কক্সবাজারের উন্নয়নে কারও নোংরামি পাত্তা দিচ্ছি না
বিশ্বব্যাপী পর্যটন খাতকে যুগোপযোগী ও পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ লক্ষণীয়। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। আমাদের রয়েছে সম্ভাবনাময় অসংখ্য পর্যটন স্পট। রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। কক্সবাজারকে আরও আকর্ষণীয়, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের ‘এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট স্পট’ হিসেবে গড়ে তুলতে নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছে বর্তমান সরকার। গঠন করা হয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। এ খাতে আকর্ষণ বাড়াতে ২০১৬ সালকে পর্যটনবর্ষ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়।
২০১৬ সালের ১১ আগস্ট কউক’র চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ। কউক’র পাশাপাশি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কমিটির সভাপতিও তিনি। কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের বিকাশ, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে মুখোমুখি হন ঢাকা পোস্টের। বলেন, ‘আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কক্সবাজারকে গড়তে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এসব করতে গিয়ে অনেকের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এখনও অনেকে বাধা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে, আমরা এগুলোকে সমস্যা মনে করছি না। কোনো নোংরামিকে পাত্তা দিচ্ছি না। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজারকে আমরা গড়ে তুলবই।’
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন ও আদনান রহমান।
ঢাকা পোস্ট : দুই বছর আগে কক্সবাজার ঘিরে মাস্টার প্ল্যান তৈরির কথা বলেছিলেন। সেখানে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে নান্দনিক ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে কক্সবাজারকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই মাস্টার প্ল্যানের অগ্রগতি এবং এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে যদি বলতেন...
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে একটি আধুনিক ও ট্যুরিস্টবান্ধব নগরী হিসেবে কক্সবাজারকে গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছেন। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজন একটি মহাপরিকল্পনা অর্থাৎ মাস্টার প্ল্যান। প্রথমে আমরা কক্সবাজার জেলার কিছু অংশ নিয়ে মাস্টার প্ল্যানের প্রস্তুতি শুরু করি। পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পুরো কক্সবাজার ঘিরে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কক্সবাজারে মোট আটটি উপজেলা রয়েছে। এসব উপজেলার চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে মিটিং করে এরিয়া নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া আমরা বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠন করি। কয়েকবার মিটিং ও সরেজমিন পরিদর্শন শেষে আমরা ৬৯০.৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন শেষে তা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। গত ১০ জুন আমরা এর প্রশাসনিক অনুমোদন পাই।
ঢাকা পোস্ট : মাস্টার প্ল্যানে কী থাকছে?
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : কক্সবাজারের কোথায় কী হবে, তার সবই থাকছে মাস্টার প্ল্যানে। কোথায় ট্যুরিস্ট জোন হবে, কোথায় হোটেল-রিসোর্ট ও রেস্ট হাউজ হবে, কোথায় হাসপাতাল ও হাউজিং হবে, কোথায় চলাচল সীমিত থাকবে, জীববৈচিত্র্য রক্ষার জোন কোথায় হবে অর্থাৎ কোথায়, কী হবে তার ডিটেল (বিস্তারিত) উল্লেখ থাকছে মাস্টার প্ল্যানে। সেখানে ট্যুরিস্টবান্ধব সবকিছুই থাকছে।
পর্যটনের জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন ও পর্যটন বোর্ড আছে। কোথায়, কী থাকবে এবং কী হবে— সবকিছু তাদের পরামর্শ আমলে নিয়ে করা হচ্ছে।
বিদেশি ট্যুরিস্টদের জন্য আলাদা জোন হবে। এটি (জোনিং) আমরা শক্তভাবে করব এবং কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে। বিদেশি ট্যুরিস্টদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকবে। তাদের জন্য পৃথক সার্ফিং ব্যবস্থা থাকবে, থাকবে সার্ফ ট্রেনিং সেন্টারও।
ঢাকা পোস্ট : মাস্টার প্ল্যানে কি জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে?
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : কক্সবাজারকে একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা’ শীর্ষক ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু প্রথম বছরই জনগণের মতামত ও পরামর্শ জানতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যেহেতু জনগণের মতামত নিয়ে মাস্টার প্ল্যান তৈরি হচ্ছে, সেহেতু এতে অবশ্যই জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
এটি (মাস্টার প্ল্যান) তৈরি করতে দুই বছর সময় লাগবে। গত এপ্রিল থেকে মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে। কারা এটি (মাস্টার প্ল্যান) বাস্তবায়ন করবে, এ জন্যও একটি পদ্ধতি আছে। সেটি হচ্ছে সিঙ্গেল চিপ সিস্টেম (এসএসএস)। এটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দিয়ে করা হবে। মাস্টার প্ল্যানের ৯৫ শতাংশ কাজই বাস্তবায়ন করবে তারা।
ঢাকা পোস্ট : মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হবে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। এ বিষয়ে আপনাদের উদ্যোগ কেমন হবে?
