টেলিপ্যাথি : অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি
বাবার হঠাৎই চাকরির বদল হলো সিলেট শহরে। বাবা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন শহরে। ভর্তি করিয়ে দিলেন শহরের একটি স্কুলে। আর আমার ছোট ভাই থেকে গেল মায়ের সঙ্গে। আমি সবে তখন প্রাইমারি স্কুল ডিঙিয়ে হাইস্কুলে পা দিয়েছি। চঞ্চলতার বয়স তখনো পার হয়নি। গ্রামের মাঠ- ঘাট, কাদা-মাটি আর মায়ের আঁচল ধরে আমার বেড়ে ওঠা। হঠাৎ ইট পাথরের এই বিশাল শহরে আমাকে বড্ড বেমানান মনে হতো। মায়ের কথা মনে পড়তো, ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়তো, পাড়ার ফুটবল খেলার কথা মনে পড়তো।
মা আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিতেন। মন দিয়ে পড়তে বলতেন, চিন্তা না করতে বলতেন। গ্রাম থেকে কেউ এলে সঙ্গে করে বাড়ির সবজি, মাছ পাঠিয়ে দিতেন। আমার এসবে মন ভরতো না, মনে হতো কবে ছুটি পাবো। কবে মায়ের গন্ধ নেবো, মাকে কবে দেখবো। এতদিন মায়ের আঁচল ধরে বেড়ে ওঠা আমার তখন একেকটা দিন খুব নিঃসঙ্গতায় কেটেছে। মনে হয়েছে সব থেকেও যেন একটা বড় শূন্যতা ঘিরে আছে চারপাশে। এ শূনতা মা ছাড়া কোনোকিছুতে ঘুঁচবে না।
বাবা বিষয়টা বুঝতেন। বাবার এত ভালোবাসায়ও মায়ের অভাব পূরণ হতো না। এ এক অদ্ভুত শূন্যতা, যা প্রকাশ করা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়, হৃদয়ের গভীরে হৃদয় নিংড়ে অকারণে নাড়া নেয় সারাক্ষণ। বন্ধুদের কাউকে মায়ের সঙ্গে দেখতে পেলে শূন্যতা যেন আরো বেড়ে যেত। মনে হতো, সব ছেড়ে মায়ের আঁচলে লুকাই, লুকিয়ে চলে যাই মায়ের কাছে।
এর মধ্যে আব্বু দু’দিনের জন্য ট্রেনিং-এ চলে যান। আমি সিলেটের ছোট্ট বাসায় একাই থাকছি। অল্পকিছু দিন হলো তাই আশেপাশের কাউকে তেমন চিনিও না। যেন অথৈ সাগরে পরলাম। একে তো মাকে ছাড়া এ শহর আমার কাছে নতুন, এখন বাবাও নেই। এর মধ্যে জ্বর এলো। তখনকার সময় মোবাইল ফোন ছিল না, এমন কি টেলিফোনও এত সহজলভ্য ছিল না। কাউকে কিছু জানানোর সুযোগ নেই। আমার জ্বর রাতে বাড়তেই থাকলো। আমার খিদে পায় গভীর রাতে, আমি ভাত রান্নার চেষ্টা করেও পারিনি। খিদে আর জ্বরে আমি শয্যাগত। আবার জ্বরের সঙ্গে বমিও হচ্ছে। শরীর একেবারে নিস্তেজ।
সকাল দশটায় দরজায় নক হলো, আমি কোনোরকম শক্তি সঞ্চয় দরজা খুললাম। দেখলমা মা দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম জ্বরে হয়তো এলোমেলো কিছু দেখছি। পরে বুঝলাম সত্যিই মা এসেছেন। আমার মা এমন অবস্থা দেখে কান্নায় জড়িয়ে ধরলেন। আমি সব বললাম। মা জানালো আরো অদ্ভুত কথা। মা নাকি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছে আমি খুব অসুস্থ তাই চাকরি থেকে দু’দিন ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন ছোট ভাইকে সঙ্গে করে। মায়ের অফুরান যত্ন আর যাদুকরী স্নেহে জ্বর দু’দিনেই পালালো। বাবাও এলেন। আমাকে সারিয়ে তুলে মা বাড়ি গেলেন। আমি শূন্যতায় অভ্যস্ত হওয়ার ভান করে বড় হতে লাগলাম।
ত্রিশ বছর আগেকার ঘটনা আমার কাছে আজো অদ্ভুত মনে হয়। ব্যাখ্যারও অতীত মনে হয়। আচ্ছা, সব মা-ই কি এমন হয়? সব মা-ই কি এমন অদৃশ্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়? মায়েরা আসলেই অদ্ভুত মায়াময় ধাতু নিয়ে তৈরি, যার বাইরে শক্ত হলেও ভেতরটা ভালোবাসাময়।