‘আদর্শে’ জোট, কাজে নেই
নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে প্রায় দেড় যুগ আগে যাত্রা শুরু হয় ১৪ দলীয় জোটের। যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আনা এবং অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ২৩ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ জোট গঠিত হয়।
ওই সময় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জোটের নেতাদের সরব উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় জোটের মধ্যে এখন দেখা দিয়েছে হতাশা। শরিকদের অভিযোগ, রাজপথে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় এখন আর জোটের প্রয়োজন দেখছে না ক্ষমতাসীন দল। এ নিয়ে শরিক নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
তারা বলছেন, আন্দোলনের সময় জোটের প্রয়োজন ছিল আওয়ামী লীগের কাছে। ওই সময় তারা কে ছোট, কে বড় তা বিচার করত না। কিন্তু টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি এখন সেই সব দিক দেখছে। তারা ছোট দল হওয়ায় শরিকদের মূল্যায়ন করছে না। জোটের কর্মকাণ্ড এখন ভার্চুয়াল বৈঠকে সীমাবদ্ধ।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় জোটের মধ্যে এখন দেখা দিয়েছে হতাশা। শরিকদের অভিযোগ, রাজপথে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় এখন আর জোটের প্রয়োজন দেখছে না ক্ষমতাসীন দল। এ নিয়ে শরিক নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে
তবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ১৪ দলীয় জোট হলো আদর্শিক প্লাটফর্ম। এর প্রয়োজন এখনো আছে। জোটের সুযোগে এমন অনেকই এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন, যারা অতীতে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারিয়েছেন।
নামে আছে ১৪ দলীয় জোট, কার্যক্রমে আছে কি— এমন প্রশ্ন রাখা হয় সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়ার কাছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে গেছে। আন্দোলনের সময় জোটের প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে। তখন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও গুরুত্ব পায়। ছোট কিংবা বড় দল নয়, সবাই তখন জোটের শরিক। কিন্তু নির্বাচনের পর, ক্ষমতা লাভের পর আর জোটের প্রয়োজন থাকে না।
‘ক্ষমতার সমীকরণে আমরা জোটের শরিক দল, ছোট দল। আমাদের ভোট নেই— এমনটি এখন বলা হচ্ছে। আসলে জোটের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা সময়ই বলে দেবে।’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। তবে এর প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর। ওই সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (প্রয়াত) আব্দুল জলিলের চেষ্টায় ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়। তৎকালীন বাম দলগুলোর ১১ দলীয় জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও ন্যাপ যোগ দেয়। নাম দেওয়া হয় ১৪ দলীয় জোট। কিন্তু এ জোটে ১১ দলীয় জোটের শরিক সিপিবি যোগ দেয়নি। ফলে এটি ছিল মূলত ১৩ দলীয় জোট।
২০০৭ সালের বাতিল হওয়া ‘২২ জানুয়ারির নির্বাচন’ ঘিরে ১৪ দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টি, এলডিপি, বিকল্পধারা ও গণফোরামকে নিয়ে নির্বাচনী মহাজোট গঠিত হয়। একই সময় ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘ফতোয়া চুক্তি’ নিয়ে ১৪ দলে টানাপোড়েন তৈরি হয়। পরবর্তীতে নির্বাচনী জোট থেকে দলগুলো বের হয়ে গেলেও ১৪ দলীয় জোট বলবৎ আছে এখনো।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বর্তমানে জোটের দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন প্রকাশ্যে আসে। গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া, জাসদ নেতা ইনু, কর্নেল তাহেরসহ সেদিন রেডিও স্টেশনে আনুগত্য প্রকাশ করতে যাওয়া সবাই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাদের চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠনের দাবি জানান শেখ সেলিম।
তার ওই বক্তব্য ‘রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক’ বলে আখ্যা দেয় শরিক জাসদ। এক বিবৃতিতে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধুর খুনিগোষ্ঠী এবং খুনিগোষ্ঠীর পাকিস্তানপন্থার রাজনীতির ধারকদের আড়ালের উদ্দেশ্যে মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। জাসদ কখনোই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করেনি।’
জোটের শরিক নেতারা বলেন, আমরা জোটগতভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলাম। ওই সময় আওয়ামী লীগ ছাড়াও শরিক দলের অনেক নেতা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ১৪ দলীয় জোটের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন ও আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি আমরা। তখন আমাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। কিন্তু এখন রাজনৈতিক মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ক্ষমতাসীন দলটি আমাদের আর মূল্যায়ন করছে না। এখন তারা বলছে আমরা ছোট দল। মহামারি মোকাবিলায় জোটগতভাবেও কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন হয়ত আওয়ামী লীগ ভাবছে, বাকি পথ তারা একাই পার হতে পারবে। জোটের আর প্রয়োজন নেই। এ কারণে কার্যকর কোনো ভূমিকা তারা নিচ্ছে না।
জোটের এ নেতা বলেন, আমরা ১৪ দলীয় জোট মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। কিন্তু আমাদের জোটের তো কোনো কর্মকাণ্ড নেই। আর দেশে তো এখন একটি রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। এটা হয়তো সবসময় থাকবে না। এ শূন্যতা একসময় অপশক্তিগুলো দখল করবে। ক্ষমতাসীন দলটি যদি রাজনৈতিকভাবে সচল এবং জনগণের মাঝে থাকতে পারত, তাহলে এ শূন্যতা তৈরি হতো না। এটা বুঝতে হবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের। কিন্তু তারা কেন বুঝতে পারছে না, সেটি-ই বুঝতে পারছি না!