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে কউক’র ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান আছে। এটি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এখানে কোনো ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা মাস্টার প্ল্যানের বিষয়গুলো নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। যাতে নিজের মতো করে অর্থাৎ অপরিকল্পিতভাবে কেউ কোনো কিছু করতে না পারে। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি বড় সফলতা হচ্ছে, এটি এখন বন্ধ হয়েছে।
যদিও কক্সবাজারে অপরিকল্পিতভাবে অনেক কিছু হয়ে গেছে। আমি দুই বছর আগে যেভাবে পরিকল্পিত নগরী গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম, আমরা যদি ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান না করতাম, তাহলে কক্সবাজারের পরিবেশ আরও নষ্ট হয়ে যেত।
ঢাকা পোস্ট : কক্সবাজার বদলানোর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। কক্সাবাজারকে বাঁচাতে হলে, এ জেলাকে দেশীয় ট্যুরিস্টদের জন্য আকর্ষণীয় করতে হলে এবং বিদেশিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হলে স্থানীয়দের সর্বাত্মক সহযোগিতা দরকার। দুই বছরের মধ্যে আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছে যাব।
ঢাকা পোস্ট : মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে কি না?
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। নতুন যেকোনো প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে বাধা তো আসবেই। বাধা এসেছেও। এগুলো মাড়িয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এখনও কেউ কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আমার অফিস ছিল না, সেটি হয়েছে। জনবল ছিল না, জনবল পেয়েছি; আরও পাব। জনবলের বিধিবিধান ছিল না, সেটি করেছি। আমাদের ইক্যুইপমেন্ট ছিল না, সেগুলো পেয়েছি। আমরা কক্সবাজার শহরে বেশকিছু নান্দনিক কাজ করেছি। ঐতিহ্যবাহী পুকুর লালদিঘি, গোলদিঘি ও বাজারঘাটা পুকুর পুনর্বাসনসহ ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছি।
শহরে আমরা বেশকিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করেছি। রূপচাঁদা মাছ, ঐতিহ্যবাহী সাম্পান, স্টার ফিশ, ঝিনুক ও বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য-সম্বলিত টেরাকোটা তৈরি করেছি। চারটি ১৩তলা বিশিষ্ট হাউজিং কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে, যেখানে ৩৪০টি ফ্ল্যাট থাকবে। ইতোমধ্যে ৪/৫ তলা হয়ে গেছে। কক্সবাজারের মেইন যে রুট, সেটির সংস্কার ও পুনঃ উন্নয়নের কাজ চলছে। এছাড়া মেরিন ড্রাইভ ও কক্সবাজার শহরকে আলোকায়নের আওতায় আনা হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘কউক’ কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে বলে মনে করেন?
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : আমাদের পরিকল্পনা অনেক। এগুলো বাস্তবায়নে আমরা প্রথমে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছি। ‘কউক’ কী চায়— এটি জানাতে আমরা প্রথমে অর্ধশতাধিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করেছি। এসব করতে গিয়ে অনেকের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছি। আসলে যাদের স্বার্থে আঘাত হানছে বা নিজের মতো করে কিছু করতে পারছেন না, তারাই বিরোধিতা করছেন। এখনও অনেকে বাধা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে, আমরা এগুলোকে সমস্যা মনে করছি না। কোনো নোংরামিকে পাত্তা দিচ্ছি না। সবকিছু আমরা উতরায়ে এসেছি।
‘কউক’ নতুন হলেও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটি চলবে নিজের আয়ে। যদিও সে সক্ষমতা এখনও আমাদের হয়নি। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে সেটিও হয়ে যাবে।
ঢাকা পোস্ট : কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কোন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে কউক?
লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ : করোনার শুরুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন, সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। এরপর আমরা লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ, সামুদ্রিক লতাপাতার জন্য বিশেষ জোন করেছি। সেখানে চলাফেরা সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার বিষয়, তিনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের সেসব উদ্যোগ ম্লান করে দিয়েছে। আমরা গড়ি, আর দুর্যোগে সব ভেসে যায়। তবে আমরা ভাগ্যবান যে, দুর্যোগ সত্ত্বেও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ফের ফিরে আসে। এটির যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। আমরা সেটি করে যাচ্ছি।
করোনা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। হয়ত একটু সময় লাগবে। তবে আশা করছি, বিন্দু থেকে শুরু হওয়া কউক’র সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজারকে আমরা গড়ে তুলবই।
জেইউ/এআর/এমএআর/