গল্পগুলো ভয়ংকর, মামলা হলেও বিচার মন্থর!
শুধু কক্সবাজারের যুবক মো. জামাল নন, তার মতো আরও অনেক ভুক্তভোগী আছেন। সাগরপথে স্বপ্নের মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিয়ে শিকার হয়েছেন নির্মম নির্যাতনের। কারও কারও স্থান হয়েছে গণকবরে। তারপরও থেমে নেই সাগরপথে স্বপ্নের যাত্রা!
কিন্তু কেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ সাগরপথ বেছে নিচ্ছেন। এ পথে গেলে খরচও কম। ভুক্তভোগী অনেকে আবার আইনের আশ্রয় নিতে চান না। আইনের আশ্রয় নিলেও ঝুলে যায় বিচারের প্রক্রিয়া! অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবপাচার রোধে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। কারণ, ভুক্তভোগীরা হন নিম্ন শ্রেণির। তাদের রয়েছে সচেতনতার অভাব। অন্যদিকে, স্থানীয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা রয়েছেন মানবপাচারকারীদের পেছনে। সরকার যদি সত্যি সত্যি মানবপাচার রোধ করতে চায় তাহলে জঙ্গি দমনে যেভাবে পরিকল্পনা ও শক্তি প্রয়োগ করেছিল, একই ধরনের তৎপরতা দেখাতে হবে এ ক্ষেত্রেও।
ভুক্তভোগীদের গল্পগুলো আসলেই ভয়ংকর
টেকনাফের উনচি প্রাং তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাসেল আহমেদ (ছদ্মনাম)। স্থানীয় রোহিঙ্গা এক দালালের মাধ্যমে স্বজন ও বন্ধুবান্ধব মিলে এলাকার ১৭ জন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে পৌঁছানও। কিন্তু থাকতে না পেরে ফিরে আসেন বাংলাদেশে।
মানবপাচার রোধে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। কারণ, ভুক্তভোগীরা হন নিম্ন শ্রেণির। তাদের রয়েছে সচেতনতার অভাব। অন্যদিকে, স্থানীয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা রয়েছেন মানবপাচারকারীদের পেছনে। সরকার যদি সত্যি সত্যি মানবপাচার রোধ করতে চায় তাহলে জঙ্গি দমনে যেভাবে পরিকল্পনা ও শক্তি প্রয়োগ করেছিল, একই ধরনের তৎপরতা দেখাতে হবে এ ক্ষেত্রেও
মালয়েশিয়া যাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে রাসেল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রোহিঙ্গা ওই দালাল প্রথমে টেকনাফ হয়ে মাঝ সাগরে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা দালালদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা আমাদের ট্রলারে ওঠায়। ওই যে ট্রলারে উঠলাম, নামার কোনো নামগন্ধ নাই! সাগরেই কেটে যায় দেড় মাস।
‘দেড় মাস সাগরে থাকার পর একসময় খাবারের অভাবে জীবন সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। তীব্র পানির পিপাসায় যখন চিৎকার করতাম তখন দালালরা পানির বোতল ছিদ্র করে চাপ দিয়ে একটু একটু করে পানি খেতে দিত।’
তিনি বলেন, টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দালালরা প্রথমে কোনো খরচ নেয়নি। বিনা খরচে মালয়েশিয়ার ট্রলারে বসায়। দেড় মাস পর ট্রলারটি মালয়েশিয়া সীমান্তের গহীন জঙ্গলের কাছে ভেড়ে। সেখানে ট্রলার থেকে নামিয়ে আমাদের জিম্মি করা হয়। টাকার জন্য শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। আমি টাকা পাঠানোর জন্য বাবার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলি। প্রথমে তারা এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দিতে বললেও পরে দাবি করে আড়াই লাখ। সুদে ও ধারে বিকাশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের টাকা পাঠান বাবা। এরপর আমাকে মালয়েশিয়ার দালালদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
রাসেল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তারা আমাকে শহরে নিয়ে যায়। সেখানে নয় মাস কাজ করি। কিন্তু অবৈধ অভিবাসী হওয়ায় কাজ করলেও টাকা দিত না। পরে এক অভিযানে দেশটির পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করে। দেশে পাঠিয়ে দেয়।’ তবে, ১৭ জনের মধ্যে আমরা যারা গ্রেফতার হই, কেবল তারাই দেশে ফিরতে পারেন। বাকিদের আর কোনো খোঁজ নেই।’
নুডলসের এক প্যাকেট আর এক গ্লাস পানি ছিল সারাদিনের খাবার
সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার দুর্বিষহ স্মৃতির বর্ণনা দেন কক্সবাজারের উনচি প্রাংয়ের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা তাপস কুমার (ছদ্মনাম)। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনের এক দালালের মাধ্যমে কক্সবাজার থেকে সিএনজিতে প্রথমে টেকনাফে যাই। সেখান থেকে আরেকটি সিএনজিতে আইগ্গাখালি, এরপর তোলা হয় ছোট বোটে। একদিন বোটে থাকার পর নেওয়া হয় বড় ট্রলারে। ওই ট্রলার দিয়েই মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হই। ট্রলারে আমার মতো শতাধিক মানুষ ছিল। দিনে একবার খাবার দেওয়া হতো। খাবারের মেনুতে (খাবারের তালিকা) ছিল এক প্যাকেট ম্যাগি নুডলস আর এক গ্লাস পানি।
‘ট্রলার থেকে আমাদের নামানো হয় থাইল্যান্ডের পাহাড়ে। সেখানকার জঙ্গলে রাখা হয় ২৪ ঘণ্টা। এরপর কয়েক ঘণ্টা হাঁটিয়ে আমাদের মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়। হাঁটতে হাঁটতে আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ি। খাবার ও পানির কারণে আমার ডায়রিয়া শুরু হয়। শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছাতেই জিম্মি করা হয় আমাদের।’
তাপস বলেন, সেখানে আইয়ুব নামের এক দালাল জানায়, টাকা না দিলে মালয়েশিয়া পাঠানো হবে না। আমাদের নিয়মিত মারধর ও নির্যাতন করা হতো। একপর্যায়ে বাড়িতে ফোন করে তাদের লাখ খানেক টাকা দিই। টাকা পাওয়ার পর তারা আমাদের মালয়েশিয়া পাঠায়।
মালয়েশিয়া যাওয়ার পর বিক্রয়কর্মী হিসেবে এক দোকানে কাজ শুরু করি। কিছুদিন সেখানে কাটানোর পর বড় একটি দোকানে কাজ নিই। প্রতি মাসে আমাকে ১৫০০ রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০-৩২ হাজার টাকা) দেওয়া হতো। বাড়িতে তখন ১৫ হাজার টাকা করে পাঠাতাম। ভালোই চলছিল সবকিছু।
কিন্তু সুখ যেন বেশি দিন সইল না। তাপস বলেন, ‘২০১৭ সালে পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ি। শত শত মানুষের (অবৈধ অভিবাসী) সঙ্গে আমাকেও শরণার্থী ক্যাম্পে রাখা হয়। কিছুদিন পর আদালতে তোলা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় কুয়ালালামপুর জেলে। এক মাস তিন দিন সেখানে থাকার পর অবশেষে বাংলাদেশে ফিরি। গ্রেফতারের সময় পরনে ছিল হাফ-প্যান্ট আর গেঞ্জি। ওই কাপড়েই দেশে ফিরতে হয়।
সবকিছু জেনেশুনে কেন সাগরে ভাসলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথমে লোভ সামলাতে পরিনি। পরে নিজের ওপর খুব রাগ হতো। ট্রলারে ওঠার পর আসলে ফেরার কোনো পথ ছিল না। তারা (দালাল ও পাচারকারী) ছিল সশস্ত্র। যারাই কান্নাকাটি করতো, তাদের মারধর করা হতো। যশোরের একজন বেশি কান্না করায় গুলি করে তাকে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
‘পাহাড়ে থাকা অবস্থায় প্রচুর বৃষ্টি হতো। সারাদিন খাওয়া নেই, উল্টো রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে খুবই দুর্বিষহ সময় পার করতে হয়েছে। নিজের ওপর খুবই রাগ হতো, কিন্তু ফেরার কোনো পথ ছিল না। টাকা যাক কিন্তু শেষমেশ নিজ দেশে ফিরতে পেরেছি, এটাই সৌভাগ্য।’
হাসিঠাট্টার ছলে মালয়েশিয়ায় যাত্রা, দুঃস্বপ্ন নিয়ে ফেরা
‘অবৈধপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার দুঃস্বপ্ন যেন কেউ না দেখে’— ঢাকা পোস্টের কাছে এমন মন্তব্য করেন আরেক ভুক্তভোগী কক্সবাজারের আল-আমিন (ছদ্মনাম)। হাসিঠাট্টার ছলে কয়েকজন বন্ধু মিলে সাগরপথ পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহস দেখান। সুখস্মৃতির পরিবর্তে ভয়াল দিনের দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়ান তিনি।
তিনি বলেন, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের এক দালালের মাধ্যমে চার বন্ধু মিলে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। মাত্র ১০ হাজার টাকায় আমাদের সেখানে পাঠানো হবে বলে জানানো হয়। আমরাও রাজি হয়ে যাই। মনে হয়েছিল, অজানার পথে দুঃসাহসিক এক অভিযাত্রায় আমরা। ট্রলারে ওঠার আগে খাওয়ার জন্য এক কার্টন আপেল, চিড়া, গুড় আর পানি সঙ্গে নিই।
