ডা. কামরুল : বিনা পারিশ্রমিকে করেছেন এক হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন
একজন মানবিক চিকিৎসক। শুধু কি মানবিক? শল্যচিকিৎসক হিসেবে এক হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন, তাও নামমাত্র মূল্যে। অতিমারির মধ্যেও সেবা দিয়ে গেছেন। নিজের হাতে গড়া সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালে এ সময়ে তিনশর অধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন।
তিনি আর কেউ নন, প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। দেশে যখন অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে না পারা অসংখ্য কিডনি রোগী অনিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছিলেন ঠিক তখনই অর্থাৎ ২০০৭ সালে নামমাত্র মূল্যে কিডনি সংযোজনসহ এ রোগের চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠা করেন সিকেডি হাসপাতাল।
করোনা সংক্রমণের সময় আক্রান্তের ভয়ে দেশে যখন কিডনি চিকিৎসা প্রায় স্থবির ছিল, কিডনি রোগীদের দুর্দশা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল; জীবনবাজি রেখে তখনও তিনি চিকিৎসাসেবায় ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী।
মাত্র দুই লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ, যিনি কিডনি দেবেন এবং যিনি গ্রহণ করবেন; তাদের জন্য। এ প্যাকেজে রয়েছে ১৫ দিনের মেডিসিন ও সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ। এছাড়া ১৫ দিন পরও যদি তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তবে তাকে থাকতে হবে কিডনি আইসিইউতে। এক্ষেত্রেও কোনো খরচ লাগে না
সিকেডি হাসপাতালে বিকল কিডনি রোগীদের জন্য অল্প খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করেন মানবিক এ চিকিৎসক। নিজেই কিডনিদাতা ও গ্রহীতার অপারেশন করেন। বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক নেন না। শুধু অপারেশনই নয়, প্রতিস্থাপন-পরবর্তী রোগীর সব চিকিৎসাসেবা বিনা পয়সায় করেন তিনি।
সিকেডি হাসপাতালে অপারেশন-পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বিনামূল্যে করার ব্যবস্থা করেছেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সফলভাবে এক সহস্রাধিক রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। সাফল্যের হার শতকরা ৯৫ ভাগ, যা আন্তর্জাতিকপর্যায়ের সমকক্ষ।
কৃতী এ শল্যচিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। স্বল্প সময়ের আলাপচারিতায় উঠে আসে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামের জীবনের নানা গল্প, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব এবং দেশে কিডনি চিকিৎসার নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : হাজারেরও বেশি মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। আপনার অনুভূতি জানতে চাচ্ছি...
ডা. কামরুল ইসলাম : অনুভূতি তো অবশ্যই ভালো। তবে আমাদের কাছে এটা নিয়মিত কাজ। বিষয়টা আমার কাছে খুবই সিম্পল (স্বাভাবিক) মনে হয়। প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচটি কিডনি প্রতিস্থাপন করি। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা ভালোই লাগে।
এছাড়া যখন বিভিন্ন দিক থেকে কাজের উৎসাহ পাই, মানুষ আমাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করে; তখন আরও ভালো লাগে। বড় বিষয় হলো আমি নিজে অন্তত জানি, আমি ভালো কাজ করছি, মানুষের জন্য কিছু করছি। এটাই আমার কাছে ভালো লাগার বিষয়।
ঢাকা পোস্ট : অসংখ্য গরিব-অসহায় মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। বিষয়টা আপনার কাছে কেমন লাগছে?
ডা. কামরুল ইসলাম : বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়টা এখন আর ওভাবে মানুষকে বলি না। বলতে পছন্দও করি না। আমার ভালো লাগে তাই করি। দেখা গেল এখন পর্যন্ত এক হাজারের অধিক কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছি। একটা রোগীর কাছ থেকেও নিজের জন্য একটা পয়সা নিইনি। এগুলো মানুষ শুনলে অবাক হয়, অনেকে বিশ্বাসও করতে চান না। মানুষকে বলে কী লাভ?
আমাদের এখানে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট-পরবর্তী যে ফলোআপগুলো হয়, সবগুলোই বিনামূল্যে করি। এমনও রোগী আছে যারা ১০ বছর ধরে আমাদের এখানে আসছে, প্রতি মাসে ফলোআপ করাচ্ছে। শুধু ফলোআপই নয়, আমরা তাদের সবধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বিনামূল্যে করে থাকি।
ঢাকা পোস্ট : ভারতে এ ধরনের চিকিৎসায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা খরচ হয়। নামমাত্র খরচে কীভাবে আপনি এটা করেন?
