বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপন ‘সহজলভ্য’ করতে চান ডা. প্রদীপ
হার্টে ভালভ প্রতিস্থাপনে বিশ্বজুড়ে এখন সবচেয়ে ঝুঁকিমুক্ত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি ট্রান্স ক্যাথেটার অ্যাওর্টিক ভালভ রিপ্লেসমেন্ট (টিএভিআর), যাকে সহজে বলা হয় বুক না কেটে হার্টে ভালভ প্রতিস্থাপন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এই প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল। তবে এই পদ্ধতিটি ‘সহজলভ্য’ করতে সরকারের সহযোগিতা চান জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার।
জানা গেছে, বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে খরচ হয় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুরে থরচ হয় প্রায় এক কোটি টাকা। বাংলাদেশে সরকারি হৃদরোগ হাসপাতালে এটি করা হচ্ছে ১২ লাখ টাকায়।
তবে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য এই অর্থ সংকুলান করা অনেকটাই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ অবস্থায় বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপনের এই পদ্ধতি ‘সহজলভ্য’ করতে সরকারের সহযোগিতা চান জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার।
তিনি জানান, হার্টের ভালভ সরু হয়ে যাওয়া রোগীর যথাসময়ে চিকিৎসা প্রয়োজন। অন্যথায় ৮০ শতাংশ রোগীই দুই বছরের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
আরও ভয়ানক তথ্য হলো— প্রোস্টেট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের চেয়েও এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
হৃদরোগ হাসপাতালের এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির। এরকম একজন রোগী যখন শোনেন তার ভালভ প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং চিকিৎসায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা লাগবে, তখন তারা খুব হতাশ হয়ে যান। অনেক রোগী নিজেকে ভাগ্যের ওপর সমর্পণ করে বাসায় চলে যান, যা খুবই ভয়ানক এবং দুঃখজনক।
ডা. প্রদীপ কুমার জানান, বুক না কেটে অ্যাওর্টিক ভালভ প্রতিস্থাপনে সারা বিশ্বেই অনেক বেশি খরচ হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই ভালভ প্রতিস্থাপনে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। সিঙ্গাপুরে প্রায় এক কোটি টাকার মতো খরচ পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম ভালভটি আমরা পাঁচ লাখ টাকায় প্রতিস্থাপন করেছি। পরে ১০ লাখ টাকার মধ্যে করেছি এবং এখন সেটি করতে প্রায় ১২ লাখ টাকা লাগছে। কারণ যেই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা ভালভ নিয়ে থাকি, তারা শুরুতে যেই ছাড়টা দিত সেটি তারা ধীরে ধীরে উঠিয়ে নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর অনেক মানুষের ভালভ প্রতিস্থাপন জরুরি কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল— এমন অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। এ অবস্থায় আমি সরকারের কাছে বিনীত আবেদন জানাই, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট হাসপাতালে এই চিকিৎসার জন্য আমরা টিম ডেভেলপ করেছি। এখন যদি সরকারি পর্যায়ে আমাকে ভালভ এবং ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তাহলে আমি দেশের গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের জন্য ভূমিকা রাখতে পারব।
জানা গেছে, বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে খরচ হয় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুরে থরচ হয় প্রায় এক কোটি টাকা। বাংলাদেশে সরকারি হৃদরোগ হাসপাতালে এটি করা হচ্ছে ১২ লাখ টাকায়।
ভালভ প্রতিস্থাপনে সরকারি কোনো সহায়তা থাকে কি না— জানতে চাইলে ডা. প্রদীপ বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদেরকে সরকারিভাবে কোনো ভালভ বা যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়নি। তবে আমাদের হাসপাতালের অন্য যে সার্ভিসগুলো আছে, বিশেষ করে ক্যাথল্যাব ব্যবহার করা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাজে লাগানো, কিছু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমরা প্রায় বিনামূল্যেই দিয়ে থাকি।
প্রথমবার বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপন করা সেই রোগী কেমন আছেন?
