ডেঙ্গু পরীক্ষার সরকারি-বেসরকারি ফি কত?
দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়লেও সংশ্লিষ্টদের মনে এবার ভয় ধরাচ্ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে এত মৃত্যু আর দেখেনি বাংলাদেশ। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাসময়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা না করা এবং চিকিৎসা শুরু না হওয়ায় রোগীরা শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় জ্বর-সর্দিসহ ডেঙ্গুর যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে পরীক্ষার পরামর্শ তাদের।
জানা গেছে, ডেঙ্গুরোগীদের এনএস- ১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষার খরচ সরকারি হাসপাতালের জন্য ১০০ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। যদিও এর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন >> ডেঙ্গু : আগস্ট-সেপ্টেম্বর নিয়েও ভয়
তবে, ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর আরেক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মৌখিক নির্দেশনায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু পরীক্ষার মূল্য ৩০০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ধার্যকৃত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্য আদায় হতে বিরত থাকার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হয়।
ডেঙ্গু রোগীদের এনএস- ১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষার খরচ সরকারি হাসপাতালের জন্য ১০০ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার
এদিকে, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকা মূল্যে এনএস- ১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হচ্ছে। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালসহ সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেগুলোতে ১০০ টাকা করেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য তিনটি আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ডেঙ্গু পরীক্ষা প্রসঙ্গে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টাই ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়। ১০০ টাকার বিনিময়ে যে কেউ এসে পরীক্ষা করাতে পারেন। আমরা নির্দেশনা দিয়েছি যে হাসপাতালে যেকোনো ভর্তির রোগী আসলেই প্রথমে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করানো, এরপর ইনডোরে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া।
আরও পড়ুন >> অস্বাভাবিক অনুভব করলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করুন
তিনি বলেন, আমাদের প্যাথলজি বিভাগে রাত ৮টা পর্যন্ত যে কোনো পরীক্ষা করানো যায়। ডেঙ্গু ও করোনার পরীক্ষা ২৪ ঘণ্টাই করা হয়। যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক লক্ষণ দেখা দিলে হাসপাতালে এসেই এনএস- ১ পরীক্ষাটি করে নিশ্চিত হওয়া উচিত যে এটি ডেঙ্গু নয়।
কোন কোন উপসর্গ নিয়ে রোগীরা পরীক্ষা করাতে আসছেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ হলো বমি। কারও দীর্ঘস্থায়ী বমি হলে, এমনকি সেটি ওষুধ খেয়েও না কমলে দ্রুত হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু উপসর্গ হলো- ডায়রিয়া, পেটব্যথা, শরীরে পানি জমে যাওয়া, বুকে-পেটে পানি জমা, মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত সমস্যা, খিঁচুনি ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। এজন্য আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে বলব যে যখনই আপনি শরীরে অস্বাভাবিক কোনো সমস্যা দেখতে পাবেন, দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যে আপনি ডেঙ্গু আক্রান্ত নন।
ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ হলো বমি। কারও দীর্ঘস্থায়ী বমি হলে, এমনকি সেটি ওষুধ খেয়েও না কমলে দ্রুত হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু উপসর্গ হলো- ডায়রিয়া, পেটব্যথা, শরীরে পানি জমে যাওয়া, বুকে-পেটে পানি জমা, মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত সমস্যা, খিঁচুনি ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
রাজধানীর অন্যতম একটি বেসরকারি হাসপাতাল ল্যাবএইড। জানা যায়, হাসপাতালটিতে বর্তমানে দৈনিক ৮০ থেকে ৯০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, যা গত মাসে ছিল ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো।
ল্যাবএইড হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি কত— জানতে চাওয়া হলে হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-ই-খোদা দীপ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে সরকার নির্ধারিত ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকাই নেওয়া হচ্ছে। এর বেশি এক পয়সাও নেওয়া হচ্ছে না। কেউ যদি সিবিসি পরীক্ষা করাতে চান, সেটির মূল্য আলাদা ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন >> রোববার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উদ্বেগের কারণ ডেঙ্গু ও বন্যা
