সাশ্রয়ী মূল্যে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি হবে হৃদরোগ হাসপাতালে
হৃদরোগ চিকিৎসায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ‘রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি’ যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা শুরু হলে ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্টরা অফিস, বাড়ি এমনকি বিদেশে বসেও রোবটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে হার্টে রিং (স্টেন্ট) পরাতে পারবেন।
হৃদরোগ চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এ হাসপাতালে প্রথমবারের মতো আগামী বছরের শুরুতে এ চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে। ফলে কম সময়ে ও সাশ্রয়ী মূল্যে রোগীরা চিকিৎসাসেবা পাবেন বলে আশা চিকিৎসকদের।
‘রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি’ বিষয়ে প্রথম প্রশিক্ষণ নিয়েছেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। ভারতের হায়দরাবাদ অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ইতোমধ্যে একটি টিমও গঠন করা হয়েছে। দেশে হৃদরোগ চিকিৎসায় সর্বাধুনিক এ চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছেন ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।
আরও পড়ুন >> ‘মারাত্মক’ টাইপ- ১ ডায়াবেটিসে ঝুঁকিতে শিশুরা
ঢাকা পোস্ট : রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি কী?
প্রদীপ কুমার কর্মকার : রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি বর্তমান পৃথিবীতে হার্টের রিং লাগানোর সর্বাধুনিক এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি। আমরা এখনও ক্যাথল্যাবে নিজেরা সামনে থেকে হাত লাগিয়ে রোগীদের রিং পরাই। এর সর্বশেষ আবিষ্কার হলো রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি। এর দুটি অংশ থাকে। একটি হলো- রোবটের একটি হাত থাকে ক্যাথল্যাবে। আরেকটি কন্ট্রোল সেকশন থাকে। যেখান থেকে মূল কার্ডিওলজিস্ট পুরো কার্যক্রমটি অপারেট করে থাকেন।
ঢাকা পোস্ট : রোবটিক পদ্ধতিতে এনজিওপ্লাস্টিতে বিশেষ কী সুবিধা রয়েছে?
প্রদীপ কুমার কর্মকার : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিন ধরনের সুবিধা আছে। একটি হলো- রোগীর জন্য সুবিধা। আরেকটি হলো- যে কার্ডিওলজিস্ট রিং পরাবেন তার জন্য সুবিধা। তৃতীয়ত হলো- দেশের জন্য সুবিধা।
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে প্রথম সুবিধা হলো- হার্টে রিং লাগানোর জটিল প্রক্রিয়াটি রোবটের মাধ্যমে খুবই সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে করা যায়। অনেক সময় হার্টের রিংটা ১ মিলিমিটার সামনে বা ১ মিলিমিটার পেছনে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এটি কিন্তু রোবটের মাধ্যমে খুবই নিখুঁতভাবে করা যায়।
আরেকটি সুবিধা হলো- হাতে এনজিওপ্লাস্টি করতে গেলে যে সময় লাগে, রোবটের মাধ্যমে সেটি করতে অনেক কম সময় লাগে। যে কারণে আমরা অল্প সময়েই বেশি রোগীকে সার্ভিস দিতে পারি। আপনারা জানেন হার্টে রিং পরানো খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া। আমরা বলি হার্টের ভেতরে ক্যাথেটার, ওয়্যার (তার), বেলুন, স্টেন্ট যত কম রাখা যায় রোগীর জন্য ততই নিরাপদ। রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রিং পরাতে এসব জটিলতা থাকে না। ফলে সময়ও কম লাগে এবং রোগীর জটিলতাও কমে যায়।
আরও পড়ুন >> দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্তে তীব্র জটিলতা, মৃত্যুও বেশি
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে চিকিৎসকদের জন্য সুবিধা হলো- যেসব চিকিৎসক অনেক এনজিওপ্লাস্টি করেন, একটা সময়ে এসে তারা দুটি সমস্যায় পড়েন। প্রথমত হলো- রেডিয়েশনের কারণে অনেক চিকিৎসকের ব্রেইন ক্যান্সার হতে পারে, চোখের জ্যোতিও কমে যেতে পারে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো- চিকিৎসকদের ঘাড়ের নার্ভে অতিরিক্ত চাপ পড়া। কারণ, তারা যখন ক্যাথল্যাবে কাজ করেন, রেডিয়েশন প্রটেকশনের জন্য তাদের ১২ থেকে ১৫ পাউন্ড ওজনের একটি বিশেষ জামা দীর্ঘক্ষণ পরে থাকতে হয়। ফলে ঘাড়ের নার্ভে চাপ পড়ে। পরবর্তীতে ওই চিকিৎসক খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এনজিওপ্লাস্টি করতে পারেন না। এক্ষেত্রে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রেডিয়েশন ছাড়াই ক্যাথল্যাবের কন্ট্রোল রুম, তার অফিস, সুযোগ-সুবিধা থাকলে বাসায় বসে বা দেশের বাইরে বসেও কাজটি তিনি অপারেট করতে পারেন।
