করোনা প্রতিরোধে মানতে হবে তিন নিয়ম
দেশের করোনা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুর রেকর্ডও হচ্ছে দৈনিক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতির মূল কাজ হলো সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ রোগীর সংখ্যা কমাতে না পারলে হাসপাতালের শয্যা যতই বাড়ানো হোক তা এক সময় রোগীর চাপ সামোতে পারবে না।
দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি, করোনার নতুন ধরন, টিকাসহ নানা বিষয়ে ঢাকা পোস্ট-এর মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : দেশে তো সংক্রমণ আবারও বাড়ছে, এ নিয়ে কিছু বলুন।
ডা. মুশতাক হোসেন : দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। শুরুতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বেশি ছড়ালেও এখন ধীরে ধীরে সারাদেশেই বন্যার পানির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট অনেকটাই দায়ী। তবে এর সঙ্গে আমাদের সচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও দায়ী।
ঢাকা পোস্ট : নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টে টিকা কতটা কার্যকরী হবে বলে মনে করেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : ভ্যারিয়েন্টগুলো টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের সহজেই অসুস্থ করতে পারে না, তবে সংক্রমিত করতে পারে। যারা মৃদু লক্ষণ যুক্ত হয় তাদের, কিন্তু আইসিইউতে যেতে হয় না। যদি সেই টিকা নেওয়া ব্যক্তির আগে থেকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে কিংবা ওজন বেশি হয়, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা একটু বেশি। টিকা নেওয়ার পর আক্রান্ত হলে তাদের হাসপাতালে যেতে হতেও পারে, তবে তাদের আইসিইউ লাগবে না। ভ্যারিয়েন্টগুলোর কারণে টিকা গ্রহণকারীরা হয়তো শতভাগ সুরক্ষা পাচ্ছেন না, সেখানে একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে মৃতের হার কিন্তু কম। টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তির যদি অন্য কোনো রোগ না থাকে তাহলে কিন্তু সে ব্যক্তি একেবারে সুরক্ষিত। তবে মৃদু লক্ষণ যুক্ত অসুস্থতা থেকে টিকা এখনও সুরক্ষা দিতে পারবে না। পরবর্তী টিকার যে উন্নয়ন হবে, হয়তো তখন সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
ঢাকা পোস্ট : আমাদের দেশে তো ফাইজার ও সিনোফার্মের টিকা প্রয়োগ শুরু হচ্ছে। এ দিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। এ অবস্থায় টিকা আমাদের কতটা সুরক্ষিত করবে?
ডা. মুশতাক হোসেন : আমরা জানি ফাইজার ও সিনোফার্মের দুটি টিকাই ভালো কার্যকরী। তবে টিকা নেওয়ার পর নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো হয়তো টিকা গ্রহণকারীকে মৃদু লক্ষণ যুক্ত অসুস্থ করতে পারবে। তবে গুরুতর অসুস্থ করতে পারবে না। টিকা অবশ্যই মানুষের গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : করোনার সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের বসবাস, তবুও আমরা এর সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। এক্ষেত্রে মূল সমস্যা কী মনে করছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : দেশে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন, আবার অনেকেই মানছেন না। যারা মানছেন না, তাদের কারণে যারা মানছেন তাদের ফলটা কার্যকরী হচ্ছে না। তাই আমাদের সবাইকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। আর এটা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। এখনও আমাদের হাতে সময় আছে। দেশে এখনও ভারতের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, নেপালের মতো সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়নি, তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমাদের এখনও সময় আছে, সংক্রমণ প্রতিরোধে অবশ্যই আমাদের তিনটি নিয়ম মেনে চলতে হবে। সরকার, সামাজিক সংগঠন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রতিটি নাগরিককেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলেই পারব, যেমনটি এর আগেও আমরা পেরেছি। দেশে প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে সবাই মিলে চেষ্টা করেছে, ফলে সংক্রমণটা দ্রুত উঠেও আবার নেমে গিয়েছিল।
করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউটা নামতে অনেকটা সময় লেগেছিল। তবে নভেম্বরে ছোট যে দ্বিতীয় ঢেউটি এসেছিল, সেটি আবার দুই সপ্তাহের মধ্যেই নেমে গেছে। তৃতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে এখনো সংক্রমণের গতি ধীর আছে। সেক্ষেত্রে সবাই যদি আমরা যথাযথ নিয়ম মেনে চলি, তাহলেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ঢাকা পোস্ট : আমাদের চোখের সামনেই সীমান্ত থেকে এখন সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে গেছে। অথচ সরকার সীমান্তে লকডাউনও দিয়েছিল। তবুও দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার কী কারণ মনে করছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : লকডাউনের অন্যতম কারণ হলো মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু আমাদের সীমান্তবর্তী জেলায় লকডাউন দেওয়া হলেও যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ ছিল শুধুমাত্র সংক্রমণ যেখানে বেশি সেখানেই। পাশের এলাকায় করা হয়নি, ফলে পাশের এলাকায় দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে প্রায় সারাদেশে। কাজেই সংক্রমিত এলাকার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী এলাকাও বাফার জোনের মতো করে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে স্থায়ীভাবে সংক্রমণ ওই জায়গাতেই আটকে থাকবে। কিন্তু এখন সেটি ধীরে ধীরে সারাদেশেই বন্যার পানির মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
ঢাকা পোস্ট : অনেকেই বলেছে দেশে এখনও দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, আপনি বলছেন তৃতীয় ঢেউ... আমরা কীভাবে বুঝব দ্বিতীয় নাকি তৃতীয় ঢেউ?
