বাংলার সমৃদ্ধিতে হামলার ঘটনায় অপপ্রচার চালানো হচ্ছে : বিএসসি
ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজ মিসাইল হামলার শিকার হওয়ার ঘটনাকে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ভিন্নভাবে প্রবাহিত করার অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)। এটিকে বিএসসির উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।
‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে মিসাইল হামলার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। সোমবার (৭ মার্চ) বিএসসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) তারেক-উল-ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়।
এতে বলা হয়, বিএসসির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য ও সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অগ্রহণযোগ্য।
বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক শিপিং আইন ও বিধি-বিধান পরিপালনপূর্বক সম্পাদিত চুক্তিপত্র (চার্টার পার্টি) অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) জাহাজ চার্টারিং কাজ অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডেনমার্ক ভিত্তিক চার্টারার ডেলটা কর্পোরেশনের সঙ্গে বিএসসি’র সম্পাদিত চার্টার পার্টি অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী টাইম চার্টার ভিত্তিতে জাহাজটি ভাড়ায় চলছিল।
গত ২৬ জানুয়ারি মুম্বাই বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই করে তুরস্কের ইরেগলিতে পণ্য খালাস করে। সেখান থেকে পূর্বনির্ধারিত ভয়েজ অর্ডার অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের উদ্দেশে জাহাজটি রওনা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের আউটার অ্যাংকরেজে পৌঁছায়। পরদিন বন্দর পাইলটের মাধ্যমে একসঙ্গে ২১টি জাহাজ কনভয় আকারে ইনার অ্যাংকরেজে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বন্দর থেকে সিরামিক ক্লে নিয়ে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল বাংলার সমৃদ্ধির। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হলে অনতিবিলম্বে লোডিং বাতিল করে জাহাজটিকে বন্দর ছেড়ে আসার জন্য মাস্টারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু বন্দর কর্তৃক পাইলট সরবরাহ না করা, পোর্ট অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ হওয়া এবং বন্দর চ্যানেলে মাইন পোঁতার ফলে অলভিয়া বন্দরে আটকে পড়ে জাহাজটি। এরপর যুদ্ধ চলার মধ্যে ২ মার্চ (বুধবার) একটি মিসাইল আঘাত হানে বাংলার সমৃদ্ধির ওপর। তাতে আমাদের একজন প্রিয় সহকর্মী থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান। এতে বিএসসি পরিবার খুবই শোকাহত এবং তার আত্মার মাগফেরাত কামনাসহ তার শোকাহত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছে।
উল্লেখ, মিসাইলের আঘাতে জাহাজের মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (ন্যাভিগেশন ব্রিজ) পুরোপুরি বিধ্বস্ত এবং প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
জাহাজে অবস্থানরত নাবিকদের জীবন রক্ষার্থে বিএসসি, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সময়োচিত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে অর্থাৎ ৩ মার্চ জাহাজটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণাপূর্বক ২৮ জন নাবিককে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া মরদেহটি জাহাজ থেকে স্থানান্তর করে পোল্যান্ডের বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় ইউক্রেনে মর্গে নিরাপদে রাখা হয়েছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে পাঠানোর বিষয়ে বিএসসি’র মতামত দিয়ে বলা হয়েছে—
আন্তর্জাতিক শিপিং নিয়মানুযায়ী চার্টারার ও বিএসসি’র মধ্যে তিন মাসের জন্য গত ১৫ জানুয়ারি চার্টার পার্টি সম্পাদিত হয়। ওই চার্টার পার্টি সম্পাদনকালে কোনোরূপ যুদ্ধ ঝুঁকি ঘোষণা না থাকায় ইউক্রেনকে ট্রেডিং এরিয়ার বাইরে রাখা হয়নি। লন্ডন জয়েন্ট ওয়ার কমিটি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সি অব আজব এবং ব্ল্যাকসী এরিয়াকে যুদ্ধঝুঁকি এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। যা ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে বিমা সংস্থা নিশ্চিত করে। কিন্তু জাহাজটি পণ্য খালাসের জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ইরেগলি (ব্ল্যাকসী এরিয়া) বন্দরে পৌঁছে অর্থাৎ ওয়ার জোন এরিয়া ঘোষণার আগেই জাহাজটি সেখানে পণ্য খালাসের জন্য যায়।
যুদ্ধঝুঁকি এলাকা থেকে পরবর্তী বন্দরের জন্য পণ্য বোঝাই করা অর্থাৎ ইউক্রেন-ইতালি ভয়েজের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা (ইউএন, ন্যাটো, আইএমও) এবং ফ্ল্যাগ স্টেটের কর্তৃক কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
এছাড়া ওই ভয়েজের জন্য বিধি মোতাবেক ইনস্যুরেন্স কভারেজ প্রাপ্তি এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন কর্তৃক কোনো রূপ বাধা বা আপত্তি উত্থাপিত না হওয়ার ফলে চার্টার পার্টি অ্যাগ্রিমেন্টের যুদ্ধঝুঁকি সংক্রান্ত ধারার বিধান মোতাবেক ভয়েজ অর্ডার বাতিল করার কোনোরূপ রিজনেবল জাজমেন্ট তৈরি হয়নি।
তৎপ্রেক্ষিতে চার্টারার দেওয়া পূর্বনির্ধারিত ভয়েজ আদেশ বাতিলপূর্বক যুদ্ধঝুঁকি এলাকা থেকে লোডিং ছাড়া জাহাজ ফেরত আসার নির্দেশনা দেওয়ার কোনো আইনগত সুযোগ/এখতিয়ার বিএসসির ছিল না। যুদ্ধঝুঁকি এলাকায় কার্গো অপারেশন চলমান ছিল বিধায় সংশ্লিষ্ট পোর্ট অথরিটি বিএসসি’র জাহাজসহ ২১টি জাহাজ একত্রে কনভয় আকারে ইনার অ্যাংকরেজে প্রবেশ করায়। ইনার অ্যাংকরেজে জাহাজ ঢোকানোর পরপরই যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং বিএসসি’র জাহাজ মিসাইল হামলার শিকার হওয়া সংক্রান্ত ঘটনাটি খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং বিএসসি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত।
বিএসসির কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে গাফিলতি প্রসঙ্গে সংবাদের বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে—
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ দিকনির্দেশনা মোতাবেক ২০১৮-১৯ সালে প্রতিটি ৩৯ হাজার ডিডব্লিউটিসম্পন্ন ৬টি নতুন জাহাজ বিএসসি বহরে সংযোজন করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন আকারের নতুন আরও ৬টি জাহাজ ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিএসসি পরিচালনা পর্ষদের সময়োপযোগী নির্দেশনা, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সরকার কর্তৃক প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও বিএসসি’র কর্মকর্তাদের টিমওয়ার্কের মাধ্যমে দক্ষ জাহাজ চার্টারিং ব্যবস্থাপনার ফলে বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে বিএসসি নিট ৭২ দশমিক ০২ কোটি টাকা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
করোনা মহামারি পরিস্থিতি চলমান থাকা সত্ত্বেও বিএসসির দক্ষ জাহাজ চার্টারিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইতোমধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের ১ম দুই কোয়ার্টারে প্রায় ১২৬ কোটি টাকা লাভ হয়েছে। বর্তমানে বিএসসির জাহাজ বহর অত্যন্ত দক্ষতা ও সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে।
কেএম/এসএসএইচ