চতুর্থ-পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র ধ্বংস করা হয়
প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রবীর নিয়োগী বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ও পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আয়োজনে বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম স্মারক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে তিনি একক বক্তা ছিলেন।
প্রবীর নিয়োগী তার বক্তব্যে আইনের শাসনের তাত্ত্বিক ও মতবাদিক ভিত্তি এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, আইনের শাসনের মূলনীতি হলো, সব নাগরিকের জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য এবং এটি নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিখ্যাত আইনজ্ঞ এ ভি ডাইসির তত্ত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আইনের শাসন তিনটি মৌলিক উপাদান নিয়ে গঠিত— স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগ বন্ধ করা, আইনের দৃষ্টিতে সবার সমতা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের শুরু থেকেই আইনের শাসনের গুরুত্ব উল্লিখিত হয়েছে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। প্রবীর নিয়োগী বলেন, সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে, যা আইনের শাসনের ভিত্তি।
বক্তব্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রবীর নিয়োগী বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আইনের শাসনের একটি অপরিহার্য উপাদান। তিনি উল্লেখ করেন, বিচারকদের সুরক্ষা, আর্থিক নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা বিচার বিভাগের কার্যকরী ভূমিকার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ও পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছে।
প্রবীর নিয়োগী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশের অবস্থানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, আইনের শাসন কেবল একটি আইনি কাঠামো নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটি প্রক্রিয়া।
এ আইনজীবী সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাকে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, প্রয়োজনীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে মূল সংবিধানের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ফিরে আসবে যা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করায় ভূমিকা রাখবে।
এ স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ দর্শক সারিতে বসে ছিলেন। এ ছাড়া বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মোহাম্মদ জিয়াউল করিম, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও দর্শক সারিতে বসে স্মারক বক্তৃতা শোনেন।
বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ট্রাস্ট ফান্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মেসবাহ-উস-সালেহীন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক অধ্যাপক মো. আবদুর রহিম।
উল্লেখ্য, বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিমের ছেলে তারেক ইব্রাহিম এবং মেয়ে জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ট্রাস্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তি, যিনি আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের বিচারপতি এবং আইনমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের আইনের ভিত্তি ও গণতান্ত্রিক নীতির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
এমএইচডি/এসএম