নিরাপদ পরিবেশে ব্রেস্ট ফিডিং নিশ্চিতে আইনি লড়াই করা এক মা
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান সুপ্রিম কোর্টের একজন সুপরিচিত আইনজীবী। বাবা রাশিদুল হাসানও আইনজীবী। স্বামী শেখ সাদী রহমান বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারী জজ)। উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রিট মামলা করে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। ইশরাত হাসানের একমাত্র সন্তান উমাইর বিন সাদীর বয়স তিন বছর।
মাত্র ৯ মাস বয়সে শিশু উমাইর নিরাপদ পরিবেশে মায়ের বুকের দুধ পানের অধিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই করেন মা ইশরাত হাসান। যার ফলে হাইকোর্ট সব কর্মস্থলে, বিমানবন্দরে, রেল স্টেশনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের জন্য রুল জারি করেন ও নির্দেশনা দেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আইনি লড়াই করার করার কারণে আন্তর্জাতিক প্রো-বোনো অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন তিনি। মা দিবসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান।
ঢাকা পোস্ট : আইন পেশা কেন বেছে নিলেন?
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান : আইনজীবী পরিবারের বেড়ে ওঠার কারণে স্বভাবতই আইন পেশার দিকে বিশেষ ঝোঁক ছিল। আমার দাদা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। আমার বাবাও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তাদের দেখে ছোটবেলা থেকেই এই পেশার প্রতি আকর্ষণ বোধ করি। এছাড়া, কিছু পেশার মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা যায়। বিশেষ করে অসহায় ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করার ব্যাপক সুযোগ আইন পেশায় রয়েছে। এ কারণে আইন পেশা বেছে নিয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : সংসার বিয়ে ও সন্তানের তথ্য জানতে চাই...
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান : আমার বিয়ে হয় ২০১৮ সালে। আমার স্বামী বর্তমানে বিচারক হিসেবে বিচার বিভাগে কর্মরত। আমাদের সংসারে আলো ছড়াচ্ছে আমাদের একমাত্র পুত্র সন্তান উমাইর বিন সাদী। তার বয়স এখন ৩ বছর।
ঢাকা পোস্ট : কাজের পাশাপাশি সন্তানকে কীভাবে সামলান, সংসারে কীভাবে ব্যালেন্স করেন?
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান : কর্মজীবী নারীদের জীবন সত্যিই অনেক কঠিন। আইনপেশা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং পেশা। এ পেশায় শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রচুর মানসিক চাপ নিতে হয়। এছাড়া, নিয়মিত পড়াশোনা করে যেতে হয়। যার ফলে, সংসারে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া কঠিন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। সঙ্গে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল। আমার বাবা-মা, শাশুড়ি, স্বামী সবাই সহযোগিতা করেন। যার ফলে সংসার ও পেশার মধ্যে ব্যালেন্স করতে আমার তেমন অসুবিধা হয় না।
ঢাকা পোস্ট : বিয়ের কারণে বা শ্বশুরবাড়ির কারণে পেশাগত জীবন বিঘ্নিত হয় কি না, তাদের সাপোর্ট কেমন পান, কেমন সাপোর্ট করেন?
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান : আমি মনে করি নারীদের ক্যারিয়ারের জন্য বিয়ে বাধা নয়। মূল সমস্যা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অসযোগিতামূলক আচরণ। আবার মেয়েরা সেসব মেনে নিয়ে নিজের প্রতি অবিচার করে। আমার ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি এবং পাচ্ছি।
ঢাকা পোস্ট : বিবাহিত পেশাজীবী নারীদের/মা'দের প্রতি আপনার বার্তা কী?
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান : পারিবারিক ও পেশাগত জীবন দুটো মিলিয়েই একজন নারীর জীবন। কোনো একটা, আরেকটার জন্য ছেড়ে দেওয়া সফলতা নয়। নিজের আত্মসম্মানের জায়গাটা বজায় রাখতে হবে। যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে, সব কিছুই অর্জন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
ঢাকা পোস্ট : শিশু সন্তান নিয়ে আইনি লড়াইয়ের গল্পটা শুনতে চাই...
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান : আমার ছেলে উমাইর বিন সাদীর বয়স যখন ৯ মাস তখন আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। বেড়ানো শেষে ঢাকায় ফেরার পথে কক্সবাজার বিমানবন্দরে এসে মারাত্মক বিপাকে পড়ি। প্রচণ্ড ক্ষুধায় কান্না জুড়ে দেয় আমার অবুঝ সন্তান। তাকে বুকের দুধ পান করানোর মতো কোনো নিরাপদ স্থান পাচ্ছিলাম না। এদিকে উমাইরয়ের কান্না বেড়েই চলছিল। শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দরে নারী যাত্রীদের চেকিংয়ে দায়িত্বরত এক কর্মীকে রাজি করিয়ে চেকিংয়ের জন্য নির্ধারিত পর্দা ঘেরাও করা স্থানে কোনরকমে বুকের দুধ পান করাই। সেই অসহায় মুহূর্তে দেশের সব মা-শিশুদের এ অবস্থার প্রতিকারের জন্য আইনি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেই। পরবর্তী সময় নিরাপদ পরিবেশে শিশুর বুকের দুধপানের অধিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করি। সারা বিশ্বের ইতিহাসে ৯ মাস বয়সী আর কোনো শিশু সাংবিধানিক আদালতে পিটিশনার হয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার আবেদন করেছে কিনা আমার জানা নেই।
রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, আদালত সন্তুষ্ট হয়ে রুল জারি ও অন্তবর্তীকালীন আদেশ দেন। ইতোমধ্যে, অনেক বিমানবন্দর, বাসস্টেশন, রেলওয়ে স্টেশন, হাসপাতাল, শপিংমলসহ অনেক জনসমাগমস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং রুম স্থাপন হয়ে গেছে।
এ রিট দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাকে প্রোবোনো অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। প্রথম বাংলাদেশি আইনজীবী হিসেবে আমি বাংলাদেশের পক্ষে এই আন্তর্জাতিক পুরষ্কার গ্রহণ করি।
এমএইচডি/এসএম