ভারতের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে চীনা সহায়তায় সতর্ক বাংলাদেশ
চলতি মাসের শেষের দিকে চীন-নির্মিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের ইতিহাসে মাইলফলক এই সেতুটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে বেইজিংয়ের সঙ্গে এই কর্মকাণ্ডের মধ্যেও চীনের অর্থনৈতিক সহায়তার বিষয়ে সতর্কতার সাথেই হাঁটছে ঢাকা। সোমবার (১৩ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশের একটি সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, উচ্চ-গতির ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের বিষয়ে চীনা একটি প্রস্তাব বাতিল করেছে হাসিনা সরকার। চীন এই প্রকল্পটি বেশ আগ্রহের সঙ্গে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক ছিল বলেও জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, চীনা কোম্পানিগুলোকে দেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি দেওয়ার সময় ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থের কথা সতর্কতার সঙ্গে মাথায় রেখেছে বাংলাদেশ সরকার।
সম্প্রতি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে মুসলিম বিশ্বের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও তোপের মুখে পড়েছে দেশটি। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামি বিশ্বের অংশীদারদের শান্ত করার চেষ্টা করতে বাধ্য হয়েছে নয়াদিল্লি।
সংবাদমাধ্যম বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় দেড় ডজন মুসলিম দেশ ভারতের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। এসব দেশ ভারত ও বিজেপি সরকারের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দেশটিকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে।
তবে টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, বাংলাদেশ এমন কয়েকটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে একটি যারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিজেপির মুখপাত্রদের অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানায়নি।
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত শনিবার সফররত ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিনিধি দলকে বলেন, যারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ সরকার।
উল্লেখযোগ্যভাবে, একটি চীনা সংস্থা পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী সেতু নির্মাণ করলেও বাংলাদেশ গর্ব অনুভব করেছে যে, তারা চীন বা অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার কাছ থেকে কোনো ঋণ সহায়তা ছাড়াই এই সেতুর নির্মাণে অর্থায়ন করেছে।
পদ্মার খরস্রোতা পানির ওপর নির্মিত ৬ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ এই সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যে পূর্ণতা নিয়ে আসবে এবং সরকারি ধারণা অনুসারে, এতে করে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী এই সেতুটি নির্মাণে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে এরপরও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্য এটি এখন সন্তুষ্টির কারণ যে, এই সেতু ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত রেল ভ্রমণের সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা কমিয়ে বাংলাদেশকে ভারতের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে।
ভারতের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা ভারতের নিরাপত্তার ওপর এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব ফেলেনি। ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঋণ-টু-জিডিপি অনুপাত অনেক বেশি এবং এডিবি বা এমনকি জাপান থেকেও অনেক বেশি ঋণের প্রকাশ রয়েছে বাংলাদেশে।’
অনেকের মতে, বাংলাদেশ সম্ভবত শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত। আর সম্ভবত এই কারণেই ঢাকা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাকে যুক্ত করার জন্য ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উচ্চ-গতির ট্রেনে বিনিয়োগ আপাতত অপ্রয়োজনীয় হতে পারে।
অবশ্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পর প্রস্তাবটি নিয়ে আর এগিয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি এখনও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ চীন ঢাকা-চট্টগ্রামকে উচ্চ-গতির ট্রেনে যুক্ত করার এই প্রস্তাবটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করতে ঢাকাকে চাপ দিচ্ছে। এমনকি চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত সপ্তাহে এমওইউ স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
অন্যদিকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ দুই নেতার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে রাজধানী ঢাকা-সহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে ভারতের নিন্দা জানালেও বাংলাদেশ কেন সরকারিভাবে নিন্দা জানায়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, ‘যেখানেই ঘটুক না কেন’ নবীর (সা.) এই ধরনের অবমাননার নিন্দা বাংলাদেশ করে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভারতকে ‘অভিনন্দন’ জানাচ্ছে ঢাকা।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাসের মধ্যে ভারত সফরের কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বাংলাদেশে আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে সম্ভবত এই সফর হবে দুই সরকারের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের শেষ যোগাযোগ।
তবে সামনের এই জাতীয় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু বা বিশ্বাসযোগ্য হবে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জোর দিয়ে বলছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই কেবল তারা সেটাতে অংশগ্রহণ করবে।
অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র বলছে, (বিএনপির) এই দাবি মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। যদিও ভারত অবশ্যই হাসিনার ক্ষমতায় ফিরে আসায় কিছু মনে করবে না, তবে নয়াদিল্লি বিশ্বাস করে, ভারতের এবং বাংলাদেশের স্বার্থে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া উচিত। একইসঙ্গে এই নির্বাচন যেন আন্তর্জাতিক বৈধতা বর্জিত না হয়।
টিএম