সেই যে আমার মা...
আম্মুর তখন নতুন চাকরি হয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। আমি আম্মু, আব্বু আর ভাইয়া তখনও যশোরে থাকি আর প্রতি বৃহস্পতিবার আলম কাকুর দোকানে প্রাণ জুস খেতে যাই। বয়স চার! জানলাম, সুখের দিন শেষ। আম্মুর সঙ্গে আমিও নানাবাড়ি চলে যাবো, তার পোস্টিং হয়েছে সেখানেরই এক গ্রামে। কেন তাকে নানাবাড়ি বলা হয় আমি ভেবে পাই না। আমার নানা নানু কেউই সেখানে থাকেন না। থাকেন নানার ভাইয়েরা, তাদের সঙ্গে আমার একটু পটলেও নানুদের সাথে একদমই পটে না। তারা আম্মু না থাকলে আমাকে এক প্লেট ভাতের সঙ্গে মাত্র এক চামচ গুড় দেন, এটা কি সম্ভব আমার জন্য? তাদের সঙ্গে পটবেই বা কীভাবে? তার চেয়ে বড় বিষয়, তারা বলে বেড়ান, রেখার ছেলে শুধু খায়, সারাদিন মিষ্টি চায়!
যাই হোক, যশোর থেকে আসার পর বুঝলাম, এখানেই থাকতে হবে অনেকটা দিন! সপ্তাহ শেষে একবার যাওয়া হবে। সপ্তাহ কয়দিনে? এসবের হিসাবও বুঝতাম না! আম্মু দু’দিন বাদে স্কুলে যাওয়া শুরু করলেন। সেই সকালে বের হয়ে যেতেন, ফিরতে ফিরতে বিকেল। প্রথম কদিন আমি কিচ্ছু বলিনি, তবে এরপর দিনের বেলা নিঃসঙ্গ কাটতে থাকলো যখন, আমার আর ভাল্লাগে না। আমি আম্মুকে প্রতি রাতে বলি ‘আমাকেও তুই স্কুলে নিয়ে যাবি, আমি থাকব না এদের সাথে’! আম্মু বোঝান, এখান থেকে বাস, বাস থেকে নেমে অনেক পথ হাটতে হবে। চার মাইল, আমি পারব না, তাই তিনি নিতেও চান না। আমার বাঁধ মানে না। আমি সকালে আম্মুর আচল ধরে বসে থাকি। আম্মু ছাড়াতে পারেন না। বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে কোনো একটা সময় আমাকে ছেড়ে চলে যান। আমি চিৎকার করে কাঁদতাম যখন বুঝতাম আম্মু চলে গেল বুঝি, ওই বাসের শব্দ হলো! হাত-পা ছুড়ে কাঁদতাম, কেউ আগলে রাখতে আসেনি সেদিন!
এমনও দিন আমার মনে আছে, কাঁদতে কাঁদতে সেই ধুলোতেই গড়াগড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি! উঠেছি অনেক পরে। কারও ইচ্ছে হয়েছে তো কলপাড়ে যেয়ে দাঁড়ালে আমাকে গোসল করিয়ে দিল, নয়তো না। যতই এমন করে লিখি না কেন, সেই অসহায়ত্ব আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। আমি আম্মু আসার পর সব বলি, বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলি, তবুও তিনি অতটা পথ আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে নারাজ। ভ্যান আছে না রাস্তায়? থাকলেও প্রতিদিন ভ্যান ভাড়া করে যাওয়া আম্মুর জন্য আধিখ্যেতা! আমি বুঝেও না বোঝার ভান করি, নাকি বুঝতাম না?
এক সকালে আম্মু রাজি হলেন, আমি মহাসমারোহে স্কুলে যাওয়ার জন্য সেজেগুজে রেডি। আমার একটা প্লাস্টিকের প্লেন ছিল, শুধু চাকা খুলে যেত সেই প্লেনের। আমি বিশাল দড়ি দিয়ে বেঁধে প্লেনটা নিয়ে ঘুরতাম। সেটাও সাথে নিলাম, দুই পকেটভর্তি পেয়ারা। আমার নানুরা জানলে খবর আছে। কী কী গালি দিতেন তারা, আমার মনে আছ, বলা যাবে না। প্রথমে বাসে উঠলাম। বাস জিনিসটা বরাবর আমার কাছে বিস্ময়ের। এই জিনিসটা কীভাবে চলছে? আমার যেদিন অনেক টাকা হবে নিশ্চয়ই একটা বাস থাকবে আমার, এসব ভাবতাম আর গর্ববোধ করতাম এই বাসের এক যাত্রী হিসেবে। বাস থেকে নেমে শুরু হল হাঁটা। মালঞ্চী শ্রীরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমি হাঁটি আর একটু জিড়িয়ে নেই। আবার হাঁটি। আমার প্লেনটা ধুলো উড়িয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলে। আম্মুকে বলি, আমি তো হেঁটে এসেছি, আমাকে কিন্তু আবার আনতে হবে। আম্মুর কোনোই উত্তর থাকে না। আমি নিজেও বুঝি না, হাঁটার কষ্ট আর একা একা বসে থাকার কষ্টের তারতম্য করতে পারি না।
