ভারত-বাংলাদেশ বন্দি জেলে বিনিময়েই আস্থা অর্জনের পদক্ষেপ শুরু?
ভারত আর বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড একে অপরের দেশে আটক মোট ১৮৫ জন মৎস্যজীবী বা জেলেকে নিজ দেশে ফেরত দিচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে এত বড় সংখ্যায় আটক হওয়া মৎস্যজীবী বিনিময় এর আগে ঘটেনি।
উভয় দেশই আটক হওয়া জেলে এবং অন্য বন্দী ফেরত দিয়েছে আগে ঠিকই, তবে একই দিনে দুই দেশে এভাবে বিনিময় হয়নি বলে নিশ্চিত করছেন ভারতের একাধিক কর্মকর্তা। ভারত ও বাংলাদেশের দুই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উভয় দেশে আটক মৎস্যজীবীদের তাদের ট্রলার-সহ আন্তর্জাতিক জল-সীমানায় নিয়ে যায় দেশ দুটির কোস্ট গার্ড বাহিনী। সেখানেই আটক মৎস্যজীবীদের বিনিময় চূড়ান্ত করা হয়েছে রোববার।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে থাকা বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় এই বিনিময় করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে মাছ ধরতে গিয়ে বাংলাদেশে আটক হওয়া ৯৫ জন মৎস্যজীবীকে এরপরে সাগর দ্বীপে নিয়ে আসা হবে। সোমবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে আটক মৎস্যজীবীদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবে প্রশাসন।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে এই পদক্ষেপকে পারস্পরিক আস্থা তৈরির ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে।
• জেল থেকে মৎস্যজীবীদের মুক্তি
পশ্চিমবঙ্গ আর ওড়িশার পারাদ্বীপের কারাগারে মোট ৯০ জন বাংলাদেশি মৎস্যজীবীকে মুক্তি দিয়ে তাদের প্রথমে পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়াতে ভারতীয় কোস্ট গার্ডের দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে জেল থেকে প্রথম ছাড়া পান দক্ষিণ ২৪ পরগণার ডায়মন্ড হারবার জেলে আটক থাকা ১২ বাংলাদেশি জেলে। তাদের ২৪ ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তারা বিবিসিকে তখন জানিয়েছিলেন, জেলেরা যে ট্রলারে করে মাছ ধরতে বেরিয়েছিলেন, সেই এফবি কৌশিক গত ১২ সেপ্টেম্বর ডুবে যায় এবং প্রাণে বাঁচতে সাঁতার কেটে তীরে এসে উঠেছিলেন।
সেটা ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমা এলাকা। প্রথমে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের মামলা করা হলেও সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু তারা দুর্ঘটনার শিকার, তাই তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, মামলা তুলে নেওয়া হবে।
সেই মোতাবেক ওই ১২ জন বাংলাদেশিকে মুক্তি দেওয়া হয়। তারা গত কিছুদিন কাকদ্বীপ থানার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ওড়িশার পারাদ্বীপে ভারতীয় কোস্ট গার্ড ৯ ডিসেম্বর দুটি বাংলাদেশি ট্রলার এফভি লায়লা-২ এবং এফবি মেঘনা-৫ বাংলাদেশি ৭৮ জন মৎস্যজীবীকে আটক করে আন্তর্জাতিক জলসীমার কাছে।
এই ৯০ জনকেই রোববার বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বঙ্গোপসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্ট গার্ড। অন্যদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত অক্টোবর-নভেম্বরে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের অপরাধে ৯৫ জন ভারতীয় মৎস্যজীবী ও তাদের ছয়টি ট্রলার আটক করে কোস্ট গার্ড।
বাগেরহাট ও পটুয়াখালী জেলা কারাগারে তারা আটক ছিলেন। তাদের সবাইকে গত ২ জানুয়ারি জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ভারতীয় ট্রলার-সহ মৎস্যজীবীদের বঙ্গোপসাগরে নিয়ে যায় ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
• দুই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২ জানুয়ারি এক বিবৃতি দিয়ে আটক ভারতীয় মৎস্যজীবীদের ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। তার পরের দিন ৩ জানুয়ারি দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল ঘোষণা দেন, ভারতে আটক বাংলাদেশি মৎস্যজীবীদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
দুই দেশের বিবৃতিতেই বলা হয়, একে অপরের দেশে আটক মৎস্যজীবীদের নিজের দেশে ফেরত দিচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, বেশ কয়েকটি বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে। প্রতিদিনই অগ্রগতি হচ্ছে।
অর্থাৎ আগে থেকেই মৎস্যজীবীদের মুক্তি দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছিল। দুই দেশের মধ্যে ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির কিছু কাজ করেন, এমন একটি ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সদস্য বিবিসিকে বলেছেন, ‘‘আমি নিজে ঠিক এই মৎস্যজীবীদের নিয়ে মধ্যস্থতায় ছিলাম না। তবে এটুকুই জানি যে দিল্লি আর ঢাকার মধ্যে এ ব্যাপারে সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়েই আলোচনা করে মুক্তির দিনক্ষণ ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হওয়ার পরই বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কেও উচ্চতম পর্যায় থেকেই বাংলাদেশি মৎস্যজীবীদের মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে জানানো হয়েছিল। সেই অনুযায়ী, ডায়মন্ড হারবার জেল থেকে মুক্তি পান ১২ বাংলাদেশি মৎস্যজীবী।
• ১ জানুয়ারি ঢাকার বৈঠক
নির্ভরযোগ্য সূত্রে বিবিসি জানতে পেরেছে, গত ১ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অফিসারদের একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে হাজির ছিলেন পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং সচিব মোহম্মদ জসিম উদ্দিন।
ওই বৈঠক থেকেই এরকম একটা ইঙ্গিত পান অন্য কর্মকর্তারা যে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপড়েন আর খুব বেশি এগোতে দেওয়া অনুচিত হবে। সম্পর্কের যাতে আরও অবনতি না হয়, সেই ইঙ্গিতও দেওয়া হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রটি থেকে জানা যায়।
ওই বৈঠকে যে ভিন্ন সুর শোনা গিয়েছিল, তারপরে সেদিনই বিকেলে পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন একটি মন্তব্য করেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত না পাঠালেও দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট হবে না। তৌহিদ হোসেনের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখা হয়েছিল, ‘‘শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা এবং ভারতের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক একসঙ্গে চলতে থাকবে। এতে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হবে না।’’
দুপুরের বৈঠক আর বিকেলে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে যে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, সেটিকেই পারস্পরিক আস্থা-বর্ধনের প্রয়াস বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। আবার দিল্লিতেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, দিল্লি-ঢাকা নিয়মিত যোগাযোগ আছে এবং নানা বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র থেকে বিবিসি জানতে পেরেছে, মৎস্যজীবীদের ফেরত দেওয়া ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ একাধিক বিষয়ে ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে আছে আগরতলায় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ভিসা কেন্দ্র ও সহকারী হাইকমিশনারের দপ্তর কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো ফের চালু করে দেওয়া হবে।
আবার ফারাক্কায় গঙ্গার পানির পরিমাপ নিতে একদল প্রকৌশলী বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছেন। ফারাক্কা নিয়ে যদি অদূর ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়, তাহলে সর্বশেষ তথ্য লাগবে। সেজন্যই প্রকৌশলীদের এই দলটি পানির পরিমাপের তথ্য সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে। বিবিসি বাংলা।
এসএস