বিজয়ের অদম্য যাত্রায় দেশের স্বাস্থ্য খাত
১৯৭১ সালে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, এখন স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলের কাতারে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এ উত্তরণের পেছনে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রফতানিমুখী শিল্পায়ন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাক ও ওষুধ শিল্প, রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও পরিশ্রমের ফসল।
বিজয়ের ৫০ বছরে বিভিন্ন খাতের ন্যায় দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসাচাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ-প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকগুলোর ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে বহু দূর।
গড় আয়ু বৃদ্ধি
বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। যেখানে ১৯৭০ সালে গড় আয়ু ছিল ৫২ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৮ বছর, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৬ বছর। ২০১৮ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৩ বছর, ২০১৭ সালে ৭২ বছর এবং ২০১৬ সালে ছিল ৭১ দশমিক ৬ বছর।
প্রত্যাশিত গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি। ২০২০ সালে পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর। ২০১৯ সালে ছিল ৭১ দশমিক ১ বছর। ২০১৮ সালে ৭০ দশমিক ৮ বছর, ২০১৭ সালে ৭০ দশমিক ৬ বছর এবং ২০১৬ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৩ বছর। অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রত্যাশিত গড় আয়ু হচ্ছে ৭৪ দশমিক ৫ বছর, ৭৪ দশমিক ২ বছর, ৭৩ দশমিক ৮ বছর, ৭৩ দশমিক ৫ বছর এবং ৭২ দশমিক ৯ বছর।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যসেবা খাতে উল্লেখ করার মতো অনেকগুলো অর্জনের মাইলফলক আমাদের রয়েছে। ১৯৭০ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫২ বছর। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৮ বছরে।
তিনি বলেন, চার দশক আগে সন্তান জন্মদানের সময় প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে ৮০০ জনের মৃত্যু হতো। চলতি বছর ৭ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ হার বর্তমানে ১৬৫-তে নেমে এসেছে। শিশুদের পাঁচটি সংক্রামক রোগপ্রতিরোধী টিকা বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে রোল মডেল হিসেবে সম্মানিত হয়েছে। পোলিওমুক্ত দেশের তালিকায় একটি উজ্জ্বল নাম হচ্ছে বাংলাদেশ।
মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধে বাজিমাত
স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিশুমৃত্যু রোধে বাজিমাত করেছে বাংলাদেশ। ১৯৭০-এর দশকে প্রতি এক হাজারে নবজাতকের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ১৫০। এখন (২০২০-২১) সে হার কমে হয়েছে ১৭ দশমিক ১-এ। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯৩ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি এক হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল ১৩৩ জনের। ২০১৪ সালে তা কমে ৪৬ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার (প্রতি হাজার জীবিত শিশুর) কমিয়ে ৩৪ জনে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের এসডিজিতে তা কমিয়ে ২৫ জনে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে।
১৯৯৩ সালে প্রতি এক হাজার জীবিত নবজাতক শিশুর মধ্যে মৃত্যু (শূন্য থেকে ২৮ দিন বয়সী) হতো ৫২ জনের। ২০১৪ সালে তা কমে ২৮ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের মধ্যে নবজাতকের মৃত্যু (প্রতি হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে) কমিয়ে ১৮ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে ১২ জনে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে।
মাতৃমৃত্যুতেও স্বাধীনতা-পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছে। চার দশক আগে সন্তান জন্মদানের সময় প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে ৮০০ জনের মৃত্যু হতো। ১৯৮৬ সালের দিকে এ সংখ্যা কমে ৬৪৮ জনে নেমে আসে। ২০১৫ সালে মাতৃমৃত্যু কমে ১৮১ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের মধ্যে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু কমিয়ে ১২১ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) তা কমিয়ে ৭০ জনে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অর্জন রয়েছে। মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। সীমাবদ্ধ সম্পদ ও বিপুল জনগোষ্ঠী নিয়ে এ অর্জন যে প্রশংসনীয় তা জাতীয়সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবাই স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, সীমাবদ্ধ সম্পদ ও বিপুল জনগোষ্ঠী নিয়ে স্বাস্থ্য খাতের এসব অর্জনের জন্য তিনটি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। এর মধ্যে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
