গৃহিণী মায়ের গল্প
মায়েরা হাসলে মনে হয়, চেরিফুলের উৎসবে ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। জগতে মা ও মায়ের হাসির চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। প্রতিটি সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান থাকে অবর্ণনীয়। মায়েরা সন্তানের জন্য নিজেদের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেন প্রয়োজনে। সেই ত্যাগের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। একজন সন্তানের জীবনে মা নিত্যদিনের, চিরকালীন। মা তো সবসময়ই শ্রদ্ধার, পূজনীয়, তবুও তাদের বিশেষ মর্যাদা দিতেই মা দিবসের প্রচলন শুরু।
পৃথিবীর অনেক মা সন্তানের জন্য স্যাক্রিফাইস করেন তার ক্যারিয়ার। একজন মানব সন্তানকে বড় করে তোলার মতো কঠিন ও গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজ আর কিছুই নেই। সেই দায়িত্ব মায়েরাই পালন করেন। মূলত মা হওয়ার পর একজন নারী জীবনে আর যা কিছুই করুক না কেন, তা বোনাস কাজের মতো। কেননা, সে সবচেয়ে বড় কাজটাই করে মা হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। একজন নারীর আলাদা কোনো ক্যারিয়ার হোক কিংবা না হোক, তবুও সে সফল। প্রতিটি নারীই আসলে এক একজন সফল নারী!
সায়লা পারভীন।দুই কন্যা সন্তানের জননী। তার স্বামী প্রকৌশলী ছিলেন, এখন বেঁচে নেই। তিনি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন, তখন তার বিয়ে হয়। ইন্টারমিডিয়েটের পর তার আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া হয়নি। পুরোদমে সংসার সামলেছেন আর সন্তানদের বড় করে তুলেছেন। তার স্বামী শহরে চাকরি করতেন, তিনি গ্রামে থেকে সন্তানদের লালন পালন করতেন। পড়াশোনা করার অনেক স্বপ্ন ছিল তার। ইচ্ছে ছিলো নিজে স্বাবলম্বী হবেন, কিন্তু সংসার আর সন্তানদের দায়িত্বভার নিতে গিয়ে তার স্বপ্নটা পূরণ হয়নি। তিনি যখন সাংসারিক কাজ করতেন, তখন সন্তানরা বাড়িজুড়ে খেলাধুলা করে বেড়াতো নিজের মতো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটা সম্ভব খেয়াল রাখতেন। তিনি বলেন, সন্তানদের সুখই একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সন্তানরা যদি ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সুস্থ থাকে, তাহলে নিজের কষ্টের কথা আর মনে থাকে না। আমার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানদের দ্বারাই পূরণ করতে চাই। আমি বেশিদূর পড়তে পারিনি, ওরা অনেক পড়ুক, অনেক বড় হোক, সেটাই চাওয়া।
মৌসুমি সাহা জুঁই। এক পুত্র সন্তানের জননী। তিনি বলেন, সন্তান হবার আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম, তবে পরবর্তীতে আর কোনো চাকরিতে জয়েন করিনি সন্তানের কথা ভেবেই। আমি খুব সাধারণ একজন মা, আমার সন্তানও সাধারণ। তিনি ঘরকন্নার কাজ করেন, সেইসঙ্গে সন্তান যাতে দারুণভাবে মানুষ হয় তাই তাকে রোজ সুন্দর সুন্দর শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তিনি মনে করেন, সন্তান বড় হয়ে তার পছন্দমতো ক্যারিয়ার গড়ে নেবে, তা নিয়ে মা হিসাবে তার দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই। তার একটাই চাওয়া, তার সন্তান যেন আগাগোড়া একজন খাঁটি মানুষ হতে পারে। তিনি যখন ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন তার সন্তানকে দেখে রাখেন তার শ্বাশুড়ি। এতে তার অনেক উপকার হয়, নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারেন।
রিমা জাহান। তিন কন্যা সন্তানের জননী। পড়াশুনা করেছেন প্যাথোলজিতে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর একে একে তিন সন্তানের জন্ম হয়। নিজের কথা ভাবার আর সুযোগই হয় না তার। পুরোটা সময় সন্তান আর সংসারেই দিতে হয়। প্রথম প্রথম স্বপ্নটা তবু বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সন্তানদের বড় করে তোলাই তার ভবিষ্যৎ, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সন্তানদের দেখাশোনা করার কেউ নেই। এক হাতেই তাকে সাংসারিক কাজ করতে হয়, আবার সন্তানদেরও দেখাশোনা করতে হয়।
সুস্মিতা নাহার। তার দু’জন পুত্র সন্তান, দু’জনই মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। তারা মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকে। রোজ তিনবেলা রান্না করে সন্তানদের কাছে নিয়ে যান। তাদের ভালো মাদ্রাসায় পড়ানোর জন্য শহরে এসে থাকেন। গ্রামে যাওয়া হয় কম। স্বামী ব্যবসায়ী, তার আয়েই সংসার চলে। তাকে চাকরি করতে দেয়া হয়নি সন্তানদের দেখভাল করার জন্য।
শামীমা রহমান। তিন কন্যা সন্তানের জননী। সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে যাকে মাঝপথে ছাড়তে হয় পড়াশোনা। তবে তিনি মনে করেন, জীবনে যা হয়নি, তা নিয়ে বেশি দুঃখ করে লাভ নেই। নিজের সবটুকু দিয়ে সন্তানদের বড় করে তোলার চেষ্টা করছেন। তার বড় মেয়ে খুব ভালো ছবি আঁকে, মেজ মেয়ে দারুণ আবৃত্তি করে, ছোট মেয়ের বয়স মাত্র এক মাস। পড়াশোনার পাশাপাশি মেয়েদের যেসব অনন্য প্রতিভা আছে, সেসব প্রতিভা ভালোভাবে বিকশিত করানোর জন্য তার প্রচেষ্টার কমতি নেই। সন্তানদের দেখাশোনা করার কেউ নেই। তাকেই ঘরের কাজ করতে হয়, সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়, তাদের যাবতীয় কাজ করে দিতে হয়।
মায়েরা সন্তানের জন্য জীবনভর যে ত্যাগ করে যায়, কোনভাবেই তার প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়। তবুও সন্তানদের উচিত মায়ের জন্য সর্বোচ্চটুকু করা, তাদেরকে শ্রদ্ধা করা, তাদের মুখে হাসি ফোটানো। কোনো মা যেন বৃদ্ধাশ্রমের দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে, প্রতিটি সন্তান যেন ততোটুকু মানুষ হতে পারে। সব মা সন্তানের কাছে ভালো থাকুক।