পুরোনো রূপে ফিরছে হাসপাতালগুলো
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুতই বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। একইসঙ্গে হাসপাতালগুলোতেও পর্যায়ক্রমে রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। সবমিলিয়ে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো তার পুরোনো রূপে ফিরতে শুরু করেছে।
দেশে করোনা চিকিৎসায় সবচেয়ে ব্যস্ততম রাজধানীর চার হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। গত দুই সপ্তাহে হাসপাতালগুলোতে রোগী বেড়েছে দশগুণ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগত রোগীর সংখ্যা কম হলেও দিন দিন তা বাড়ছে। যেকোনো সময়ে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কায় নেওয়া হচ্ছে সবধরনের প্রস্তুতি। গত দুই বছরে সংকটকালীন অর্জিত অভিজ্ঞতা এবারও কাজে লাগাতে চায় হাসপাতালগুলো।
গত ১৫ জানুয়ারি তিন হাজার ৪৪৭ জন, ১৬ জানুয়ারি পাঁচ হাজার ২২২ জন, ১৭ জানুয়ারি ছয় হাজার ৬৭৬ জন, ১৮ জানুয়ারি আট হাজার ৪০৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এরপর গত ১৯ জানুয়ারি নয় হাজার ৫০০ জন এবং পরের দিন ১০ হাজার ছাড়ায় সংক্রমণ। ২১ জানুয়ারি সংক্রমণের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৩৪ জনে দাঁড়ায়
২০০ থেকে ১১ হাজারে করোনা সংক্রমণ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মূলত ২১ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। দুশোর ঘর পেরিয়ে যা এখন ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ১৪ জানুয়ারি চার হাজার ৩৭৮ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়।
১৫ জানুয়ারি তিন হাজার ৪৪৭ জন, ১৬ জানুয়ারি পাঁচ হাজার ২২২ জন, ১৭ জানুয়ারি ছয় হাজার ৬৭৬ জন, ১৮ জানুয়ারি আট হাজার ৪০৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এরপর গত ১৯ জানুয়ারি নয় হাজার ৫০০ জন এবং পরের দিন ১০ হাজার ছাড়ায় সংক্রমণ। ২১ জানুয়ারি সংক্রমণের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৩৪ জনে দাঁড়ায়।
রাজধানীর ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, রোববার হাসপাতালটিতে কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা ২৭৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ২১১ জন। শয্যা খালি ৬৪টি। ১০টি আইসিইউয়ের মধ্যে আটটিতেই রোগী ভর্তি। খালি রয়েছে দুটি। এছাড়া আইসিইউ সমতুল্য ১৫টি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে খালি আছে ১১টি।
রোববার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা ২৭৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ভর্তি ছিল ২১১ জন। শয্যা খালি ৬৪টি। ১০টি আইসিইউয়ের মধ্যে আটটিতেই রোগী ভর্তি। খালি রয়েছে দুটি। এছাড়া আইসিইউ সমতুল্য ১৫টি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে খালি আছে ১১টি
ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রোগীদের তেমন আনাগোনা নেই। চিকিৎসক-নার্সরাও অনেকটা অবসর সময় পার করছেন। এই হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা এক হাজার ৫৪টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ১০৬ জন। আইসিইউ শয্যায় ভর্তি ৩১ জন এবং এইচডিইউ শয্যায় ভর্তি ৭৫ জন।
এখানে ২১২টি কোভিড আইসিইউর মধ্যে খালি ১৮১টি। ২৮৮টি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে ১১৩টি খালি রয়েছে।
ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে রোগীদের তেমন আনাগোনা নেই। চিকিৎসক-নার্সরাও অনেকটা অবসর সময় পার করছেন। এই হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা এক হাজার ৫৪টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ১০৬ জন। আইসিইউ শয্যায় ভর্তি ৩১ জন এবং এইচডিইউ শয্যায় ভর্তি ৭৫ জন
একই চিত্র পাওয়া যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল (ইউনিট-২) ও বার্ন ইউনিটে। গত মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত তেমন রোগী দেখা না মিললেও সম্প্রতি পুরোনো অবস্থায় ফিরছে হাসপাতালটি। রোববার (২৩ জানুয়ারি) পর্যন্ত এই হাসপাতালের কোভিড সাধারণ শয্যায় ভর্তি রোগী ছিল ৩১১ জন। ৪৮৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে এখনও খালি রয়েছে ১৭৪টি।
এখানে ২০টি আইসিইউর মধ্যে খালি আছে ৪টি। ৪০টি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে ১৮টিই খালি রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ৪৮৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি রয়েছে ১৭৪টি। ২০টি আইসিইউর মধ্যে খালি ৪টি। ৪০টি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে ১৮টিই খালি রয়েছে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ৫৫১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে কোভিড রোগী ভর্তি মাত্র ৪৭ জন। ৩৬টি আইসিইউর মধ্যে ছয়টিতে রোগী ভর্তি। খালি আছে ৩০টি আইসিইউ। ২০টি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে ২০টিই খালি।
কর্তব্যরত চিকিৎসকরা যা বলছেন
