শীতের সঙ্গে বাড়ছে শিশুদের রোগ, হাসপাতালে চাপ
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জেঁকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশায় দুপুরেও সূর্যের দেখা মিলছে না। ফলে দিনের উত্তাপ কমছে, চারদিকে যেন জবুথবু অবস্থা। এরই মধ্যে হিমেল বাতাসের কারণে শীত যেন শরীরে আরও কামড় বসাচ্ছে।
শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। এ সময় সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে সবচেয়ে অস্বস্তিতে আছে শিশুরা। অতিরিক্ত রোগীর চাপে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) চিকিৎসকদের যেন দম ফেলার ফুরসত নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শীতকালীন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিসসহ দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের রোগ। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হয়। প্রয়োজনে নিতে হয় চিকিৎসকের পরামর্শ।
বাংলাদেশে শীতকালীন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিসসহ দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের রোগ। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হয়। প্রয়োজনে নিতে হয় চিকিৎসকের পরামর্শ
ঢাকা শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গুরুতর নিউমোনিয়া নিয়ে দৈনিক ১৫-২০ শিশু নতুন করে হাসপাতালটিতে ভর্তি হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে ৮০ নিউমোনিয়ারোগী ভর্তি হয়েছে। নভেম্বর মাসে যেখানে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩০৮, ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩৭ জনে। চলতি মাসেও (জানুয়ারি) যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
আরও পড়ুন >> শীতের শুরুতেই হাসপাতালে ৪ গুণ রোগী, ডিসেম্বরে মৃত্যু ১০ শিশুর
বিশ্বজুড়ে একক রোগ হিসেবে পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আইসিইউ ও সিসিইউ-এর জন্য গড়ে ১৫ থেকে ২০ শিশু অপেক্ষমাণ থাকে। তবে, শয্যার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি থাকায় প্রতি বছর এক বছরের নিচের ৪৮ শতাংশ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যায়। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুর মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার।
শীত আসলেই বাড়ে নিউমোনিয়া-শ্বাসকষ্টের রোগী
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সারাবন তহুরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারাবছরই আমাদের হাসপাতালে নিউমোনিয়ার রোগী থাকে। তবে, শীতের সময়ে একটু বেড়ে যায়। শুধু যে নিউমোনিয়া বেড়ে যায় তা নয়; ব্রঙ্কিওলাইটিস নামে আরেকটা ভাইরাল রোগ আছে, সেটিও বেড়ে যায়। ফলে শিশুদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। অ্যাজমা রোগীর সংখ্যাও এ সময় বাড়ে। এমনকি শীতকালীন একটা ভাইরাল ডায়রিয়া আছে সেটিও বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন >> পা ফেলার জায়গা নেই শিশু ওয়ার্ডে, মেঝে-বারান্দায় চলছে চিকিৎসা
‘শিশু হাসপাতালে সবসময়ই রোগী একটু বেশি থাকে। সাড়ে ৭০০ বেডের হাসপাতালটিতে কোনো সময়ই শয্যা খালি থাকে না। আমি রেসপেরেটরি (শ্বাস-প্রশ্বাস সম্পর্কিত) ইউনিটের চিকিৎসক। আমাদের ইউনিট সবসময়ই রোগীতে ভর্তি থাকে। শীতের সময়ে রোগী বেড়ে যায়।’
বিশ্বজুড়ে একক রোগ হিসেবে পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আইসিইউ ও সিসিইউ-এর জন্য গড়ে ১৫ থেকে ২০ শিশু অপেক্ষমাণ থাকে। তবে, শয্যার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি থাকায় প্রতি বছর এক বছরের নিচের ৪৮ শতাংশ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যায়
শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, শীতের কারণে বর্তমানে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। গত দুই দিন হলো ঢাকার বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী আসছে। কারণ, গ্রামাঞ্চলে এখন প্রচুর শীত। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া অ্যাজমা, অ্যালার্জি, শীতজনিত ডায়রিয়াসহ নানা রোগ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে।
শীতজুড়ে থাকবে ঠান্ডাজনিত রোগের উৎপাত
