৩০ লাখ টাকার ভালভ প্রতিস্থাপন বিনামূল্যে দেশেই সম্ভব
অপারেশন মানেই ছুরি-চাকুর ব্যবহার। বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় সে ধারণা অনেকটাই পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ছুরি-চাকু ছাড়াই এখন সফল অপারেশন করে রোগীর জীবন বাঁচাচ্ছেন চিকিৎসকরা। দেশে দ্বিতীয়বারের মতো বুক না কেটেই দুই রোগীর ট্রান্সক্যাথেটার অ্যাওরটিক ভালভ রিপ্লেসমেন্ট (রক্তনালির ভেতর দিয়ে ভালভ প্রতিস্থাপন) করা হয়েছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউিট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের নেতৃত্বে গত ২৫ ও ২৬ অক্টোবর সফলভাবে এ অপারেশন সম্পন্ন হয়। ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিতে এটি বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় কৃতী ও গুণী এ চিকিৎসকের। একান্ত আলাপচারিতায় দেশে তুলনামূলক জটিল এ পদ্ধতিতে ভালভ প্রতিস্থাপনে সফলতা, এর সমস্যা ও সম্ভাবনা; পাশাপাশি ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা সাধারণ জনগণের জন্য সহজলভ্যসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : বুক না কেটে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করেছেন, বিষয়টি নিয়ে কিছু বলুন...
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার : গত ২৫ ও ২৬ অক্টোবর দেশে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দুই রোগীর অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ৬৫ বছরের এক পুরুষ ও ৮০ বছরের এক নারীর শরীরে সফলভাবে এ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি হাসপাতালটিতে প্রথমবারের মতো তুলনামূলক কম খরচে টিএভিআর চিকিৎসা চালু হয়। আমি মনে করি এ চিকিৎসা পদ্ধতি ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিতে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক।
ঢাকা পোস্ট : অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন মূলত কাদের জন্য? কোন ধরনের উপসর্গ থাকলে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করতে হয়?
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার : আপনারা জানেন আমাদের হার্ট একটি পাম্পিং অর্গান। পাম্প করেই এটি রক্ত শরীরে সঞ্চালিত করে। এর মধ্যে অনেকগুলো ভালভ আছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অ্যাওরটিক ভালভ। অ্যাওরটিক ভালভের মাধ্যমে আমাদের হার্ট থেকে শরীরে রক্ত সঞ্চালিত হয়। এখন কোনো কারণে যদি হার্টের এ ভালভ সরু হয়ে যায়, তখনই আমাদের সমস্যার শুরু হয়। বিশেষ করে হার্ট রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না। ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। এসব উপসর্গ দেখা দিলে দুই বছরের মধ্যে বেশির ভাগ রোগী মারা যান।
ঢাকা পোস্ট : এ রোগে কারা বেশি আক্রান্ত হন? ঝুঁকি কেমন?
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার : সাধারণত যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদের এ ভালভগুলো বয়সের কারণে ক্যালসিয়াম জমে সরু হয়ে যায়। তখনই এ রোগের সিম্পটম শুরু হয়। বাংলাদেশে এর গভীরতা সম্পর্কে যদি বলতে হয়, দেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার লোক এ রোগে ভুগছেন। এর ভয়াবহতা হলো- এ রোগে আক্রান্ত হওয়া ৮০ শতাংশ রোগীই দুই বছরের মধ্যে মারা যান। আরও ভয়াবহ সত্য হলো- ওভারিয়ান ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, এমনকি লাং ক্যান্সারের চেয়েও এ রোগের মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব এ রোগের চিকিৎসা করা উচিত।
ঢাকা পোস্ট : হার্টের ভালভ সরু হয়ে গেলে করণীয় কী, এর চিকিৎসা পদ্ধতি-ই বা কী?
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার : সরু হয়ে গেলে দ্রুত হার্টের ভালভ প্রতিস্থাপন করতে হবে। দুভাবে ভালভ প্রতিস্থাপন করা যায়। একটি হলো বুক কেটে। এ পদ্ধতিতে রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে বুকের হাড় কেটে করা হয়। প্রক্রিয়াটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং রোগীর পরিপূর্ণ সুস্থ হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। অপরটি হলো আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। বুক না কেটে, অজ্ঞান না করে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং কুঁচকি দিয়ে তা প্রতিস্থাপন করা হয়।
চিকিৎসকরা একটা বয়সের পর রোগীদের কাটা-ছেঁড়ার অস্ত্রোপচারে নিরুৎসাহিত করেন। অনেক চিকিৎসকও এ ঝুঁকি নিতে চান না। তাদের জন্য বুক না কেটে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন একটি যুগান্তকারী প্রক্রিয়া। এভাবে অস্ত্রোপচারে রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করতে হয় না, বুকের হাড় কাটতে হয় না। এমনকি অপারেশনের তিন দিনের মধ্যে রোগী হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যেতে পারেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দিতে পারেন। এসব কারণে বিশ্বে এ চিকিৎসাপদ্ধতি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : এ ধরনের জটিল কাজে আপনি এবং আপনার দল কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কী?
