বাইকে ধরা, আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই গ্রাহকের!
সরকারি কর্মকর্তা তিনি। বোনের জমানো টাকা দিয়ে তিনটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে প্রায় ছয় লাখ টাকার চারটি মোটরবাইক অর্ডার দিয়েছিলেন। নির্ধারিত সময় পার হলেও পাননি কাঙ্ক্ষিত মোটরবাইক। উল্টো এখন বোনের প্রয়োজনে টাকা ফেরত দিতে পারছেন না।
চারদিকে অন্ধকার দেখা ওই ব্যক্তি (ছদ্মনাম শাকিল হাসান) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না।’
পরিচয় গোপন করে শাকিল হাসান আরও বলেন, ‘আমার বোনের অ্যাকাউন্টে চার লাখ টাকার মতো ছিল। ভগ্নিপতি বিদেশ যাবেন, সেজন্য টাকাগুলো রাখা হয়েছিল। গত জুন মাসে তিনি (ভগ্নিপতি) আমাকে সেই টাকা ব্যবহারের অনুমতি দেন। তবে তিন মাসের মধ্যে টাকাগুলো ফেরত দিতে হবে। পণ্য অর্ডার দেওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির আশায় টাকাগুলো নিয়েছিলাম। কিন্তু তিনটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পণ্য অর্ডার দিয়ে টাকা আটকে যাওয়ায় এখন তা ফেরত দিতে পারছি না। এখন ভগ্নিপতির বিদেশে যাওয়ার তারিখ চলে এসেছে। টাকাগুলো না পেলে বোনের সংসার টিকবে না। এ অবস্থায় আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না।’
চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা ও পুনঃবিক্রির জন্য মূলত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে মোটরবাইকগুলোর অর্ডার দিয়েছিলেন শাকিল।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বোনের গচ্ছিত টাকাগুলো জুন মাসে নিই। ওই মাসের মাঝামাঝি ইভ্যালিতে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে একটি মোটরবাইক (অ্যাপাচি আরটিআর ১৬০ ফোরভি) অর্ডার করি। নির্ধারিত সময়ে বাইকটি দিতে না পেরে এর বিপরীতে তারা আমাকে একটি চেক দেয়। বলে, তাদের ফোন পেলে চেকটি নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে ক্যাশ করতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের ফোন পাইনি। আদৌ চেক ক্যাশ করতে পারব কি না, তাও জানি না।
একই সময়ে ই-অরেঞ্জে এক লাখ ৪০ হাজার টাকায় ইয়ামাহা এফজেড-এস ভার্সন থ্রি অর্ডার দেন শাকিল। কিন্তু এখনও টাকা বা বাইকের হদিস কিছুই পাননি তিনি। জুনের ১৫ ও ১৭ তারিখে ই-কমার্স কিউকম.কম থেকে ইয়ামাহা আর-ওয়ান ফাইভ, ইয়ামাহা এফজেড এফআই ভার্সন টু (মোট চার লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো) অর্ডার দেন তিনি। এখানেও ধরা খান। বর্তমানে টাকা বা বাইক কোনোটি না পেয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন শাকিল হাসান।
তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে কিউকমের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফোন দিয়েছি। তাদের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়েছি। তারা সমাধান দিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব সেলস, কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন হুমায়ুন কবির নিরবকে (আরজে নিরব) কল-বার্তা দিয়েছি। কিন্তু তিনি সিন করে রেখে দেন। কোনো রিপ্লাই দেন না। প্রতিষ্ঠানটির মালিক (এমডি ও সিইও) রিপন মিয়াকে ফোন-বার্তা দিলেও রিপ্লাই দেননি। তারা প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট (মূল টাকা) ফেরত দেবে বলেছে। গুগল ফরম পূরণ করেছি। তাও কাজ হয়নি।’
‘আমার ভগ্নিপতি শিগগিরই মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাবেন। এখন তার টাকাগুলো দরকার। টাকা দিতে না পারলে আমার বোনকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আমার জন্য বোনের সংসারটা টিকবে না। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। সবার কাছে অনুরোধ, আমার রিফান্ডটা যেন দেওয়া হয়। তা না হলে আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোনো পথ থাকবে না।’
