স্বপ্নের পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন আইনজীবীরা
করোনার কারণে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ। স্বপ্নের পেশা ছেড়ে কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অন্য পেশায়। এ কাতারে রয়েছেন আইনজীবীরাও। আদালত বন্ধ থাকায় ঘরে বসে আছেন তারা। জমানো টাকা ভেঙে চালাতে হচ্ছে সংসার। আর যারা নবীন, যে স্বপ্ন নিয়ে আইন পেশায় এসেছেন, তাদের সেই স্বপ্ন যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন বিচারপ্রার্থীরা। বিশেষ করে ছোট ছোট অপরাধে হাজতি আসামি হিসেবে যারা আটক হয়েছেন, দীর্ঘদিন শুনানি না হওয়ায় তাদের মুক্তি মিলছে না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হলেও ভার্চুয়াল আদালত সচল করা উচিত। তা না হলে আদালত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন তারা।
জানা যায়, করোনার কারণে গত বছরের (২০২০ সাল) ২৬ মার্চ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আদালতের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ সময়ে শুধুমাত্র সদ্য গ্রেফতার হওয়া আসামিদের রিমান্ড ও জামিন শুনানিসহ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতি আসামিদের ভার্চুয়াল জামিন শুনানি চলে। বাকি সবকিছু বন্ধ ছিল। চলতি বছরের (২০২১ সাল) মার্চের মাঝামাঝি থেকে দেশে ফের করোনার সংক্রমণ বেড়ে যায়। ৫ এপ্রিল থেকে আদালতের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবারও শুধু হাজতি আসামিদের ভার্চুয়াল জামিন শুনানি চলে। পরবর্তীতে করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেলে গত ১ জুলাই থেকে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে। বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের বিচারিক কার্যক্রম।
এমন পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়েন নবীন আইনজীবীরা। তাদেরই একজন খালিদ হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের শেষের দিকে আইনজীবীর সনদ পাই। মাঝের এক বছর কাজগুলো গুছিয়ে নিই। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুর দিকে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় আট মাস আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে। শুধু আমি নই, বেশিরভাগ আইনজীবীর অবস্থা ভালো নয়। কারণ তাদের একমাত্র কর্মস্থল আদালত। সেটাই যদি বন্ধ থাকে তাহলে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো থাকি কী করে?
‘না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এভাবে আদালত বন্ধ থাকলে এ পেশায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার কথা ভাবছি। কথাবার্তাও ফাইনাল। শুধু আমি নই, আমার মতো নবীন অনেকে এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছেন।’
আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিচার পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে ভার্চুয়াল হলেও আদালত খুলে দেওয়া উচিত। এভাবে বন্ধ থাকলে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন।’
আইনজীবী সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এ পেশায়। এমন সংকটের মুখে কখনও পড়তে হয়নি। ইচ্ছা করলেও এখন অন্য পেশায় যেতে পারছি না। গত বছর চার মাস বন্ধ ছিল আদালত। চলতি বছরও (২০২১ সাল) চার মাস হতে চলল। এভাবে চলতে থাকলে আমাদেরও টিকে থাকা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, বিচারপ্রার্থীরাও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন। জাতীয় স্বার্থে যেভাবে ব্যাংক ও শিল্পকারখানা খুলে রাখা হয়েছে, একইভাবে হাজতি আসামিদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে অন্তত ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করা জরুরি।
আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমান বলেন, করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছর (২০২০ সাল) চার মাস বন্ধ থাকার পর আদালত খুলে দেওয়া হয়। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল থেকে ফের লকডাউন দেয় সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয় আদালতের কার্যক্রম। তিন মাসেরও বেশি সময় আদালত বন্ধ থাকায় আইনজীবীরা এখন চরম হতাশার মধ্যে দিন পার করছেন। অনেকে এ পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকাই এখন দায় হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা মাস শেষে বেতন পান। আমাদের তো মাসিক বেতন নেই। জীবিকার তাগিদে মানবিক এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে চাচ্ছেন অনেকে। শুধু আমাদের কথা নয়, বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সরকারের উচিত বিচারক ও আইনজীবীদের দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় এনে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা। কারণ বিনা বিচারে অনেক হাজতি আসামিকে জেলে থাকতে হচ্ছে। যেটা অত্যন্ত অমানবিক।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইকতান্দার হোসাইন হাওলাদার বাপ্পী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে পরিবার নিয়ে একধরনের অবরুদ্ধ অবস্থায় আছি। তারপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের বিধিনিষেধ মেনে চলছি। তবে আমরা চাই আদালতের কার্যক্রম একেবারে বন্ধ না রেখে গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরি বিষয়গুলো ভার্চুয়ালি করা হোক। তা না হলে সাধারণ ও অসহায় মানুষ বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আইনের সহায়তা পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকের আছে। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা উচিত নয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু আদালত নয়, করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ আছে। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের অর্থনৈতিক সংকট চলছে। করোনার সংক্রমণ রোধে সবাইকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। আর যদি করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যেসব বিধিনিষেধ দিয়েছে তা আমাদের প্রতিপালন করা উচিত।
বিচারব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আদালত বন্ধ থাকলেও ভার্চুয়ালি কাজ চলছিল। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ায় সরকার জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব বন্ধ রাখতে বলেছে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আশা করি সরকার আদালতও খুলে দেবে। আদালত খুললে ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা যাবে। ওই সময় পর্যন্ত আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।’
টিএইচ/এমএআর/