দেশে ‘রাজনৈতিক শূন্যতা’ তৈরি হওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, কথাটা তারা ঠিকই বলছে। কারণ একবার বাঘ রক্তের গন্ধ পেলে, সে সবসময় রক্তই খেতে চাইবে। শুধু হরিণ খেতে চাইবে না। ১৪ দল থেকে এত মন্ত্রী বানানো হয়েছে, অথচ তাদের অনেকেই মন্ত্রিত্ব দূরের কথা কোনো নির্বাচনেই বিজয়ী হতে পারতেন না। অতীতে আমরা তা দেখেছি। এখন যিনি একদিন মন্ত্রী হয়েছেন, তাকে যদি এর উপরে ছাড়া নিচে কিছু দেওয়া হয়, তখন তো তিনি বিদ্রোহ শুরু করবেন।
‘তারা এখনো প্রশ্ন করেন, আমরা কেন মন্ত্রী হতে পারব না। এমন অনেক এমপি আছেন, তারা মনে করেন যে নিজ দল থেকে নির্বাচন করলে নির্বাচিত হতে পারবেন। কিন্তু আমরা জানি আসলে কী ফল হবে।’
শুধু কেন্দ্রে নয়, তৃণমূলেও জোটের কোনো সমন্বয় নেই— উল্লেখ করে জোটের এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর কয়েকটি উপ-নির্বাচন হয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেনি। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়েও।
তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান সমন্বয়ক (আমির হোসেন আমু) এক আলোচনায় এ দূরত্বের কথা স্বীকারও করেন। তিনি তখন বলেছিলেন, এক-একটা উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান কয়েকজন, সেক্ষেত্রে আমরা অন্যদের জায়গা কীভাবে দেব?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘১৪ দল এখন অতীত। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি অকার্যকর। এ জোটের একটা অতীত ছিল, সেই সময় ভালো কাজ হয়েছিল। এখন হচ্ছে চুরি, বাটপারি আর দুর্বৃত্তায়ন। এগুলো সরকারের প্রশ্রয়েই হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড ১৪ দলের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’
তিনি বলেন, সরকার একটা ফাঁদে আটকে গেছে। এটার জন্য নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন প্রয়োজন। সামনে কী হয়, সেটা পরিস্থিতিই বলে দেবে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদে শরিকদের ১৪ জন সংসদ সদস্য ছিলেন। একাদশ সংসদে ছিলেন আটজন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল মারা যান। উপ-নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ জোটকে আর ছাড় দেয়নি।
প্রথম দুই মেয়াদে জোটের নেতারা মন্ত্রিসভায় ছিলেন। এবার তাদের সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। জোটের মুখপাত্র প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম জীবিত থাকাকালীন নিয়মিত বৈঠক হতো। কিন্তু এখন তা শুধু ভার্চুয়ালে সীমাবদ্ধ। প্রায় দুই বছর ধরে জোটপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হয়নি কোনো বৈঠক।
১৪ দলীয় জোট হলো আদর্শিক। এর প্রয়োজন এখনো আছে। জোটের সুযোগে এমন অনেকই এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন, যারা অতীতে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারিয়েছেন— আওয়ামী লীগ
এ প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে কারণে ১৪ দলীয় জোট হয়েছে, সেটি কিন্তু এখনো বিদ্যমান। জোটের গতি মন্থর হয়েছে— এটা সত্য, তবে জোটকে সক্রিয় রাখাই বাঞ্ছনীয়।’ এ জন্য কী করা প্রয়োজন— উত্তরে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আওয়ামী লীগকে আরও সক্রিয় হওয়া উচিত। জোটের কাজের বিষয়ে মনোমালিন্য আছে— এটা ঠিক, তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।’
বিষয়টি নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করেত চাই না।’
এইউএ/এমএআর/