সাগরপথের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে আল-আমিন বলেন, প্রথমে ছোট একটি ট্রলারে ওঠানো হয় আমাদের। এরপর মাঝসমুদ্রে বড় মাছ ধরার শিপে (জাহাজ) ওঠানো হয়। সেখানে আমাদের মতো আরও ২৫০ মানুষ (অভিবাসী) ছিল। সবারই লক্ষ্য মালয়েশিয়া যাওয়া।
‘পাঁচ দিন আর পাঁচ রাত সমুদ্রে থাকতে হয়। এরপর আমাদের নেওয়া হয় থাইল্যান্ডের একটি দ্বীপে। সেখান থেকে গাড়িতে ৩/৪ ঘণ্টা যাত্রার পর নেওয়া হয় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া নির্জন এক পাহাড়ে। সেখানে আমাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। যারা টাকা দিতে পারে, তাদের মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। যারা পারেনি তাদের কাউকে কাউকে মেরে ফেলা হয়। কাউকে আবার বিক্রি করে দেওয়া হয় মালয়েশিয়ার দালালদের কাছে। আমি বাড়িতে কথা বলে লাখ খানেক টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছাই।’
যাত্রাপথের ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, অনেকের নানা ধরনের সমস্যা হতো। কেউ কিছু বললে বা চিৎকার করলে তাকে মারধর করা হতো। পরে শিপে থাকা বাক্সে আটকে রাখা হতো।’
২০১৫ সালে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তের গহীন জঙ্গলে প্রথম গণকবরের সন্ধান মেলে। পরবর্তীতে পাঁচশরও বেশি গণকবর পাওয়া যায় সেখানে। উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকজন অভিবাসীকে। মানবপাচার রোধে দেশ দুটির ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপরই শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। অভিযানে নামে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও
টাকা দেওয়ার পর তারা আমাকে মালয়েশিয়া পাঠায়। সেখানে অনলাইন ক্যাসিনোর এক অফিসে চাকরি নিই। নয় মাস কাজ করার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। পরে আমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার জঙ্গলে গণকবর, নড়েচড়ে বসে প্রশাসন
২০১৫ সালে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তের গহীন জঙ্গলে প্রথম গণকবরের সন্ধান মেলে। পরবর্তীতে পাঁচশরও বেশি গণকবর পাওয়া যায় সেখানে। উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকজন অভিবাসীকে। মানবপাচার রোধে দেশ দুটির ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপরই শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। অভিযানে নামে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার লাংকাউয়িতে ২০২ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে গ্রেফতার করে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর লাংকাউয়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি হামজাহ জয়নুদ্দিন জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কক্সবাজারের মানবপাচারকারীদের মধ্যস্থতায় তিন লাখ টাকার বিনিময়ে নৌকায় করে মালয়েশিয়ায় আসছেন রোহিঙ্গারা। প্রথমে বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত মানবপাচার সিন্ডিকেটের হাতে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে নৌকায় করে সাগরপথে পাড়ি জমান তারা। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা দিলে তাদেরকে আত্মীয়-স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২০২০ সালের শুরুতে বাংলাদেশ সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা মানবপাচারের পৃষ্ঠপোষক ও মূল হোতাদের তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকায় কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমানের নাম উঠে আসে। ইয়াবা কারবারি হিসেবেও তার নাম আসে। মানবপাচারের তালিকায় শুধু কক্সবাজারেরই ১০১ জনের নাম পাওয়া যায়