ডা. কামরুল ইসলাম : রোগী ও ডোনার, দুটা অপারেশনই আমি নিজে করি। অপারেশন খরচ আমি গ্রহণ করি না। ফলে রোগীর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা সেভ হয়। আমাদের সিকেডি হাসপাতাল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। মানুষকে সেবা দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের কাছে অর্থ নয়, সেবাই প্রথম।
ঢাকা পোস্ট : দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এতকিছু করছেন, বিনিময়ে কী পাচ্ছেন?
ডা. কামরুল ইসলাম : আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই দেশের বাইরে চলে গেছে। হিসাব করলে আমাদের ব্যাচের ২৫ থেকে ৩০ জন ইউরোপ-আমেরিকায় বিলাসী জীবনযাপন করছে। আমিও অনেক অফার পেয়েছি, কিন্তু এ মাটি আমাকে ছাড়েনি। আমার বাবা এ দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। এ দেশের মাটিতে বাবার রক্ত লেগে আছে। আমিও চেষ্টা করছি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করার।
আমি ছিলাম আমার বিভাগের সেরা ছাত্র। নিজের চিন্তা করলে তাদের থেকেও আমার ভালো কিছু করার সুযোগ ছিল। এখানে আটকে আছি আমার দেশের টানে, বাবার রক্তের টানে। আমার মা আছে, বাবা শহীদ হওয়ার পর তিনি আমাকে কষ্ট করে মানুষ করেছেন। আমি কীভাবে নিজের ভাবনায় দেশে ছেড়ে যেতে পারি!
আলহামদুলিল্লাহ, না পাওয়া নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমি আমার দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এ জন্যই আমার থাকা, এ জন্যই কষ্ট করা।
ঢাকা পোস্ট : কিডনি সংযোজনে সফলতার হার কেমন?
ডা. কামরুল ইসলাম : সিকেডি হাসপাতালে কিডনি সংযোজনের সাফল্যের হার শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। কিডনি সংযোজনের পাঁচ বছর পর বেঁচে থাকে শতকরা ৮০ ভাগ রোগী এবং ১০ থেকে ১৫ বছর বেঁচে থাকে শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ রোগী। তবে অনেক দরিদ্র রোগী দামি ওষুধ নিয়মিত সেবন করে না। ফলে তাদের কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় এবং তা রিজেকশন হয়ে যায়। কিছু রোগী দুই থেকে তিন বছর পর না জেনে ওষুধ বন্ধ করে দেয়। এ কারণেও সংযোজিত কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।
ঢাকা পোস্ট : সিকেডি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে যদি বলতেন…
ডা. কামরুল ইসলাম : সিকেডি হাসপাতালে স্বল্প মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। মাত্র দুই লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ, যিনি কিডনি দেবেন এবং যিনি গ্রহণ করবেন, তাদের জন্য। এ প্যাকেজে রয়েছে ১৫ দিনের মেডিসিন ও সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ। এছাড়া ১৫ দিন পরও যদি তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তবে তাকে থাকতে হবে কিডনি আইসিইউতে। এক্ষেত্রেও কোনো খরচ লাগে না।
সিকেডি হাসপাতালে কিডনি সংযোজনের সাফল্যের হার শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। কিডনি সংযোজনের পাঁচ বছর পর বেঁচে থাকে শতকরা ৮০ ভাগ রোগী এবং ১০ থেকে ১৫ বছর বেঁচে থাকে শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ রোগী। তবে অনেক দরিদ্র রোগী দামি ওষুধ নিয়মিত সেবন করে না। ফলে তাদের কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় এবং তা রিজেকশন হয়ে যায়
এর বাইরে পরীক্ষার খরচ হয় লাখ টাকার। এ খরচ দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। বাইরের যেকোনো দেশের চাইতেও অনেক কম। উন্নত বিশ্বের মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় আমাদের এখানে।
এক নজরে ডা. কামরুল ইসলাম
পাবনার ঈশ্বরদীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. আমিনুল ইসলামের ছেলে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস এবং ২০০০ সালে বিএসএমএমইউ থেকে ইউরোলজিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে তিনি এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ইউরোলজি সোসাইটি স্বর্ণপদক প্রদান করে।
টিআই/এমএআর/