সরকার। বাকি ৮৫ কিলোমিটার বিদ্যমান সড়ককে উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, আট থেকে ১০ লেনবিশিষ্ট সড়কগুলো এমন হবে যে ঢাকার ওপর দিয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যেতে গাড়িগুলোকে দীর্ঘ সময় যানজটে আটকা থাকতে হবে না।
আট লেনবিশিষ্ট এই সড়কের প্রস্থ হবে ২৪০ থেকে ৩০০ ফুট। এই অংশে দুটি রেস্ট এরিয়া, পাঁচটি ইন্টারচেঞ্জ, ছয়টি ব্রিজ, ২০টি ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এছাড়া থাকবে নানামুখী সংযোগ সড়ক। এই সড়ক নির্মাণ হলে বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে এবং শহরে গাড়ির চাপ কমে আসবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই প্রকল্পও দুই পর্বে ভাগ করে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম পর্বে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কেরাণীগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত আট লেনের ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। বাকি ৩৬ কিলোমিটার অংশ জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এজন্য ৩৮৪ হেক্টর জমির প্রয়োজন হবে। আর দ্বিতীয় পর্বে ৮৪ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ করা হবে।
বর্তমানে প্রতিদিন আট হাজার থেকে ১২ হাজার যানবাহন ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সংখ্যা প্রতিদিন আনুমানিক ২৫ হাজারে উন্নীত হবে। ১০ বছরের মধ্যে তা ৪৫ হাজারে দাঁড়াবে
সম্প্রতি সরকারি এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিদিন আট হাজার থেকে ১২ হাজার যানবাহন ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সংখ্যা প্রতিদিন আনুমানিক ২৫ হাজারে উন্নীত হবে। ১০ বছরের মধ্যে তা ৪৫ হাজারে দাঁড়াবে।
এছাড়া ইনার রিং রোড চালু হলে দেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে আসা গাড়ি ঢাকা শহর এড়িয়ে যেতে পারবে। একই সুবিধা পাবে পদ্মা সেতুমুখী গাড়িগুলো। যানজট নিরসনে ২০০৪ সালের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ছিল এই প্রস্তাব। ২০১৪ সালে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাতেও (আরএসটিপি) রাজধানী ঢাকা ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, কিন্তু সবকিছু এখনও পরিকল্পনাতেই রয়ে গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে। মানুষের যাতায়াত সহজ হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে কেরানীগঞ্জ এলাকা দিয়ে আউটার রিং রোডের যে প্রস্তাবনা রয়েছে সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে সেতুর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাবেন না ঢাকাবাসী।
তিনি বলেন, ঢাকাকে ঘিরে যতগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছে যেমন- আরএসটিপি কিংবা ড্যাপ, সবগুলোতে রিং রোড নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। কারণ, এটি ছাড়া ঢাকার যানজট কমানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে, পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। ফলে এই যানজট তীব্র আকার ধারণ করবে। আউটার রিং রোড হলে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকামুখী মানুষ যার যার সুবিধা মতো রিং রোড ব্যবহার করে চলে যেতে পারবে। অন্যান্য এলাকার যাত্রীরাও একইভাবে রিং রোডের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। এতে ঢাকার যানজট অনেক কমে আসবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ যা বলছে
প্রকল্পের পরিচালক সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের স্টাডির কাজ শেষ। নতুন ৩৬ কিলোমিটার সড়কটি জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় (জিটুজি) নির্মাণ করা হবে। এটি তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর সঙ্গে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করবে। তবে, এর সুফল পেতে আমাদের আরও চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। এটি নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত এখন যে রুটগুলো আছে সেগুলো দিয়েই যাতায়াত করতে হবে। কিছু যাত্রাবাড়ী, কিছু শ্রীনগর দিয়ে যাবে। আর ইন্টারনাল রোডগুলো ব্যবহার করতে হবে।
শরীয়তপুর অংশের ফোর লেনের কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ
পদ্মা সেতু হওয়ায় নতুন করে পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করেছেন শরীয়তপুরের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ রুটে বাস চলাচলের জন্য তারা অন্তত ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সেতুর উদ্বোধনের দিনেই নতুন বাস দিয়ে যাত্রী পরিবহন শুরু করতে চান ব্যবসায়ীরা। এজন্য তালুকদার পরিবহন, সুখী পরিবহনের মতো ২৫টি বাসের মালিক এক হয়েছেন। পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলের জন্য নতুন করে ‘শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস’ নামে তাদের ২৫টি গাড়ি রাস্তায় নামবে। তবে, চার লেন সড়কের কাজ ধীরগতিতে হওয়ায় তারা বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে শরীয়তপুর সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ফারুক আহম্মেদ তালুকদার, সহ-সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন চুন্নু ও কোষাধ্যক্ষ আব্দুল খালেক পালোয়ানের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা বলেন, আমরা শরীয়তপুরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে ‘শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস` চালু করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাস্তার অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিক দিয়ে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। আমরা খুব দ্রুত চার লেনের কাজ শেষ করার দাবি জানাচ্ছি, যাতে শরীয়তপুরবাসী খুব সহজে ঢাকা যেতে পারেন।
তারা বলেন, রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কারণে আমাদের গাড়ি চালানো কষ্টকর হয়ে যাবে। চার লেনের কাজ শেষ হলে মূলাদী থেকে আবুপুর পর্যন্ত সবাই শরীয়তপুরের ফোর লেনের রাস্তা ব্যবহার করে সেতুতে উঠতে পারবেন। গাড়ির চাপ থাকবে না। যানজটও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
শরীয়তপুরের জাজিরার অধিবাসী নাজমুস সাকিব। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তিনি। সেতু চালুর পর পদ্মার দুই পাড়ের গাড়ির চাপ কেমন থাকবে— জানতে চাইলে বলেন, ফোর লেনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুর দক্ষিণ পাড়ে অর্থাৎ জাজিরা অংশে গাড়ির চাপ বাড়বে। এই এলাকার নড়িয়া ও ডামুড্যার লোকজন আগে লঞ্চে যাতায়াত করতেন। সেতু চালু হলে সময় বাঁচাতে তারা সড়কপথ ব্যবহার করবেন। ফলে গাড়ির চাপ বাড়বে। মানুষের ভোগান্তিও বাড়বে।
সেতু চালু হলে পদ্মার উত্তর পাড়ে যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত সড়কে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যানবাহনের চাপ বাড়বে। ঢাকার ধোলাইপাড় থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে থাকলেও এতে উঠতে গেলে ঢাকার অসহনীয় যানজট অতিক্রম করে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, চার লেনের সড়কের কাজ শেষ না হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যানবাহনের চাপ পড়তে পারে দক্ষিণ পাড়ের শরীয়তপুর অংশেও
নাজমুস সাকিব বলেন, সেতুর উত্তর প্রান্তে অর্থাৎ মাওয়ার দিকে আপাতদৃষ্টিতে যানজট হবে বলে হয় না। তবে, পুরোদমে সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে গাড়ির চাপ নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন হবে। কারণ, এখনও আউটার রিং রোডের কাজের অগ্রগতি নেই। সেতুতে ওঠার আগ পর্যন্ত কেরানীগঞ্জের রাস্তার অবস্থা খুবই নাজুক। আমি নিউ মার্কেট থাকি। কিন্তু গুলিস্তান হয়ে যাতায়াত করি না। কারণ, এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতেই বেশ সময় লেগে যায়। যেখানে যাত্রাবাড়ী থেকে ৩৫ মিনিটে যেতে পারি, সেখানে কেন গুলিস্তান হয়ে দুই ঘণ্টায় যাব? ইনার রিং রোডের কাজ শেষ হলে এ পাড়ের লোকজন উপকৃত হবেন।
চার লেন সড়কের অগ্রগতির বিষয়ে শরীয়তপুর জেলার সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজেদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতিসহ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করেছি। সেতুর সঙ্গে সাইড প্রকল্পগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোভিড পরিস্থিতির কারণে এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ছিল না। তারপরও প্রকল্পগুলো চালু রাখা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটি চলমান। যেখানে ভূমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে, সেখানে আমরা কাজ করছি। আরও এক বছর লাগতে পারে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে। এরপর আরও দুই বছর লাগবে মূল প্রজেক্টের কাজ শেষ করতে। অর্থাৎ ফোর লেনের সুফল পেতে ন্যূনতম তিন বছর সময় দিতে হবে আমাদের।
বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে গাড়ি নিয়ে রাজধানীর একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে অনায়াসে বের হওয়া যাবে। আটকে থাকতে হবে না কোনো যানজটে। কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে গন্তব্যে। সেজন্য দ্রুত আউটার রিং রোড নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা
‘ইতোমধ্যে আমরা প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে নিয়েছি। কেন সময় বাড়াতে হলো এবং কেন ভূমি অধিগ্রহণ হলো না, তার যৌক্তিক ব্যাখ্যাও আছে। প্রথম অর্থবছরে ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র ৪০ কোটি টাকা আমরা পেয়েছি। মোট এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকার প্রজেক্টের এক হাজার ২৩১ কোটি টাকা চলে যাবে ভূমি অধিগ্রহণে। এর মধ্যে এক অর্থবছরে মাত্র ৪০ কোটি টাকা দেওয়া হলে তা দিয়ে তো রাস্তা হবে না। গত অর্থবছরেও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তা দিয়ে ২৭ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ৬-৭ কিলোমিটার রাস্তার ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়েছে।’
‘ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে আমাদের আরও এক হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। আগামী দুই অর্থবছরে সরকার এই টাকার পাশাপাশি কনস্ট্রাকশনের জন্য আরও ৫০০ কোটিসহ মোট দুই হাজার কোটি টাকা দিলে মেয়াদ বাড়ানো সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে’— বলেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজেদুর রহমান।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর গাড়ির চাপ প্রসঙ্গে এই নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এটি নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। শুধুমাত্র বাজেট স্বল্পতার কারণে কিছুটা পেছাতে হয়েছে। পদ্মা সেতু খুলে দিলেই যে গাড়ির চাপ বাড়বে, দুর্ঘটনা হবে— বিষয়টি সেরকম নয়। টোল অ্যাকোমোডেটসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এবং জনগণকে সচেতন করে সেতুটি বিজনেস সেন্টার হিসেবে রূপ দিতে মিনিমাম পাঁচ বছর সময় লাগবে। ততদিনে আমাদের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়ে যাবে।
তার মতে, উদ্বোধনের পর পদ্মা সেতুর টোল সংগ্রহ শুরু হবে। আশা করা যাচ্ছে বাজেট স্বল্পতাও সেই অর্থে আর থাকবে না। ঠিকাদাররাও মাঠে আছেন। জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেলেই তারা সেসব এলাকায় কাজ শুরু করবেন।
যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে আইটিএস
পদ্মা সেতু চালু হলে যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়বে। এই চাপ সামাল দিতে বসানো হবে ‘ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’ (আইটিএস)। এর মাধ্যমে সড়কের কোথাও যানজট হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবে হাইওয়ে পুলিশ বা ট্রাফিক বিভাগ। সড়কজুড়ে থাকবে বিশেষ ক্যামেরা। এর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কন্ট্রোল রুম) থাকবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সদর দপ্তরে। সেখান থেকেই পর্যবেক্ষণ করা হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার যানবাহনের গতিবিধি।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে মাওয়া পর্যন্ত আইটিএস স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে পদ্মার আরেক পাড় অর্থাৎ জাজিরা হয়ে গোটা মহাসড়ক এই সুবিধার মধ্যে আসবে। আইটিএস হচ্ছে- সড়ক অবকাঠামোর সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির একটি সমন্বিত ব্যবস্থা। এটি সড়কের নিরাপত্তা, দক্ষতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করবে। ফলে কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক গাড়ি অপসারণসহ যানজট দূর করা সম্ভব হবে। সড়কের কোথাও মানুষ কিংবা প্রাণীর মৃত্যু হলে সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে পুলিশ। কোনো সড়কে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেলে বিকল্প পথ দেখানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করবে আইটিএস।
এছাড়া আবহাওয়ার বিষয়টি আঁচ করেও ট্রাফিক বিভাগকে আগাম সতর্কতা দিতে পারবে অত্যাধুনিক এই ব্যবস্থা। মোট কথা যানবাহনের পরিমাণ, গতি, দুর্ঘটনা ইত্যাদি তাৎক্ষণিক মনিটরিং করতে পারবে আইটিএস। এজন্য ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার স্থাপনে পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে সওজ। কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (কোইকা) সহায়তায় সড়কে বিশেষ ডেটা সংযোগের মাধ্যমে ক্যামেরা বসানো হবে। থাকবে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থাও।
এ বিষয়ে সওজের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম অর্থাৎ আইটিএস একটি সেন্ট্রালাইজড কম্পিউটার সিস্টেম। এর মাধ্যমে এক জায়গায় বসে সবকিছু মনিটরিং করা সম্ভব। উন্নত দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন সিস্টেম চালু আছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে সেটি দুর্ঘটনা হোক, জ্যাম বা অন্য কিছু হোক; সিগন্যাল চলে আসবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
এএজে/এআর/এমএআর/