মায়ের বেঁচে থাকাই সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার
সময়টা ২০০৪ সাল। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার চলছিল মোটামুটি ভালোভাবেই। বাবা ও বড় ভাই ছোট একটি ব্যবসা করেন। আমাদের পরিবারের সদস্য তখন ৮ জন। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে সে শ্বশুরবাড়িতে। আমাদের পরিবারের সুখের মাঝে হঠাৎ করে চলে এলো কালো মেঘের ছায়া। আমার মা হঠাৎ করে ২০০৪ সালের মার্চ মাসে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ (ব্রেন স্টোক) হয়ে অসুস্থ পড়েন। তিনদিন পর জ্ঞান ফেরে। কিছুটা সস্তি এলেও মায়ের শরীরের ডান দিকের সবটা অংশ প্যারালাইসিস হয়ে যায়। শুধু তাই না, মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়। যে মা আমাদের সঙ্গে কথা না বলে একদিনও থাকতে পারতেন না সে হঠাৎ বাকহীন হয়ে পড়লো! আমাদের যেমন মনে আঘাত লেগেছে, তেমনই মায়ের কতটা না কষ্ট হয়েছে সেকথা একমাত্র আল্লাহই জানেন। মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমাদের অল্প যেটুকু মাথা গোঁজার জায়গা ছিলে তা বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো। শত চেষ্টা করেছি সুস্থ করে তুলতে। পারিনি শুধু সাধ্য না থাকার কারণে।
কেনো পারিনি চিকিৎসা করাতে? আমার বাবা ও ভাইয়ের ব্যবসা আর সম্পত্তি যা ছিল তা জরুরি প্রয়োজনে মাত্র ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। সে অর্থ দিয়ে চিকিৎসা করার পরও মায়ের উন্নতি হয়নি। তারপর কী আর করার, মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করেই চলেছি আমরা। বড় ভাই ছোট ব্যবসা করতেন, তেমন আয় হতো না। বাবাও বেকার হয়ে গেল। আমি তখন ছোট মানুষ। একদিকে পড়াশোনা করবো নাকি কাজে গিয়ে সংসারে অল্প সহযোগী হয়ে উঠবো, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন এমন একটা অবস্থা হয়ে গিয়েছিল যে পরিবারের যেদিন মায়ের ওষুধ কেনা হয়েছে, সেদিন আমাদের ঘরে খাবার জোটেনি। যেদিন খাবার জুটেছে, সেদিন থাকতো শুঁটকি, ডাল-আলু ভর্তা।
মা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া মাংস ছাড়া নিজে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। আমার মা শুধু ইশারায় আমাদেরকে বলতেন তার চিকিৎসার জন্য আর কিছু করা লাগবে না। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করতেন, যতটুক আয় হয় তা যেন নিজেদের সংসারের কাজে ব্যবহার করি। মা যতই না করুক, আমাদের মন মানতো না। আমরা পরিবারের সবাই অনেক চেষ্টা করেছি অর্থের ব্যবস্থা করে মায়ের চিকিৎসা করাতে। শত চেষ্টা করেও পারিনি, কারণ অসহায় অবস্থায় পাঁচশো টাকা দিয়ে পাশে থাকারও মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদেরসহযোগিতা করে আর কী হবে, আমরা ফেরত দিতে পারবো কি না বিত্তশালীদের মনে সন্দেহ থাকতো। পরিশেষে মা দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে ২০০৮ সালের ০৪ই ফেব্রুয়ারি ভোর ৬.৪০ মিনিটে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ পরপারে পাড়ি জমান। কষ্টময় জীবন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি একা উড়ে চলে গেল আমাদের সবাইকে রেখে।
আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার বড় ভাইয়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সরকারি চাকুরি হলো। আর আমার ছন্নছাড়া জীবনে এলো সুসংবাদ। ২০১১ সালে দেশের সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন সময় টিভিতে চিত্র সাংবাদিক হিসেবে অফিসিয়াল নিয়োগ পেলাম। পরিবারে সুখের সময় ফিরে পেয়েছি ঠিকই তবে মায়ের চিকিৎসায় নিজের উপার্জিত অর্থ একটি টাকাও ব্যয় করতে পারিনি। বড় আক্ষেপ থেকে গেলো জীবনের বাকি সময়ে।
আমার মা মারা যাওয়ার ১৫ বছর পার হয়েছে। এখন চাকুরি, অর্থ, সম্পত্তির সব আছে। শুধু মায়ের জন্য কিছু করার সুযোগটা নেই।
আমার মনে হয়, সুখের দিনে মা থাকাটাই মহান সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ উপহার। প্রতি বছর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী আসে, চলে যায় বিশ্ব মা দিবস। ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদে মা-হীন পৃথিবী আমার। সব আছে, শুধু আমার ঘরে হিরার টুকরাটা নেই। জন্মের পর মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে প্রতিটি মানুষের, এটাই সত্যি। তবুও স্রষ্টা যদি একটু সুযোগ দিত মায়ের জন্য কিছু করার, তাহলে জীবনের সব অপ্রাপ্তি ঘুঁচে যেতো আমার।
সিনিয়র চিত্র সাংবাদিক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যুরো অফিস, সময় টেলিভিশন।