এক্ষেত্রে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- অত্যাধুনিক এ চিকিৎসা প্রযুক্তি চালু হলে রোগীকে আর দেশের বাইরে যেতে হবে না। রোবটিক চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর অসংখ্য লোক ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। আমরা যদি সেবাটি জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে চালু করতে পারি তাহলে খুবই কম খরচে রোগীদের সেবা দিতে পারব। এর মাধ্যমে অনেক বড় অঙ্কের একটি অর্থ দেশে থেকে যাবে।
ঢাকা পোস্ট : আপনি তো রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। কবে থেকে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে এটি শুরু করতে পারবেন?
প্রদীপ কুমার কর্মকার : আমি সম্প্রতি ভারতের হায়দরাবাদের অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এর আগে অনেকগুলো ওয়েবিনার আলোচনা, সিমুলেটর প্রশিক্ষণের কয়েকটি সেশন করেছি। এছাড়া আমি রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে ভারতের প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. পি সি রাথের কাছ থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ পেয়েছি। সর্বশেষ আমি নিজের হাতে এনজিওপ্লাস্টি করে এসেছি।
আরও পড়ুন >> দেশে প্রথম ‘স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি’ রোগে জিন থেরাপি
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি করতে আমাদের জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে যথেষ্ট অবকাঠামো রয়েছে। আমাদের আধুনিক ক্যাথল্যাব আছে, চিকিৎসক আছেন। এখন মেশিনটা সরকার যদি আমাদের কেনার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে খুবই কম খরচে আন্তর্জাতিক মানের সর্বাধুনিক এ প্রযুক্তি আমরা শুরু করতে পারব। এমনকি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টর যে ডিজিটালাইজড হয়েছে, এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা সে সুযোগও নিতে পারব।
আমরা চাচ্ছি খুবই দ্রুত যেন আমাদের হাসপাতালে এটি শুরু করা যায়। রোবটিক মেশিনটা যদি আমরা পেয়ে যাই, তাহলে আগামী বছরের শুরুতে এ চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করতে পারব।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশের কোথাও এর আগে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি হয়েছে কি না?
প্রদীপ কুমার কর্মকার : বাংলাদেশে এখনও কোথাও রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি শুরু হয়নি। আমি দেশের প্রথম চিকিৎসক, যিনি রোবটিক সার্জারির ওপর ট্রেনিং নিয়ে এসেছি। আশা করছি, আমাকে যদি সরকার ডিভাইসটি কিনে দেয়, তাহলে আমি জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল থেকে কাজটি শুরু করতে পারব।
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি করতে সর্বনিম্ন ২০ থেকে ৫০ এমবিপিএস ইন্টারনেট গতি থাকলে হয়। আপনারা জানেন ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এর চেয়ে ভালো গতির ইন্টারনেট আছে। এ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারলে আমরা অফিস, বাসায় বা ঢাকার বাইরে থেকেও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটি করতে পারব। যে প্রতিষ্ঠানগুলো এটি ব্যবহার করছে, প্রতিনিয়ত এর উন্নত সংস্করণ তারা নিয়ে আসছে। নতুন নতুন বিভিন্ন সফটওয়্যার আসছে। আশা করছি খুব দ্রুতই এটি বাংলাদেশে শুরু করতে পারব।
আরও পড়ুন >> কিডনি চিকিৎসার নায়ক কামরুল মেডিকেলে হয়েছিলেন দেশসেরা
ঢাকা পোস্ট : সরকারি হাসপাতালে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি করতে কেমন খরচ হবে?