ডা. কামরুজ্জামান বলেন, শিশু হাসপাতালে রোগী বাড়ার ঢেউ কেবল শুরু হয়েছে। পুরো শীতজুড়ে ঠান্ডাজনিত রোগীদের আসা-যাওয়া চলবে। তবে, এ সময়ে অন্যান্য রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে।
আরও পড়ুন >> শীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
‘আমাদের যে নিউমোনিয়া রিসার্চ সেন্টার, সেখানে ১৬টি স্পেশাল শয্যা আছে। কোনোটি এখন খালি নেই। এর বাইরে হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ড, কেবিন, পেয়িং বেডগুলোতেও নিউমোনিয়া রোগী চিকিৎসাধীন। সবমিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ রোগী শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে। তাদের অধিকাংশই নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ শীতকালীন নানা রোগে আক্রান্ত।’
হাসপাতালটির এপিডেমিওলজিস্ট (দায়িত্বপ্রাপ্ত) ডা. এ বি এম মাহফুজ হাসান আল মামুন জানান, গত অক্টোবর মাস থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশু নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওই মাসে ৩২০ শিশু ভর্তি হয়। নভেম্বরে ৩০৮ জন এবং ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩৭ জনে। তবে, করোনাকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল বলেও জানান এ চিকিৎসক।
শিশুদের সুরক্ষায় সতর্কতার তাগিদ, অতি-সতর্কতায় বিপদ
ডা. কামরুজ্জামান বলেন, শীতের সময়টাতে শিশুদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে রাখতে হবে। বিশেষ করে তাদের মাথাটা ঢেকে রাখতে হবে, কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে। ছোট বাচ্চা, বিশেষত ছয় মাসের কম বয়সী শিশুর ঠান্ডা লাগলেই ঘন ঘন বুকের দুখ খাওয়াতে হবে। তার নাকটা সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ছয় মাসের ওপরে যেসব বাচ্চা আছে, তাদের বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার এবং কুসুম গরম পানিও খাওয়াতে হবে।
আরও পড়ুন >> শীতে যেসব রোগের তীব্রতা বাড়ে
‘এ সময় বাচ্চাদের স্ক্রিনে নানা সমস্যা দেখা যায়। ডার্মাটাইটিস ছাড়াও স্ক্রিনের শুষ্কতাজনিত কারণে কিছু রোগ বাড়ছে। এক্ষেত্রে বলব, তারা যেন নিয়মিত শরীরে অলিভ অয়েল মাখে। শীতের কাপড় পরার ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও যেন খেয়াল রাখা হয়। লেপ-কম্বল বের করে নিয়মিত রোদে দিতে হবে। যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের ধুলাবালি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।’
অতি-সতর্কতা প্রসঙ্গে ডা. সারাবন তহুরা বলেন, বাবা-মায়েরা অনেক সময় হালকা শীতে অতি-সতর্কতায় শিশুদের বেশি কাপড় পরিয়ে রাখেন। এমন অবস্থা হয় যে তাদের ভেতর থেকে প্রচুর ঘাম হয়। ঘাম থেকে বাচ্চাদের অ্যাজমা হয়। এ কারণে বিষয়টা খুবই গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। আবার অনেক সময় শীত চলে গেলে কাপড়গুলো তুলে রাখা হয়। শীত ফের এলে কাপড়গুলো না ধুয়ে ব্যবহার করা হয়। ফলে বাচ্চাদের অ্যালার্জিজনিত সর্দি-কাশি, এমনকি নিউমোনিয়াও হয়ে থাকে।
‘যেসব বাচ্চার ছোটবেলা থেকে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা আছে, তাদের উলের লেপ-কম্বল ব্যবহার না করাই ভালো। এক্ষেত্রে ধোয়া যায় এমন কম্ফোর্টার ব্যবহার করা যেতে পারে।’
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত গড়ে ১৬ জন ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতি বছরই শীত আসা ও যাওয়ার সময় সর্দি, ঠান্ডা, কাশি ও জ্বর দেখা যায়। একইসঙ্গে হাঁপানি, গলাব্যথা বা টনসিলাইটিস ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ১৮ নিউমোনিয়ারোগী ভর্তি হয়। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
‘বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ বছরের নিচে সাত লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচে ১৮ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। এর পরের হিসাব আমাদের কাছে নেই।’
শীতে কেন বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বাড়ে— জানতে চাইলে ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যখন শীত আসে বা শীত যায় তখন বেশকিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। এছাড়া আমাদের দেশের বাতাসে প্রচুর ধূলিকণা থাকে। এটা শীতজনিত রোগের অন্যতম কারণ। ধূলিকণার আশ্রয়ে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকে।
টিআই/এমএআর