আমাদের হাসপাতালে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শুধু যে আমাদের হাসপাতালেই বাড়ছে তা নয়, সারাদেশেই আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গু বাড়ছে। আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে যে ফি নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, আমরা সেটাই নিচ্ছি— বলেন এ কর্মকর্তা।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা দেখছি যে অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু তারা সময় মতো পরীক্ষা করছেন না। এতে করে তারা নিজেদেরই ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। আর যে অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন, সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। এজন্য বলব, যারই ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তারই দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া উচিত।
‘সরকার নির্ধারিত ডেঙ্গু পরীক্ষার মূল্য খুবই কম। সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকা আর বেসরকারি হাসপাতালে ৩০০ টাকায় ডেঙ্গু পরীক্ষা করা যায়। এছাড়া অনেক জায়গায় কর্পোরেশনগুলো বিনা পয়সাতেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করছে। তাই জনগণের উচিত কারও জ্বর, সর্দি বা কাশি হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষাটা করিয়ে নেওয়া উচিত। কোনোভাবেই ঢিলেমি দেওয়া উচিত নয়। আগেই যদি ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে যায়, তাহলে চিকিৎসাও আগে শুরু করা যায়। এতে করে খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আক্রান্তদের ঝুঁকিও অনেকটা কমে যায়।’
এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘ছোট বাচ্চা, বয়স্ক এবং যাদের অন্যান্য রোগ আছে, ডেঙ্গুতে তাদের ঝুঁকিটা একটু বেশি। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার, কিডনি, লিভার, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের রোগী, তাদের একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কালক্ষেপণ না করে দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালে এসে পরীক্ষা করতে হবে।’
আরও পড়ুন >> ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানতে হবে ৫ নির্দেশনা
‘ডেঙ্গু সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, আমরা যদি প্রপারলি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে মনে হচ্ছে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ঈদ এবং তিন-চারদিনের বৃষ্টির প্রভাবে মশার প্রচুর বংশবিস্তার ঘটেছে। ফলে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে ডেঙ্গু নিয়ে একটা সংকটে আমরা পড়তে যাচ্ছি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে রোগী যদি বাড়তে থাকে তাহলে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে থাকবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি কত হবে তা আমরা আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছি। এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এনএস- ১ পরীক্ষায় ১০০ টাকা, বেসরকারি হাসপাতালে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা নিতে বলা হয়েছে।
‘আমরা শুধু ফি নির্ধারণ করে দেইনি, প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালকে কড়া নির্দেশনাও দিয়েছি। যদি এনএস- ১ পরীক্ষায় ৩০০ টাকার বেশি নেওয়া হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাদেশের কয়টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়— জানতে চাইলে নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, ‘দেশের সব সরকারি হাসপাতালেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা হচ্ছে। এর বাইরে যেসব বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষাটি করার সক্ষমতা আছে, তারাও সেটি করতে পারবে। এক্ষেত্রে জেলাপর্যায়ে সিভিল সার্জন অফিস এটি মনিটরিং করবে।’
আরও পড়ুন >> ৪৪% বহুতল ভবনে লার্ভা, ‘ভয়াবহ’ বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্লাটিলেট কেন্দ্রীভূত (কনসেনট্রেশন) করার জন্য রাজধানীসহ সারাদেশের ১৯টি সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলো হলো- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বাংলাদেশ (এনআইসিভিডি), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি (নিকডো), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল (নিনস), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ), রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
এছাড়া সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
দেশের সব সরকারি হাসপাতালেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা হচ্ছে। এর বাইরে যেসব বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষাটি করার সক্ষমতা আছে, তারাও সেটি করতে পারবে। এক্ষেত্রে জেলাপর্যায়ে সিভিল সার্জন অফিস এটি মনিটরিং করবে
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ২১৬৫ ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসাধীন। ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১৫২৮ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৩৭ ডেঙ্গুরোগী ভর্তি আছেন।
এছাড়া চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ২৯৮ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় সাত হাজার ৯৭১ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন তিন হাজার ৩২৭ জন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
টিআই/এমএআর/