পণ্য দিচ্ছে না রিফান্ডেও না, উল্টো ‘ব্লক’ মারে আদিয়ান মার্ট
সর্বোচ্চ ৪৫ দিনে ‘গ্যারান্টি’ ডেলিভারির কথা বললেও চলে যায় মাসের পর মাস। পাওয়া যায় না পণ্য। ব্যাখ্যা চাইতে গেলে ফোন ধরে না কাস্টমার কেয়ারের নম্বরগুলো। টাকা চাইলে ‘দেব, দিচ্ছি’ বলে ঘোরানো হয়। ফেসবুক পেজ থেকে ব্লক করা হয়। পুরোনো অর্ডারের পণ্য না দিয়ে আবারও হরেকরকম অফার দিচ্ছে ই-কমার্স সাইট আদিয়ান মার্ট (adyanmart.com.bd)।
অল্প দামে স্মার্টফোন বিক্রির জন্য পরিচিতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে স্মার্টফোন তো দূরের কথা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের গ্যালনের ডেলিভারি (পণ্য হস্তান্তর) ৯০ দিনেও দিতে পারছে না আদিয়ান মার্ট। ইতোমধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশেও (ই-ক্যাব) তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে এখনও পণ্য কিংবা টাকা ফেরত পাননি হাজারও গ্রাহক।
৪৫ কার্যদিবসের স্মার্টফোন মেলেনি ২৩০ দিনেও
২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর বাগেরহাটের মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম খান একটি আইটেল ভিশন ওয়ান প্লাস স্মার্টফোন অর্ডার করেছিলেন আদিয়ান মার্টে। স্মার্টফোনটি ৪৫ দিনে ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। তবে ১৫৭ কার্যদিবস (২৩০ দিন) পার হলেও পাওয়া যায়নি ফোনটি।
এমদাদুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত তিন মাস ধরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তাদের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়েছি। ফেসবুক পেজে মেসেজ দিয়েছি, ই-মেইল করেছি। কোনো কাজ হয়নি। সর্বশেষ সপ্তাহখানেক আগে আমাকে রিফান্ড (টাকা ফেরত) দেবে বলে জানানো হয়। এরপর আর যোগাযোগ করেনি তারা।
কুমিল্লার খালেদ মাহমুদ ২০২০ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে মোট এক লাখ ৩৬ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দেন আদিয়ান মার্টে। পণ্যগুলোর মধ্যে ছয়টি স্মার্টফোন ও রূপচাঁদা সয়াবিন তেলের গ্যালন ছিল। মে ও জুন মাসের মধ্যে (৪৫ কার্যদিবস) পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার কথা। কিন্তু জুলাই মাসের ২৫ তারিখেও তিনি পণ্য কিংবা টাকা ফেরত পাননি। পরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ই-ক্যাবে অভিযোগ করেন খালেদ। অভিযোগগুলো এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে।
ঢাকা পোস্টকে ভুক্তভোগী খালেদ বলেন, রূপচাঁদা সয়াবিন তেল ১৫ দিনে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৯০ দিন পার হলেও পাইনি। এছাড়া অর্ডার দেওয়া স্মার্টফোনগুলো ৪৫ কার্যদিবসেও হাতে আসেনি। দুটি স্মার্টফোন অর্ডার দেওয়ার ১২০ দিন, দুটি ১৩০ দিন এবং দুটির ১৬০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এখনও তারা পণ্য দেয়নি, রিফান্ডের বিষয়েও কিছু জানায়নি। গত ৫ জুলাই আমি ভোক্তা অধিকার ও ই-ক্যাবে অভিযোগ জানাই।
উজ্জ্বল কুমার হাওলাদার নামের আরেক ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মে মাসে ডিসকাউন্ট অফারে (ছাড়ে পণ্য কেনার সুযোগ) চার হাজার ৩৫৩ টাকার চাল ও তেলের অর্ডার করেছিলাম। ১৫ দিনে ডেলিভারি দেওয়ার কথা কিন্তু দুই মাসেও পাইনি। সর্বশেষ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমাকে জানানো হয়, ‘স্যার আপনি অর্ডারটি পেয়ে গেছেন’। অথচ ২৫ জুলাই পর্যন্ত আমি পণ্য পাইনি।
ভুক্তভোগী সাজ্জাদুর রহমান বলেন, চার মাস আগে ২০টি ওয়ালটন ফিচার ফোন অর্ডার করেছিলাম। গত ১২০ দিনে তাদের ১০০ বারের ওপরে কল দিয়েছি, ই-মেইল করেছি, রিপোর্ট ইস্যু করেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তারা শুধু বলে, কিছুদিনের মধ্যে পেয়ে যাবেন। সর্বশেষ দুই মাস আগে আমাকে অ্যাপে মেসেজ দিয়েছিল, ‘স্যার, চিন্তিত হবেন না। চেষ্টা চলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার অর্ডারটির ডেলিভারি সম্পন্ন করার। অনুগ্রহ করে আদিয়ানের সাথেই থাকুন।’ ২৪ জুলাই পর্যন্ত পাইনি ফোনগুলো।
শর্ত ভেঙে টাকা ফেরত, বেশি কথা বললে ফেসবুক পেজে ‘ব্যান’
আদিয়ান মার্টের পণ্য বিক্রির অন্যতম শর্ত হলো, কোনো পণ্যের স্টক (মজুত) যদি শেষ হয়ে যায় বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে ক্রেতাকে বাজারমূল্যের (এমআরপি- সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) সমপরিমাণ অর্থ ফেরত দেবে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ কোনো ক্রেতা যদি ১০০ টাকার পণ্য ডিসকাউন্টে ৭০ টাকায় কেনেন এবং আদিয়ান মার্ট যদি সেই পণ্য দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে ক্রেতাকে ১০০ টাকাই ফেরত দেবে। কিন্তু মাসের পর মাস আটকে রেখে, এমনকি ডিসকাউন্টের টাকা কেটে রেখে ক্রেতাদের ইচ্ছা মতো টাকা ফেরত দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