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার : দেশের বাইরে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ প্রযুক্তি আমদানিতে নানা ধরনের জটিলতা থাকায় ঠিকভাবে শুরু করা যাচ্ছে না। আমরা জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে এ উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে এ চিকিৎসা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে জনগণের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব, তাদের বড় একটা অংশকে আমরা এ সেবা দিতে পারব।
যদিও এখন এটা খুবই ব্যয়বহুল। তবে সরকার যদি সহযোগিতা করে, বিশেষ করে ভালভগুলো ফ্রি দেয় বা সর্বনিম্ন খরচে যদি আনার ব্যবস্থা করে অথবা যন্ত্রপাতিগুলো যদি দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তাহলে খুবই কম খরচে; এমনকি বিনা খরচে এ চিকিৎসা জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে করা সম্ভব। আমার টিম সফলভাবে এটা করতে সক্ষম।
ঢাকা পোস্ট : দেশে বর্তমানে অ্যাওরটিক পদ্ধতিতে ভালভ প্রতিস্থাপনে কেমন খরচ? দেশের বাইরে কেমন...
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার : ভারতে অ্যাওরটিক পদ্ধতিতে ভালভ প্রতিস্থাপন করতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। সিঙ্গাপুরে করলে এক কোটির বেশি টাকা খরচ পড়ে। কিন্তু আমরা জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল প্রথমদিকে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করেছি মাত্র পাঁচ লাখ টাকায়। এখন ১০ লাখ টাকার মতো খরচ হচ্ছে।
অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপনে খরচ বেশি হওয়ার কারণ হলো- প্রথমত, এ ভালভগুলো সারাবিশ্বেই একটি ব্যয়বহুল ডিভাইস। দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতিতে ভালভ প্রতিস্থাপনের জন্য অনেক যন্ত্রপাতি আমাদের প্রয়োজন হয়, যা দেশে সহজলভ্য নয়। এক্ষেত্রে সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, যদি এসব ভালভ বিনামূল্যে আমদানি করে দেয়, একইসঙ্গে ভালভ প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করে, তখন আমরা ন্যূনতম খরচে অথবা বিনামূল্যেই রোগীদের এ চিকিৎসাসেবা দিতে পারব।
আমাদের দেশে অনেকের এ চিকিৎসা নেওয়ার সক্ষমতা নেই। যারা বড়লোক, তাদের অনেকেই দেশের বাইরে গিয়ে এ চিকিৎসা নিয়ে আসেন। আমাদের গরিব জনগণ এ চিকিৎসা পান না। আমি এ থেরাপি দেশেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই। দেশের গরিব মানুষরা যেন এ সেবা নিতে পারেন সে ব্যবস্থা সরকার করে দিলে আমরা এ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারব।
ঢাকা পোস্ট : যাদের অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের অবস্থা কেমন?
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার : আমি গত ২৫ ও ২৬ অক্টোবর এ পদ্ধতিতে দুজন রোগীর ভালভ প্রতিস্থাপন করি। তারা এখন সুস্থ আছেন। তাদের মধ্যে একজনের বয়স ৮০ বছরেরও বেশি। ওনার ছেলেও একজন চিকিৎসক। তারা জানান, আগে ওই রোগী সারারাত ঘুমাতে পারতেন না। সারাক্ষণ শ্বাসকষ্ট হতো, হাঁটতে পারতেন না, হাঁটলে দম আটকে যেত। এসব উপসর্গ নিয়েই তারা আমার কাছে আসেন। তখন ভালভ প্রতিস্থাপনের বিষয়ে উনার ছেলেকে বললে তারা রাজি হন।
ভালভ প্রতিস্থাপনের পর ওই রোগী এখন স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমাতে পারছেন, স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন। সবমিলিয়ে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন তিনি।
টিআই/ওএফ/এমএআর