করোনা প্রতিরোধে সফলতা, বিশ্ব অবাক
বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু রোধে এখন পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। করোনা ঠেকাতে বিশ্বের অনেক দেশ এখন পর্যন্ত টিকাদান কার্যক্রমে পিছিয়ে থাকলেও ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১১ কোটি মানুষ বিনামূল্যে টিকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশে করোনার টিকা উৎপাদনের কাজও শুরু হয়েছে, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা যাবে।
এদিকে, শতভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে টিকাগ্রহণকে বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এত দিন মাস্ক না পরলে সরকারি কোনো সংস্থায় সেবা মিলত না। তবে এখন সেবা নিতে টিকাগ্রহণও বাধ্যতামূলক হচ্ছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের উদ্বেগের মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, এখনও অনেকেই টিকা নেননি। অনেকেরই টিকা নিতে আগ্রহ কম। এ কারণে ‘নো ভ্যাকসিন, নো সার্ভিস’ নিয়ম চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, আগে আমাদের স্লোগান ছিল ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’। এখন থেকে আমরা বলতে যাচ্ছি ‘নো ভ্যাকসিন, নো সার্ভিস’। এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা বিভিন্ন দফতরে চিঠি দিয়ে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেব।
ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন
দেশের ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা যায়। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪৫টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হচ্ছে।
এ অঞ্চলে ওষুধ শিল্পের যাত্রা শুরু হয় প্রায় ৭৫ বছর আগে ব্রিটিশ-ভারত শাসনামলে। ওই সময় কয়েকজন বাঙালি মেধাবী তরুণ ওষুধ শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করতে বিদেশে যান। দেশে ফিরে তারা এ শিল্পে মনোযোগ দেন। বলা যায়, ভারতের ওষুধ শিল্পও গড়ে উঠেছিল কলকাতা থেকেই। পরে মুম্বাই, হায়দরাবাদ ও গুজরাটে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ এটি ধরে রাখতে না পারলেও দেশ বিভক্ত হওয়ার পর কিছু বাঙালি উদ্যোক্তা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ওষুধ শিল্পের বিকাশ ঘটান।
ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগ চালু হয়। পরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কিছু বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি কাজ শুরু করে। সেখান থেকেই দেশের ওষুধ শিল্পের বড় ধরনের যাত্রা শুরু হয়। আশির দশকে ওষুধ নীতিমালা হওয়ার পর এ খাতে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়। নব্বইয়ের দশকে এসে এটি পূর্ণমাত্রা পায়। যার মাধ্যমে এ শিল্প দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সহসভাপতি ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মুক্তাদির বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এখন অনেক বড়। দেশের অভ্যন্তরেই স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল ও ওষুধ তৈরির ইকুইপমেন্ট তৈরি করা গেলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আরও এগিয়ে যাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, দেশেই কাঁচামাল উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার বড় একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) পার্কে কারখানা স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হবে। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান এতে বিনিয়োগ করছে। রফতানির জন্য যে ধরনের মানসম্পন্ন কারখানা দরকার, সেভাবেই দেশে গড়ে উঠছে বিশ্বমানের এসব কারখানা।
আবদুল মুক্তাদির আরও বলেন, কাঁচামাল উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া গেলে বিশ্ববাজারে সাশ্রয়ী দামে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে দেশের ওষুধ শিল্প। এতে এক-দুই বিলিয়ন ডলার নয়, আগামী ১০ বছরে পর্যায়ক্রমে ১০ বিলিয়ন ডলার ওষুধ রফতানি করতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি আমরা। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
রেকর্ড সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ
দেশের স্বাস্থ্য খাতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ হয়েছে চলমান কোভিডের সময়। এ সময় দেশে প্রায় ১৫ হাজার চিকিৎসক ও ২০ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এডহক, ৩৩তম বিসিএস ও ৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে ১৮ হাজারের বেশি চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া ৪২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে আরও চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগের কাজ চলমান রয়েছে।