প্রদীপ কুমার কর্মকার : সরকারি হাসপাতালে ওষুধসহ প্রায় অধিকাংশ জিনিসই সরকার দেয়। এক্ষেত্রে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে সরকার যদি আমাদের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে তাহলে রোগীদের অতিরিক্ত হাজার বিশেক টাকা খরচ হবে। এক্ষেত্রে সরকার যদি এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টির ডিভাইসগুলো নিয়মিত সরবরাহ করে, তাহলে আমরা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি সম্পন্ন করতে পারব।
আমাদের হাসপাতালে গরিব রোগীরা রিং ফ্রি পান, বেলুন ফ্রি পান; প্রসিডিউরের টাকা লাগে না। এক্ষেত্রে সরকার যদি বাকি ডিভাইসগুলো কিনে দেয়, তাহলে আমরা রোগীদের বিনা মূল্যেও সেবা দিতে পারব। দেশের বাইরে যখন কেউ রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি করাতে যান, ভারতে অতিরিক্ত প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়, সিঙ্গাপুর ও আমেরিকায় খরচ আরও বেশি।
ঢাকা পোস্ট : রোবটিক সার্জারি প্রথম কবে ও কোথায় শুরু হয়? বিশ্বের কয়টি দেশে বর্তমানে এটি চলছে?
প্রদীপ কুমার কর্মকার : আপনারা জানেন রোবটের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ আগেই শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে আমরা প্রথম শুরু করতে যাচ্ছি। যেমন- স্পাইনাল সার্জারি, এটা ইতোমধ্যে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত। রোবটিক করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফ্ট (সিএবিজি) আমাদের পাশের দেশ ভারতে হচ্ছে, সিঙ্গাপুরে হচ্ছে। এছাড়া অনেক দেশেই হচ্ছে। অর্থাৎ রোবটিক চিকিৎসায় বিশ্ব অনেক দূর এগিয়েছে।
রোবটের মাধ্যমে এনজিওপ্লাস্টি ভারতে প্রথম শুরু হয় ২০১৮ সালে। অধ্যাপক তেজস পেটেল এটা শুরু করেন। তিনি যখন প্রথম এনজিওপ্লাস্টি করেন, তখন তিনি তার থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরের এক রোগীর হার্টে রিং পরান। তখন থেকে এটি সারাবিশ্বে শুরু হয়। যা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে। প্রতিনিয়ত গবেষণা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন >> ‘ডায়াবেটিস রোধ হলে বছরে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব’
যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে এখন পর্যন্ত ১৬০টি রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি সেন্টার রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতে আছে ছয়টি। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে এখনও এ চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীন নতুন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে এটি হওয়ার কথা রয়েছে। তবে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন হলেও এখনও এ সেবা কার্যক্রম শুরু হয়নি।
প্রদীপ কুমার কর্মকারের আরও কীর্তি
এর আগে ট্রান্স ক্যাথেটার অ্যাওর্টিক ভালভ রিপ্লেসমেন্ট (টিএভিআর) বা বুক না কেটে হার্টে ভালভ প্রতিস্থাপন করে আলোচনায় আসেন জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। ২০২১ সালের ২৫ ও ২৬ অক্টোবর তার নেতৃত্বে সফলভাবে এ অপারেশন সম্পন্ন হয়। এরপর ১৭ এপ্রিল (২০২২ সাল) জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে তিনি বুক না কেটে টিএভিআর পদ্ধতিতে পুরনো অ্যাওর্টিক ভালভের ভেতর নতুন ভালভ প্রতিস্থাপন করে নতুন করে আলোচনায় আসেন।
টিআই/এমএআর