বাম চোখের বদলে চিকিৎসা ডান চোখে, দুঃখ প্রকাশ করে ফের অস্ত্রোপচার
চোখে ময়লা জাতীয় কোনো বস্তুর অস্তিত্ব টের পেয়ে হাসপাতালে শিশুর চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু অস্ত্রপচারের সময় ঘটে বিপত্তি। দেড় বছর বয়সী শিশু ইর্তিজা আরিজ হাসানের বাম চোখের বদলে ডান চোখে অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসক। পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করে আবারও বাম চোখে অস্ত্রোপচার করেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং স্ট্র্যাবিসমাস সার্জন ডা. শাহেদারা বেগম।
বিজ্ঞাপন
চিকিৎসায় গাফিলতির এমন ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর ধানমন্ডির বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটে।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) রাতে চিকিৎসকের খামখেয়ালির বলি হয় শিশু ইর্তিজা। ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিশুর চাচা মাহফুজ নাফি। পরে হাসপাতালটিতে খোঁজ নিয়ে অভিযোগের সত্যতা পায় ঢাকা পোস্ট।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
একটা চোখ আগেই লাল ও ফোলা ছিল, তারপরও কেন ভুল?
বিজ্ঞাপন
পরিবারের সদস্যরা জানান, গত মঙ্গলবার বিকেলে দেড় বছরের ইর্তিজার চোখের সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ আই হসপিটালে যান তারা। বাম চোখের মধ্যে ময়লা জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেন চিকিৎসক। পরে অপারেশনের জন্য এনেসথেসিয়া দিয়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে নেওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু সেখান থেকে বের করার পর পরিবারের সদস্যরা দেখতে পান বাম চোখের জায়গায় অপারেশন করা হয়েছে ডান চোখে।
শিশুর চাচা মাহফুজ নাফি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আরিজকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়েই বাম চোখটি তুলনামূলক ফোলা এবং ভেতরে লাল হয়েছিল। সেখানে নেওয়ার পরও তারা আমাদের জানিয়েছে বাম চোখের ভেতরে বাগ্স আছে। তারপরও কেন শুধু-শুধু ডান চোখে অপারেশনটি করা হলো? অথচ ডান চোখে তার কোনো সমস্যাই ছিল না। এখন তারা বলছে ডান চোখেও সমস্যা ছিল। বিষয়টি কি তাহলে তাদের চোখেই পড়েছিল? আর পড়লেই কেনই বা আমাদের না জানিয়ে ডান চোখে অপারেশনে করা হলো?’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেহেতু তারা ডান চোখে অপারেশন করেই ফেলেছে, তাই বলছে ডান চোখেও সমস্যা ছিল। এটা অবশ্যই তাদের মারাত্মক ভুল। এজন্য আমরা আইনের আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আরও পড়ুন
চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চায় শিশুর মা-বাবা
শিশু আরিজের মা ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, ‘অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আমি আর আমার স্বামী অপেক্ষায় ছিলাম। আরিজকে যখন ওখান থেকে বের করল, তখন জ্ঞান ফিরবে ফিরবে এমন ভাব ছিল। তার একটু পরে ওর বাবা কোলে নিয়ে বলছে, ওর তো ডান চোখে অপারেশন হয়েছে কিন্তু বাম চোখ অপারেশন করার কথা ছিল। এমন তো হতে পারে না! আজকে আমার শিশুর বড় কিছু হয়ে গেলে কী তারা চোখ ফেরত দিতে পারত?’
এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়ে শিশুর বাবা মাহমুদ হাসান বলেন, ‘আজ আমাদের সঙ্গে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু এটা যদি বড় কোনো অপারেশন হতো তাহলে আমাদের হয়ত এখন ছেলেকে নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দৌড়াদৌড়ি করতে হতো। এ ঘটনার সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
অন্যান্য স্টাফদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি
অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. শাহেদারা বেগম শুরুতে অন্যান্য স্টাফদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন।
ডা. শাহেদারা বেগম বলেন, ‘ভুলটা আসলে অন্যান্য স্টাফদের জন্য হয়েছে। বাচ্চাটিকে তারা অপারেশন টেবিলে যেভাবে তুলেছে, আমিও সেভাবে বসে গিয়েছি। তারপর চোখের পাতা উল্টাতেই দেখি একটা আইল্যাশ (পাপড়ি) আছে। যদি আমি ডান চোখে সেটি না পেতাম, তাহলে তো অবশ্যই বাম চোখ উল্টিয়ে দেখতাম। যেহেতু ওই চোখেও পেয়েছি তাই সেটি বের করে দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুটির দুটি চোখেই চুল পাওয়া গেছে। প্রথমে ডান চোখ থেকে চুল বের করে আনার পর রোগীর স্বজনরা বলছে যে বাম চোখে সমস্যা ছিল। তখন আমি আবার বাম চোখ পরিষ্কার করে দিয়েছি। এটি আমাদের কাছে খুবই ছোট একটি অপারেশন। তারপরও আমি ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বলছি এটা আমার ভুল।’
অস্ত্রোপচারের সময় শরীরে সারাদিনের ক্লান্তি ছিল উল্লেখ করে অভিযুক্ত চিকিৎসক আরও বলেন, ‘আমি ওইদিন সকাল থেকেই কাজ করছিলাম। যে কারণে অপারেশন থিয়েটারে স্টাফরা যেভাবে বাচ্চাটিকে আমার সামনে দিয়েছে, আমিও সেভাবেই কাজ করে দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এখন তো আসলে অন্য স্টাফদের দোষ দিয়েও লাভ নেই।’
আরও পড়ুন
ছোট অপারেশন-ভুল বোঝাবুঝি বললেন হাসপাতালের পরিচালক
বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের অন্যতম পরিচালক অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) রাতে আমি বিষয়টি শুনেছি। কিন্তু বিষয়টিকে যত বড় করা হয়েছে আসলে তেমনটি নয়। চোখের এই অপারেশনটি খুবই ছোট, যেখানে চোখের ভেতরে কোন কাঁটাছেড়ারও প্রয়োজন হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসলে গতকাল (মঙ্গলবার) ওই শিশুর বড় কোনো অপারেশন হয়নি। শিশুর বাম চোখে চুলের মতো ময়লা পড়েছিল, সেটি আনতে গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখেন যে ডান চোখেও ময়লা আছে, তারপর ডান চোখ পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল। পরে আবার বাম চোখও পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। এটি অবশ্যই ভুল বোঝাবুঝি। এটা কোনো অপারেশনই না। আমরা এটিকে অপারেশনের পর্যায়ে ফেলি না।’
তদন্ত কমিটি গঠন, রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা
এদিকে শিশু আরিজ হাসানের চোখে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে একটি বোর্ড মিটিং করেছি। যদিও বিষয়টি খুবই ছোট, তারপরও আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।’
তিনি বলেন, ‘অপারেশনে শিশুটির চোখে কোনো ক্ষতি হয়নি, এমনকি তার শারীরিক অন্য কোনো ক্ষতিও হয়নি। বরং দুই চোখই পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় আরও ভালো হয়েছে। মানুষের চোখে ময়লা-আবর্জনা প্রায় সময়ই পড়ে, কিন্তু পরিষ্কার করা হয় না। এতে করে চোখের ক্ষতি হয়। সে হিসেবে রোগীর পরিবার বরং লাভবান হয়েছে।’
‘তবে এখানে অবশ্যই কর্তব্যরত চিকিৎসকের ভুল আছে। তার উচিত ছিল ডান চোখের ময়লা পরিষ্কারের আগে স্বজনদের জানানো। এমনকি বাম চোখ না করে শুধু ডান চোখ পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেওয়াটাও বড় ভুল’, উল্লেখ করেন হাসপাতালের পরিচালক।
আরও পড়ুন
অভিযোগ পেলে ছাড় নয় : পুলিশ
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আহমেদ মাসুদ বলেন, ‘ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ দায়ের করলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। অপরাধী যেই হোক না কেন অভিযোগ পেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
তবে এ ঘটনায় অভিযুক্ত হাসপাতালটির প্রধান নির্বাহী ড. নিয়াজ আব্দুর রহমান জানান, ঘটনার তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টিআই/এমজে