ডা. মুশতাক হোসেন : তৃতীয় ঢেউ বলা হবে যদি সংক্রমণ পরপর তিন/চার দিন চার হাজারের মধ্যে চলে আসে। কারণে প্রথম ঢেউয়ে আমরা সর্বোচ্চ চার হাজার পেয়েছিলাম। সেই প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে বলা যায় এখন তৃতীয় ঢেউ চলছে। পাশাপাশি শনাক্তের হার যদি বিশের মধ্যে চলে আসে, তাহলে আমরা তৃতীয় ঢেউ ধরে নিতে পারি। এখন দেশে সংক্রমণ বিশের মধ্যেই আছে।
আপনি যদি সংক্রমণের চিত্র দেখেন, শনাক্তের হার পাঁচে নেমে আসে তাহলে বুঝা যাবে একটি ঢেউ শেষ হয়েছে। কিন্তু সব সময় তো আর আমাদের ধারণা অনুযায়ী হয় না, এবার পাঁচের জায়গায় সাত হয়েছে।
এবারের শনাক্তের হার সাতের নিচে নামেনি। সাতের নিচে না নামলেও যেহেতু এখন সংক্রমণের দিক থেকে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার বিশের ওপরে চলে গেছে। দৈনিক শনাক্ত চার হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন তো নিশ্চিতভাবেই এটিকে তৃতীয় ঢেউ বলতে হবে। গত ঈদুল ফিতরের পর থেকেই দেশে তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। আর এখন সংক্রমণ সর্বোচ্চ চূড়ার দিকে যাচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরার জন্য এই মুহূর্তে করণীয় কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় তিনটি। প্রথমটি হচ্ছে- রোগী শনাক্তকরণ। এর মাধ্যমে সবাইকে ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ তাদের চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। এদের মধ্যে যারা হাসপাতালে রয়েছে, তারা তো চিকিৎসার মধ্যেই রয়েছে। আর যারা হাসপাতালে নেই, বাসায় আছে তাদের টেলিমেডিসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যেন তারা বিপদ সংকেতটা বুঝতে পারে যে কখন হাসপাতালে যেতে হবে। তাদের আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। আর যাদের আইসোলেশনে থাকতে সমস্যা, যাদের কামাই-রুজিতে অসুবিধা হয়, তাদের সহায়তা দিতে হবে যেন তারা ঘরে থাকতে পারে।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে- সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে এলাকাভিত্তিক কমিটি করে দিতে হবে। যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকেই দায়িত্ব নিয়ে তদারকি করতে হবে।
আর তৃতীয়ত হচ্ছে- টিকাদান। যেহেতু এই মুহূর্তে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টিকা নেই, এখন থেকেই ক্যাম্পেইন করতে হবে। টিকা আসা মাত্রই যেন সবাই টিকা নেয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এই তিনটি পদ্ধতিতেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সংক্রমণ ভ্যারিয়েন্টের কারণেই বাড়ুক বা অন্য যেকোনো কারণেই বাড়ুক, আমাদের অবশ্যই এটি টেনে ধরতে হবে।
ভাইরাস পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। যেটি সর্বশেষ আসে, সেটিই সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পৃথিবীর একশর বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই তিনটা পদ্ধতি মেনে চলছে, সেখানে সংক্রমণ কম। প্রতিটি দেশেই সংক্রমণ ছড়াবার নিয়ম যেমন এক, তেমনি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার নিয়মও একই। এ ক্ষেত্রে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আগের চেয়ে এটি দ্রুত ছড়ায়। যেসব রোগী হাসপাতালে যায়, তাদের কষ্টটা বেশি হয়। কিন্তু এটা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এই ৩টি নিয়মেই।
টিআই/ওএফ/এসএম