ডিএনসিসি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যা কিছুটা বাড়তে থাকে। গত নভেম্বরে কোনো রোগী ছিল না বললে চলে। এখন প্রতিদিন গড়ে ডিএনসিসি হাসপাতালে ২৫ জনের মতো রোগী আসছেন। তাদের মধ্যে ৮-১০ জনকে ভর্তি করা হচ্ছে। আইসিইউ ও এইচডিইউ প্রয়োজন এমন রোগীদেরই আপাতত ভর্তি করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ৫৫১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে কোভিড রোগী ভর্তি মাত্র ৪৭ জন। ৩৬টি আইসিইউর মধ্যে ছয়টিতে রোগী ভর্তি। খালি আছে ৩০টি আইসিইউ। ২০টি এইচডিইউ শয্যার মধ্যে ২০টিই খালি
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোভিডে আক্রান্ত রোগীর চাপ বাড়ছে। পাশাপাশি নন-কোভিড রোগীর চাপও বেশ। তাই এই মুহূর্তে আমরা কোভিডের পাশাপাশি নন-কোভিডও রান করাচ্ছি।
তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় এই হাসপাতাল ডেডিকেটেড কোভিড ছিল, এখন যদি সংক্রমণের মাত্রা বেশি বেড়ে যায়, তাহলে আমাদের আগের জায়গায় ফিরে যেতে হবে। এজন্য আমরা প্রস্তুত আছি। যেকোনো মুহূর্তে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা কোভিডে ফিরে যেতে পারব।
আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই
এদিকে, দেশে করোনা সংক্রমণের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কম বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণ বাড়লেও আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। হাসপাতালে ভর্তি রোগী সংক্রমণ অনুপাতে বাড়েনি। এটি ভালো লক্ষণ। তবে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।
হাসপাতালে কম রোগী ভর্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের টিকা দেওয়ার যে কার্যক্রম চালু আছে, সেটি অত্যন্ত সফলভাবে এগিয়ে চলেছে। দেশবাসীর কাছে আমরা আহ্বান রাখতে চাই, যারা নিবন্ধন করেছেন এবং টিকার মেসেজ এসেছে কিন্তু টিকা নেননি, তারা দ্রুতই টিকা নিয়ে নিন। খুদে বার্তার জন্য যারা অপেক্ষয় আছেন, তারা যেন সেটি পেয়েই নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গিয়ে টিকা গ্রহণ করেন। কোনো অবস্থাতেই টিকা গ্রহণ না করে ঘরে বসে থাকা সমুচিত হবে না।’
হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের শতভাগ ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীদের শতভাগ ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এদিকে, ওমিক্রনে আক্রান্তদের উপসর্গ মৃদু হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি কম হতে হয় বলেও জানানো হয়েছে।
জেনেটিক্স ও মলিকিউলার বায়োলজির শিক্ষক ডা. লায়লা আরজুমান্দের নেতৃত্বে হওয়া এই গবেষণায় দেখা যায়, সংগৃহীত নমুনার হাসপাতালে যারা ভর্তি আছেন তাদের শতভাগ ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এই হাসপাতালের রোগী ছাড়াও গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত নমুনার ৯৯ ভাগই ছিল ডেলটা। এরপর গত বছরের ডিসেম্বর থেকে দেশে উপস্থিতি মেলে এখনকার দুশ্চিন্তা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের।
বিএসএমএমইউ-এর গবেষণায় দেখা যায়, গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংগৃহীত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সের ২০ ভাগ ছিল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের। গত ১০ দিনে গুণিতক হারে বেড়ে এটি উদ্বেগজনক পর্যায়ে গেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন গবেষকরা।
বর্তমানে সংক্রমণের ৭০ শতাংশই ওমিক্রন : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণের ৭০ শতাংশই ওমিক্রন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত দেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে নতুন করে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের ৭০ শতাংশই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। বাকি ৩০ শতাংশ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টে।
জাহিদ মালেক বলেন, সংক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে ৩৩ শতাংশ শয্যা ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে দুই হাজারের অধিক রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা সিটিতে এক হাজারের অধিক রোগী ভর্তি আছেন। পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে।
‘আমরা দেখছি, দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। তাই আগামী দুই সপ্তাহ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। বিপিএল, বইমেলা, বাণিজ্য মেলায় টিকার সনদ ও করোনা পরীক্ষার সনদ প্রদর্শন করে ঢুকতে হবে।
দেশে করোনার সবশেষ পরিস্থিতি
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৯০৬ জন। শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এখন পর্যন্ত দেশে ২৮ হাজার ২২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে; শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৫ হাজার ১৩৬ জনে। রোববার (২৩ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় ৩৫ হাজার ৫১টি। পরীক্ষা করা হয় ৩৪ হাজার ৮৫৪টি নমুনা। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ। মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ।
টিআই/এমএআর/