সম্প্রতি আট হাজার নার্স নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ১৫ থেকে ২০ হাজার স্বাস্থ্য সহকারী ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব নিয়োগ সম্পন্ন হলে স্বাস্থ্য খাতের জনবল সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে।
চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে জনবল একটি বড় বিষয়। আমাদের স্পেশালিস্ট চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের অনেক চিকিৎসক প্রয়োজন। বিশেষ করে সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্ট, কার্ডিয়াক সার্জন, এনেসথেসিস্টসহ বেসিক সাবজেক্টের অনেক স্পেশালিস্টের ঘাটতি রয়েছে। আমরা এ ঘাটতিগুলো পূরণের চেষ্টা করছি।
স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তির ছোঁয়া
প্রযুক্তির ছোঁয়া স্বাস্থ্য খাতকে আরও উন্নত করেছে। দেশের সব হাসপাতালে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরে ই-গভর্ন্যান্স ও ই-টেন্ডার চালু করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অনলাইন সেবা কার্যক্রম চালু করতে ‘ভিশন সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (এনসিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাসেবায় নতুন নতুন অনেক প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে যে তারা আরও অনেক অ্যাডভান্স লেভেলে চলে গেছে। আমরা তো সেই কাতারে পৌঁছতে পারিনি। তবে আমরা বিভাগভিত্তিক উন্নয়নের চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, একটা সময় আমাদের দেশে ল্যাপরোসি হতো না, এগুলো এখন হচ্ছে। রেডিওলজি বিভাগে উন্নতি হয়েছে। এভাবে সার্জিক্যাল, মেডিসিন, গাইনি অ্যান্ড অবসসহ বিভিন্ন বিভাগে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, টেকনিক ও জ্ঞানের দিকেও আমাদের উন্নতি হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরও আধুনিক প্রযুক্তিতে যাওয়ার সুযোগ আছে আমাদের। এগুলো একটি চলমান প্রক্রিয়া।
দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা
স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকারের অন্যতম পদক্ষেপ হলো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পটি হাতে নেয় শেখ হাসিনার সরকার। স্থাপন করা হয় প্রায় ১০ হাজার ক্লিনিক। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো জনবান্ধব মানবিক উদ্যোগটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক রোষে বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন জরিপ এবং বিবিএসের তথ্য অনুসারে কমিউনিটি ক্লিনিকের ৯০ শতাংশের বেশি গ্রাহক তাদের পরিষেবা ও সুবিধার ক্ষেত্রে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
নিজ শহরেই বিশেষায়িত সেবা
উপজেলা ও জেলাপর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা। স্থাপন করা হয়েছে হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ক্যানসার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। অব্যাহত নার্সের চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের কাজ চলছে।
শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। উপজেলার হাসপাতালগুলো উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতেও শয্যার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২০১০ সালে প্রকাশিত ‘গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট : টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন’ শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি।
এর আগে সর্বশেষ (জুলাই ১, ২০২০-জুন ৩০, ২০২১) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে বলা হয়, জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে বিগত তিন বছরে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ও উপকরণ প্রদান এবং বিনামূল্যে ওষুধ ও পরিবার পরিকল্পনাসামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবাকে জনকল্যাণমুখী করতে নতুন আইন, বিধি, নীতিমালা প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইনের সংস্কার করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১৬ এবং রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১৬ প্রণীত হয়েছে। নবসৃষ্ট জামালপুর, পটুয়াখালী, সিরাজগঞ্জ ও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের উন্নয়ন ও পদসৃজনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। একইসঙ্গে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষা-ব্যবস্থাপনাকে যুগোপযোগী করতে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন- ২০১৬ প্রণীত হয়েছে। ওয়েব পোর্টাল ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সের ভর্তির আবেদন ও ফল প্রকাশ করা হচ্ছে।
এছাড়া গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রায় ১৩ হাজার ৯৬২টি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ তিন হাজার ৩৩১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র থেকে মাঠকর্মীরা পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন।
টিআই/এমএইচএস/এমএআর/