ঈদকে ঘিরে জাল টাকা ছড়ানোর পরিকল্পনা ছিল চক্রটির
রাজধানীর লালবাগে ৫/৬ মাস আগে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে রেখেছিল জাল মুদ্রা কারবারি চক্র। উদ্দেশ্য ছিল রমজান ও ঈদ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণে জালটাকা তৈরি করে সমগ্র দেশে সরবরাহ করা। অষ্টম শ্রেণি পাস লিটন এই কারখানার মূল পরিচালক। তিনি নিজে মেকার। তিনি বিশেষ কাগজ, নিরাপত্তা সুতা তৈরির জন্য ডায়াস কেনেন। জলছাপ দিয়ে বিশেষ কাগজের জাল টাকা যেত প্রিন্টিংয়ে।
লাখ টাকার জাল নোট ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। লিটনের কাছ থেকে জাহাঙ্গীর ও মহসিন জাল টাকা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজারে কিনে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করেন।
রাজধানীর লালবাগ থানাধীন নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধ এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন মানের জাল বাংলাদেশি টাকা ও ভারতীয় রূপি তৈরির কারখানা আবিষ্কারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) পরিচালিত ওই অভিযানে ৪ জন জাল টাকা ও রূপি তৈরিকারক এবং পাইকারকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের অবৈধ মাদক উদ্ধার টিম।
যুগ্ম-কমিশনার ডিবি (উত্তর) হারুন-অর-রশিদ ও ডিসি ডিবি মশিউর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে গ্রেপ্তারদের থেকে তৈরিকৃত বিভিন্ন মূল্যমানের প্রায় ২০ লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা ও দেড় লাখ ভারতীয় জাল রুপি উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম, আলী হায়দার, তাইজুল ইসলাম লিটন ও মহসিন ইসলাম মিয়া।
এছাড়া জাল টাকা ও রুপি তৈরিতে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, প্রিন্টার, বিভিন্ন রকমের কালি, স্ক্রিন ফ্রেম, বিশেষ ধরনের কাগজ, কেমিক্যালস, স্ক্যানার মেশিন, কাটার ও স্কেল জব্দ করা হয়েছে।
ডিএমপির গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, পবিত্র রমজান মাস ও আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে করোনা মহামারি পরবর্তী সুষ্ঠু পরিবেশে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক মহাযজ্ঞ চলছে। রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে জালনোট কারবারিরা বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে এই মর্মে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায়।
ওই তথ্য যাচাই বাছাই ও বিশ্লেষণ করে জাল মুদ্রা কারবারিদের অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল ডিবি পুলিশ।
ডিজিটাল ও গোয়েন্দা তথ্য মতে, জাল টাকা ও রুপির একটি চালান সংগ্রহের জন্য নাটোর থেকে ঢাকায় এসেছিল জাল মুদ্রা কারবারি জাহাঙ্গীর আলম। তাকে অনুসরণ করে গোয়েন্দা পুলিশ মঙ্গলবার বেল ১১টার দিকে নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধ এলাকায় নির্মাণাধীন একটি ছয়তলা বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের টাকা ও রুপি জাল প্রস্তুতকারকদের।
ফ্ল্যাটটি গত ৫/৬ মাস ধরে ভাড়া নিয়ে রেখেছিল চক্রটি। উদ্দেশ্য ছিল রমজানের আগে ও মাঝে এখানে বিপুল পরিমাণে জাল মুদ্রা তৈরি করে সমগ্র দেশে সরবারহ করা। গ্রেপ্তার প্রত্যেকের বিরুদ্ধে জাল টাকা তৈরি ও বিক্রির একাধিক মামলা রয়েছে।
অষ্টম শ্রেণি পাস লিটন এ কারখানার মূল পরিচালক। তিনি নিজে মেকার। দীর্ঘদিন নীলক্ষেতে কম্পিউটারের দোকানে গ্রাফিক্সের কাজ করায় বিভিন্ন ধরনের জাল কাগজপত্র, দলিলাদি, জাল টাকা/রুপি বানাতে পটু লিটন।
লিটন বিশেষ ধরনের কাগজ কিনে তা জোড়া লাগানো, কাগজে বঙ্গবন্ধুর ও গান্ধীর ছবি স্ক্রিন প্রিন্টিং/জলছাপ দেওয়া, রংয়ের সমন্বয়ের কাজ করেন। জাল টাকার নিরাপত্তা সুতা জোড়া লাগান আইকা বা অন্যান্য গাম দিয়ে। বঙ্গবন্ধু বা মহাত্মা গান্ধীর ছবি তিনি নিজে মূল টাকা থেকে স্ক্যানিং করে পেনড্রাইভে নিয়ে রাখেন।
নিরাপত্তা সুতা তৈরির জন্য ডায়াস কেনেন। জলছাপ দেওয়া হলে দুটি বিশেষ ধরনের কাগজ একসঙ্গে জোড়া দিয়ে শুকিয়ে এরপর টাকা প্রিন্টিংয়ে যায়।
তার এসব কাজে সহযোগিতা করে আলী হায়দার। জাল টাকা তৈরির পরে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। জাহাঙ্গীর ও মহসিন মূলত লিটনের কাছ থেকে জাল টাকা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজারে কিনে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করেন।
জাহাঙ্গীর নওগাঁ, নাটোর, বগুড়াসহ দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেকগুলো ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন। খুচরা বিক্রেতারা শহরের ব্যস্ততম এলাকায় রেস্টুরেন্ট, ভোজ্য সামগ্রী, প্রসাধনী, পরিধেয় বস্ত্র ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ভালো টাকার ভেতরে জাল টাকা ঢুকিয়ে দেন।
মেকার তাইজুল ইসলাম ওরফে লিটন জাল রুপিগুলো পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করেছিল দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বিক্রির জন্য। আলী হায়দার টাকা তৈরিতে সহযোগিতাসহ এগুলো বান্ডিল আকারে বড় ডিলারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
জেইউ/ওএফ