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণার শিকার এমন ভুক্তভোগী তিনজন সরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জে পণ্যের জন্য টাকা দিয়ে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আরাফাত আলী (ছদ্মনাম)। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘চলতি বছর জানুয়ারিতে ইভ্যালিতে একটি মোটরবাইক ও একটি ফ্রিজের অর্ডার দিই। বাইকটি পেয়েছি। পরে আরেকটি ফ্রিজ ও দুটি বাইকের অর্ডার দিই। সবমিলিয়ে তিন লাখ ৬৮ হাজার টাকার পণ্য। এর মধ্যে অফিসের দুজন সহকর্মী আমাকে ৯০ হাজার টাকা দেন। ইচ্ছা ছিল বাইকগুলো বিক্রি করে প্রায় দেড় লাখ টাকা মুনাফা করব। এখন লাভ-আসল সবই গেল। প্রতিনিয়ত পরিবারের লোকজন ও সহকর্মীদের কাছ থেকে মুখ লুকাতে হচ্ছে।’
শামীম নামের অপর এক ভুক্তভোগী ই-অরেঞ্জ থেকে পণ্য অর্ডার করেছিলেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব না থাকায় টাকা ফেরত পাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেছে তার।
রাজধানীর মগবাজারের গিফট শপের বিক্রয়কর্মী ওয়াহিদ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘ইভ্যালি থেকে নয় লাখ টাকার পণ্যের অর্ডার দিই। টাকা পাওয়ার আর কোনো পথ দেখছি না। এখন আমাদের দাবি, ইভ্যালির প্রধান রাসেল ভাইকে জামিন দেওয়া হোক। তাকে জামিন না দিলে আমরা টাকা ফেরত পাব না। আত্মীয়-স্বজন অনেকের কাছ থেকে ধারে টাকা নিয়েছি। তাদের কাছ থেকে নিয়মিত সময় নিচ্ছি। শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।’
বর্তমানে ই-অরেঞ্জের কাছে গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের পাওনা ১১০০ কোটি টাকা। ইভ্যালির কাছে পাওনা ৯৫০ কোটি, ধামাকার কাছে ৮০৩ কোটি, এসপিসি ওয়ার্ল্ডের কাছে ১৫০ কোটি এবং নিরাপদ ডটকমের কাছে পাওনা আট কোটি টাকা
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গ্রাহকদের যত পাওনা
বাংলাদেশ ব্যাংক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ই-অরেঞ্জের কাছে গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের পাওনা ১১০০ কোটি টাকা। ইভ্যালির কাছে পাওনা ৯৫০ কোটি, ধামাকার কাছে ৮০৩ কোটি, এসপিসি ওয়ার্ল্ডের কাছে ১৫০ কোটি এবং নিরাপদ ডটকমের কাছে পাওনা আট কোটি টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির জমা দেওয়া সম্পদের হিসাবে বলা হয়েছে, দায়ের বিপরীতে তাদের চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। মোট ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এগুলো হচ্ছে তাদের স্থাবর সম্পত্তি। তবে ইভ্যালি নিজেদের ব্র্যান্ড মূল্য ৪২৩ কোটি টাকা বলে দাবি করেছে। এছাড়া সম্প্রতি ইভ্যালির সম্পদ বিক্রি ও হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন হাইকোর্ট।
বর্তমানে ই-অরেঞ্জ ও ধামাকার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য জানা যায়নি। এ কারণে প্রতিষ্ঠান দুটির কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে অনেকটা সংশয়ে আছেন গ্রাহকরা। একই অবস্থা এসপিসি ওয়ার্ল্ড ও নিরাপদ ডটকমের ক্ষেত্রেও।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম তদন্তে সিআইডি
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি বর্তমানে মোট ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে। বেশির ভাগের বিরুদ্ধে গ্রাহককে পণ্য ও টাকা ফেরত না দেওয়া, চেক দিলেও ব্যাংকে টাকা না থাকা এবং পণ্য সরবরাহকারীদের টাকা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোট আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিআইডির ছায়া তদন্ত চলমান। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুমবুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডি।
এছাড়া ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হবে— বলেন সিআইডির ওই কর্মকর্তা।
এআর/জেডএস/এমএআর/