বারবার মেসেজ দিলে তারা আমাকে ফেসবুক পেজ থেকে ব্যান (নিষিদ্ধ) করে দেয়। পরে আমি ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দিই। এরপর তারা আমাকে টিভির টাকা ফেরত দেয়। শর্ত অনুযায়ী আমাকে এমআরপি মূল্য রিফান্ড করার কথা কিন্তু আমাকে ডিসকাউন্টেড মূল্যটা ফেরত দিয়েছেচট্টগ্রামের ক্রেতা মো. জামাল
চট্টগ্রামের ক্রেতা মো. জামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এপ্রিল মাসের ৫ তারিখে চারটি রাইস কুকার ও ওয়ালটনের ৪৩ ইঞ্চির একটি স্মার্ট টিভির অর্ডার দিই। এগুলো ২১ কর্যদিবসে ডেলিভারি দেওয়ার কথা। তিন মাসের মধ্যে তারা তিনটি রাইস কুকার দিতে পেরেছে। বাকি একটি রাইস কুকার ও স্মার্ট টিভি এখনও দিতে পারেনি। বারবার মেসেজ দিলে তারা আমাকে ফেসবুক পেজ থেকে ব্যান (নিষিদ্ধ) করে দেয়। পরে আমি ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দিই। এরপর তারা আমাকে টিভির টাকা ফেরত দেয়। শর্ত অনুযায়ী আমাকে এমআরপি মূল্য রিফান্ড করার কথা কিন্তু আমাকে ডিসকাউন্টেড মূল্যটিই দেয়।
বিকাশ ও ১০ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আদিয়ান মার্ট
সন্দেহজনক লেনদেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অমান্য করা এবং গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে আদিয়ান মার্ট থেকে গ্রাহকদের কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ১০ ব্যাংক ও পেমেন্ট গেটওয়ে বিকাশ। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা তাদের ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ড দিয়ে এই ই-কমার্স সাইটে পণ্যের অর্ডার দিতে পারবেন না।
এছাড়া বিকাশ ওয়ালেট থেকেও আদিয়ানের পেমেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-কমার্সের ক্ষেত্রে রেগুলেটর প্রদত্ত পেমেন্ট বিষয়ক নীতিমালাগুলো কার্যকর করতে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। গ্রাহকদের স্বার্থেই আদিয়ান মার্টসহ কিছু মার্চেন্টের জন্য বিকাশের পেমেন্ট গেটওয়ে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
শো-কজ দিয়েছে ই-ক্যাব, বাতিল হতে পারে সদস্যপদ
আদিয়ান মার্টের বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আটকে রাখা, সময়মতো পণ্য ডেলিভারি না দেওয়া এবং ই-কমার্স ব্যবসার শর্তভঙ্গ ও নীতিমালা লঙ্ঘনসহ অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ই-ক্যাব)। অভিযোগের বিষয়গুলো উল্লেখ করে গত ১৭ জুলাই তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ (শো-কজ নোটিশ) দিয়েছে ই-ক্যাব। গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে না পারলে বাতিল হতে পারে তাদের সদস্যপদ।
ই-ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদিয়ান মার্টসহ যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ কেন স্থগিত করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। উপযুক্ত উত্তর না মিললে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ভোক্তায় অর্ধশতাধিক অভিযোগ, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে অধিদফতরে বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটের ডেলিভারি ও প্রতারণার প্রায় হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ অভিযোগই ইভ্যালির বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে ই-কমার্স সাইটগুলোর বিরুদ্ধে ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির অসংখ্য অভিযোগ আসছে। আদিয়ান মার্টের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে। অধিকাংশ অভিযোগই নিত্যপণ্য বিক্রির পর সেগুলো ডেলিভারি না দেওয়ার। এসব বিষয়ে শুনানি চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বেশ কয়েকটি ই-কমার্স সাইটের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে কাজ করছি। আদিয়ান মার্টের বিষয়ে কেউ অভিযোগ দিলে তাদের বিষয়গুলোও আমরা তদন্ত করে দেখব।
অভিযোগ পেলেই সমাধানের চেষ্টা করি : আদিয়ান মার্টের সিইও
সময়মতো পণ্য ডেলিভারি ও শর্তানুযায়ী টাকা ফেরত না দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় আদিয়ান মার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জুবায়ের সিদ্দিকীর সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো ক্যাম্পেইনে অর্ডার অনেক বেশি হয়ে যায়। সেলার (বিক্রয়কারী) থেকেও অনেক সময় পণ্য বিলম্বে পাওয়া যায়। অনেক সময় নানা কারিগরি ত্রুটির কারণে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া যায় না। তখন কাস্টমাররা আমাদের মেইলে বিষয়টি জানান। মেইল পেলে আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করি।’
‘তারপরও আপনার কাছে কোনো স্পেসিফিক (নির্দিষ্ট) অর্ডার নম্বর থাকলে হোয়াটসঅ্যাপে দিতে পারেন। সমাধানের চেষ্টা করব।’
এআর/একে/এমএআর