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে ইতোমধ্যে শরণার্থী পরিবারগুলোর সফল প্রবেশ ঘটেছে। এ কারণে তাদের (রোহিঙ্গা শরণার্থী) প্রবেশ আরও বেড়েছে। গ্রেফতারদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তাদের পরিবারের অনেক সদস্য দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে, আবার অনেকের স্বামী এখানে অবস্থানের কারণে তারাও (রোহিঙ্গা নারী) এ দেশে প্রবেশ করছে।
‘এটাই শেষ নয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আরও অনেক গ্রুপ প্রবেশ করতে পারে বলে আমরা গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পেরেছি। এটি থেকে উত্তরণের উপায় বের করা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে’— বলেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিভিন্ন সময় পাচারকারীদের গ্রেফতারের পর জানায়, সমুদ্রপথে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের পাচারের প্রধান পথ কক্সবাজার। দালালরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রার্থীদের নিয়ে আসে কক্সবাজারে। এরপর তাদের ছোট ছোট ট্রলার অথবা বড় শিপিং বোটে তুলে দেওয়া হয়। পাচারকারীরা তাদের থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তের গভীর জঙ্গলে তৈরি করা গোপন বন্দিশিবিরে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ পেলে মেলে মুক্তি, না পেলে চলে নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের মুখে কেউ কেউ মারাও যান। তাদের স্থান হয় গণকবরে।
মানবপাচারের নেপথ্যে যারা
২০২০ সালের শুরুতে বাংলাদেশ সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা মানবপাচারের পৃষ্ঠপোষক ও মূল হোতাদের তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকায় কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমানের নাম উঠে আসে। ইয়াবা কারবারি হিসেবেও তার নাম আসে। মানবপাচারের তালিকায় শুধু কক্সবাজারেরই ১০১ জনের নাম পাওয়া যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২০ সাল) মানবপাচার আইনে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ৪১১টির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৫টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। সেই মামলায় ‘অন্যান্য মেয়াদে’ সাজা দেওয়া হয়েছে এক আসামিকে। কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন হয়নি। আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন ৪৩ জন
ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারে মানবপাচারের পৃষ্ঠপোষক ও মূল হোতা রয়েছেন ২২ জন। সাবেক এমপি বদির ভাই মুজিবুর ছাড়াও রয়েছেন শাহপরীর দ্বীপের বেলাল উদ্দিন, মো. ইউনূছ, ইসমাঈল, জিয়াবুল ও ফিরোজ আহমদ; শাহপরী দ্বীপের ডাঙ্গরপাড়ার মো. হাসেম ওরফে পোয়া মাঝি, দেলোয়ার, সাহাব মিয়া; মিস্ত্রিপাড়ার শরীফ হোসেন, শরীফ হোসেন ভুলু, সেলিম ওরফে লম্বা সেলিম, আয়াছ, সৈয়দ; উখিয়ার সোনাপাড়ার জালাল উদ্দিন; সোনাপাড়ার রেজিয়া বেগম ওরফে ম্যাডাম রেবী; চ্যাপ্টাখালীর বেলাল চৌকিদার; থ্যাংখালীর রুবেল; বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের দিলদার মিয়া ও কুতুপালংয়ের জাকির হোসেন।
সহায়তাকারী ৭৯ জন
কক্সবাজারে মানবপাচারকারীদের সহায়তাকারীর তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন কক্সবাজার পৌরসভার শামসু মাঝির ছেলে সৈয়দ করিম। একই তালিকায় আছেন কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজান। এছাড়াও আছেন- আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ওরফে আজাদ, উত্তর নুনিয়াছড়ার জহিরুল ইসলাম ফারুক, আজিম, মোস্তফা, সিদ্দিক, ফেরদৌস, আবু; ঘোনাপাড়ার শাহজাহান, আবু নফর (রোহিঙ্গা), ইসমাঈল, রোহিঙ্গা সদস্য শাহ আলম ও তার স্ত্রী সাজেদা আক্তার সাজু; হাজীপাড়ার ফেরদৌস ওয়াহিদ বকুল, সিরাজুল ইসলাম, নূর সফা, সেলিম, মো. আলী, সাইফুল ইসলাম, ফিরোজ, জিয়াবুল; রুমালিয়াছড়ার আশরাফুল ইসলাম সজীব, মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ ওরফে প্রকাশ মাস্টার; সোনাপাড়ার শফিউল আলম, আব্দুল