গত ১৭ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয় জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে। হাসপাতালটির সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের নেতৃত্বে একটি চিকিৎসক দল ৭৫ বছর বয়সী সাবেক এক সচিবকে সফলভাবে এই চিকিৎসা দেন।
সাবেক ওই সচিব ২০১১ সালে হার্টের অ্যাওর্টিক ভালভ সরু হওয়ার কারণে অন্য একটি হাসপাতালে বুক কেটে অ্যাওর্টিক ভালভ প্রতিস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পরে হাঁটার সময় তিনি শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। এ অবস্থায় তিনি ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের অধীনে ভর্তি হন। এরপর তার বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়।
বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই রোগী এখন পুরোপুরি সুস্থ আছেন। শিগগিরই তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাবেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে সাবেক ওই সচিব বলেন, বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপনের পর আমার শারীরিক অবস্থার রেডিকাল চেঞ্জ হয়েছে। আগে চলাফেরা করতে গেলে তীব্র শ্বাসকষ্ট হতো, সিঁড়িতে উঠতে এবং নামতে অনেক কষ্ট হতো, এখন সেটি একদমই নেই। এখন আমার মানসিক কনফিডেন্স লেভেল আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। অপারেশন হওয়ার পরের দিন থেকেই হাসপাতালে বসে অফিসের কাজকর্ম করা শুরু করে দিয়েছি। এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।
বুক না কেটে, বুকের হাড় না কেটে এই পদ্ধতিতে অ্যাওর্টিক ভালভ প্রতিস্থাপনে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। এই সময় রোগীকে অজ্ঞান করতে হয় না। এমনকি রোগী তিন দিন পরেই হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যেতে পারেন এবং সাত দিনের মধ্যে কাজে যোগ দিতে পারেন
সরকারি হাসপাতালে এত বড় চিকিৎসায় সন্দিহান ছিলাম
দ্বিতীয়বার ভালভ প্রতিস্থাপন হওয়া ওই রোগীর মেয়ে ঢাকা পোস্টকে জানান, তার পরিবার ভেবেছিল দেশের বাইরে হয়ত নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দেশেই জটিল এ চিকিৎসা পেয়ে সন্তুষ্ট তিনি।
তিনি বলেন, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমার বাবা এখন পুরোপুরি সুস্থ। আমি আগে ভাবতেও পারতাম না যে এই বয়সে একটা ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে এখানকার চিকিৎসকরা সফলতার সঙ্গে কাজটা সম্পন্ন করতে পারবেন। এজন্য আমি ডা. প্রদীপ কুমারসহ জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের যেসব চিকিৎসক বাবার চিকিৎসায় জড়িত ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
সরকারি হাসপাতাল নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা রয়েছে। তারা ভাবেন যে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা এতটা ভালো না, উন্নত কোনো চিকিৎসা হবে না। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমি নিজেও এত বড় একটা চিকিৎসা দেশের হাসপাতালে হয় কি না তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশেও এত সুন্দর করে ভালভ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব, সেটি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না, যোগ করেন সাবেক ওই সচিবের মেয়ে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের জন্য এই চিকিৎসা করানো তেমন কঠিন মনে না হলেও ১২/১৩ লাখ টাকায় ভালভ প্রতিস্থাপন করা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য খুবই কঠিন। সরকার যদি এক্ষেত্রে সহযোগিতা করে তাহলে হয়ত রোগীরা সাশ্রয়ে সরকারি হাসপাতালে এসে সেবা নিতে পারবে।
জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার টিএভিআর পদ্ধতিতে বুক না কেটে দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সঙ্গে তুলনামূলক কম খরচে এই অপারেশন করে যাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশে এই অপারেশনের পথিকৃৎ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগীর টিএভিআর সফলভাবে অপারেশন করেছেন।
বুক না কেটে, বুকের হাড় না কেটে এই পদ্ধতিতে অ্যাওর্টিক ভালভ প্রতিস্থাপনে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। এই সময় রোগীকে অজ্ঞান করতে হয় না। এমনকি রোগী তিন দিন পরেই হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যেতে পারেন এবং সাত দিনের মধ্যে কাজে যোগ দিতে পারেন। এই সুবিধার কারণে সারা বিশ্বে টিএভিআর পদ্ধতিতে বুক না কেটে অ্যাওর্টিক ভালভ প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে এবং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
টিআই/এসএসএইচ