যাই হোক, স্কুলে পৌঁছাই একটা সময়, বলাই বাহুল্য অজপাঁড়াগায়ের স্কুল, প্রধান শিক্ষক তো সেখানে ‘আপা’। ‘আপা’র ছেলে হিসেবে সবাই কোলে কোলে নিয়ে ঘোরে, আমার মজার শেষ নেই। আমার আগ্রহ বাড়ে স্কুলকে ঘিরে। ক্লাসে ক্লাসে যাই, ঘুরি ফিরি, লাইব্রেরী রুমে আসি। জানেন তো, গ্রামের স্কুলে টিচার্স রুমই লাইব্রেরী! সেখানে পাটি পাতা থাকে। আমার কিছু খেলনাও আছে। ‘যা নেবে দুই টাকা’ টাইপ খেলনা। আমি মজা পেয়ে যাই।
এভাবেই নিত্যদিন আসা শুরু হলো আমার স্কুলে। এসব কাহিনির কিছু কিছু আমার মনে আছে, কিছু কিছু আম্মুর মুখে শোনা। একবার হল কী, আমি বিশেষ এক বিস্কুটের ভক্ত বনে গেলাম। তার প্যাকেটে সাইকেলের ছবি আঁকা। চার বছরের শুভ্রর ধারণা, সাইকেল চালাতে শিখতে হলে এই বিস্কুট খাওয়া লাগবে। আমার প্যাকেটের পর প্যাকেট বিস্কুট শেষ হতে থাকলো, পরিণতি ডায়েরিয়া! স্কুলের লাইব্রেরী তো ভাসিয়েই দিলাম মনে হয়। আম্মু তো লজ্জায় শেষ, আমি আর কী করি! এরকম কোনো এক দুপুরে আম্মু ক্লাস নিয়ে লাইব্রেরীতে এসে দেখেন খেলতে খেলতে আমি মেঝেতেই ঘুমিয়ে গেছি। তার চোখে জল আর ধরেনা, কেন ঘুম ভেঙে তাকে কাঁদতে দেখেছি তখন, সেদিন বুঝিনি। আজ বুঝি, যখন এসব কথা লিখতে যেয়ে নিজের চোখদুটিও ছল ছল করে উঠছে!
এভাবেই কেটেছে কয়েকমাস! আম্মুর থিওরি সত্যি ছিল, আমাকে হেঁটে যেতে হবে বিধায় আমিই আস্তে আস্তে সয়ে যেতে লাগলাম কথিত নানিবাড়িতে। মাঝে মাঝে স্কুলে যেতাম, মাঝে মাঝে থেকে যেতাম। আম্মুর দুশ্চিন্তা ছিল পুকুর নিয়ে, দিনে একশোবার না করতেন যেন ওদিকটা না যাই। যেতামও না। বারান্দায় এক চৌকিতে বসে থাকতাম। এক খেলা শুরু হলো, আমি প্লেটকে স্টেয়ারিং বানিয়ে আর চৌকিকে খাট বানিয়ে গাড়ি গাড়ি খেলা শুরু করলাম! আমার ছোট নানাভাই ছিলেন নিয়মিত যাত্রী। তিনি কতই না গল্প শুনিয়েছেন আমাকে। কারও কারও হয়ত করুণ হতো বলেই কাজ ছেড়ে আমার গাড়ি গাড়ি খেলায় সায় দিতেন, কে জানে!
তখন সাদা রঙের টিনের এক রকম প্লেট পাওয়া যেত, কালো বর্ডার। আমাকে এক নানা তা কিনে এনে দিলেন কোনো এক হাটের দিন। আমার খুশি দেখে কে! সেই প্লেট এখনও আমার সংগ্রহে আছে। শুরুতেই বলেছি প্রতি সপ্তাহে যশোর যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। সপ্তাহের হিসাব কষে কীভাবে আমার জানা নেই তখন। তবে যেদিন আম্মু একটু আগে আগেই স্কুল থেকে চলে আসতেন আমার কী খুশি! হুম, সেদিন থাকত বৃহস্পতিবার, চলে আসা হতো যশোরে! এরকম এক বছর কেটেছে আমার দোটানায়।
তবে এভাবে আর বেশিদিন চলেনি। কোনো এক শনিবার আম্মু যখন নানাবাড়ি যাবেন, আমি গম্ভীর হয়ে জানান দিলাম, আমি আর যাবো না। যশোর থাকবো! তারপর তো অন্যজীবন, আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজন, আর সবার মতো আমারও তাই মনে হয়। তার আঙুল ধরেই আমার বর্ণিল শৈশব যশোরের পথে প্রান্তরে। আম্মু কিন্তু কিছুদিন পর বদলি হয়ে যশোরের কাছের এক স্কুলে চলে আসেন। আবার সেই আগের মতই মধ্যবিত্তের সর্বোচ্চ সুখী পরিবার ঘিরে থাকে আমাকে।
আমি খুব গর্ব করে বলতে চাই, আমার শৈশবকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না করে আমার আম্মু তার পড়াশোনা ও শিক্ষকতা চালিয়ে গেছেন সমানতালে। যশোর, খুলনায় আঞ্চলিক পর্যায়ে একাধিকবার তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হয়েছেন, তার স্কুল মডেল হিসেবে স্বীকৃত পেয়েছে, বরেণ্য অনেকেই তার স্কুল পরিদর্শনে গেছেন।
পঁচিশ বছর আগে আম্মুর আঁচল ধরে তার সঙ্গে স্কুলে যেতে চাওয়ার জন্য হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকা আমাকে দেখে তার কতটা সহানুভূতি হতো জানিনা। তবে এটা জানি, তিনি তার সবটুকুই নিঃস্বার্থভাবে করে গেছেন আমার জন্য, আমাদের জন্য। তার প্রভাব কতটুকু আমার মধ্যে? উত্তর খুঁজে পাই না। যতই চাকচিক্যের আলো ফেলে দেখতে যাই সেই স্মৃতি, অস্পষ্টভাবে মনে আসে সব। তার মাঝে কেবলই অনুপ্রেরণা আর উষ্ণ কোনো এক মায়ার বাঁধন।