গফুর, নুরুল কবির, সুরত আলম; পশ্চিম সোনাপাড়ার জালাল উদ্দীন; পালং ডেইলপাড়ার আবু তাহের; মাদারবুনিয়ার আব্দুল জলিল, নুরুল আবছার, আব্দুল জলিল, শফিক, নুর কবির, জিয়াউল হক, জাকির হোসেন, সায়েদুল হক, ফারুক হোসেন, আবদুল গনি, মনজুর আলম, নুরুল কাদের, জসিম উদ্দিন; হারিয়াখালীর জিয়াউর রহমান, রশিদ আহমদ ডাইলা, সিদ্দিক আহমদ; সাবরংয়ের ইমাম হোসেন, মোহাম্মদ ইসলাম, শওকত ফারুক, আবদুল করিম, আব্দুল্লাহ, নয়াপাড়ার রশীদউল্লাহ ডাইলা, আবুল হাসিম, দলিল আহমদ, শফিক, আনার আলী, নূর আলম; সাবরংয়ের খুইল্যা মিয়া, বশির আহমদ, আবুল কাসেম, জাহাঙ্গীর; কাটাবুনিয়ার আবু তাহের, মৌলভী কামাল, জামাল মাঝি, নেজাম মাঝি, মো. শফি, আবদুল হাফেজ, সলিম, রশিদ উল্লাহ, আব্দুল শুক্কুর, হাবি ও আল মাসুদ।
মামলা হয়, ঝুলে যায় বিচার
দেশে মানবপাচার আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৭২৪৮টি। এর মধ্যে শুধু ২০২০ সালেই (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) দায়ের হয়েছে ৫৩৩টি মামলা। অর্থাৎ ২০২০ সালের আগে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৬৭১৫টি। সব মিলিয়ে আসামির সংখ্যা ২৪ হাজার ৫৪৯ জন। এর মধ্যে সন্দেহভাজনসহ আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয়েছেন ১০ হাজার ৭২৭ জন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২০ সাল) মানবপাচার আইনে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ৪১১টির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৫টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। সেই মামলায় ‘অন্যান্য মেয়াদে’ সাজা দেওয়া হয়েছে এক আসামিকে। কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন হয়নি। আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন ৪৩ জন।
কেন শাস্তি হয় না
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাক্ষীর অভাবে সৃষ্ট দীর্ঘসূত্রতায় মুক্তি পাওয়া মানবপাচারকারীরা ফের একই অপরাধে জড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সি আর আবরার ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে আইন আছে কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আইনটির বিষয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধরনের প্রচার-প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের দরকার ছিল, সেটা হয়নি।
‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানবপাচারে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে স্থানীয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের যোগাযোগ থাকে। যে কারণে তারা ছাড়া পেয়ে যান। আর যারা ভিকটিম, তারা দরিদ্র শ্রেণির হওয়ায় সুশাসন অর্থাৎ বিচারটা পাচ্ছেন না। মানবপাচার রোধে আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। জঙ্গি দমনে আমরা যেভাবে পরিকল্পনা ও শক্তি প্রয়োগ করেছি, যেভাবে তৎপরতা চালিয়েছি; মানবপাচার রোধে ওই ধরনের তৎপরতা আমরা কিন্তু দেখছি না।’
‘সার্বিক বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব, সোর্স মোবিলাইজেশন, বিচারিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। এগুলো ছাড়া কোনোভাবেই মানবপাচার রোধ করা সম্ভব নয়’— বলেন এ অভিবাসন বিশেষজ্ঞ।
মানবপাচারের অভিযোগে মামলা হয় কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় এসে তা কেন মন্থর হয়ে পড়ে— এমন প্রশ্ন রাখা হয় কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুর আলম চৌধুরীর কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মামলাগুলোর তদন্তে গতি আনতে সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে। কিন্তু কোভিড ১৯ এর কারণে সমস্যা হচ্ছে। কোভিড (করোনা) পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে আমরা কক্সবাজার আদালতে বিচারাধীন মানবপাচারের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করব।’
জেইউ/এআর/এমএআর