রাতের সমুদ্র সৈকত পুরোপুরি নিরাপদ রেখেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ
আগে সন্ধ্যার পর বিচে (সমুদ্র সৈকত) যাওয়া যেত না। নিরাপদ মনে করতেন না পর্যটকরা। এখন সেই ভয় আর নেই। সবাই রাতে বিচে যান। সারারাত সেখানে কাটান। ২৪ ঘণ্টাই নিরাপদ বোধ করেন। ট্যুরিস্ট পুলিশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কক্সবাজারের বিচগুলো নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এ বাহিনীর দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তারা কক্সবাজারের অতিথিদের সব ধরনের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন কক্সবাজার ট্যুরিস্ট জোনের পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) সাকের আহমেদ।
পর্যটকদের আকর্ষণ করে এমন সাত শতাধিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে বাংলাদেশে। পর্যটন করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশি-বিদেশি অর্ধকোটি পর্যটকের পা পড়ে এসব কেন্দ্রে। পর্যটনে আকর্ষণ বাড়াতে ২০১৬ সালকে পর্যটনবর্ষও ঘোষণা করে সরকার। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গঠন করা হয় ট্যুরিস্ট পুলিশ। সেই থেকে এ শিল্পের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সংস্থাটি।
২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর দেশে প্রথম চালু হয় ট্যুরিস্ট পুলিশ ইউনিট। প্রতিষ্ঠালগ্নে ৬৯৯ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয় এর প্রয়োগগত কার্যক্রম। ট্যুরিস্ট পুলিশ জানায়, বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের শীর্ষে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন। প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অনেক কম হলেও গুরুত্বপূর্ণ সব ট্যুরিস্ট স্পটের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে বাহিনীটি। পাশাপাশি করোনাকালে সরকারি বিধিনিষেধ পরিপালনেও কাজ করছেন তারা...
ট্যুরিস্ট পুলিশের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা করেন এ ইউনিটের ইন্সপেক্টর সাকের আহমেদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জসীম উদ্দীন ও আদনান রহমান।
ঢাকা পোস্ট : কক্সবাজারে আসা ট্যুরিস্টরা নিজেদের শতভাগ নিরাপদ মনে করেন কি না? এ বিষয়ে আপনার ইউনিটের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি…
সাকের আহমেদ : কক্সবাজারে অতীতে যে সংখ্যক বিদেশি ট্যুরিস্ট (পর্যটক) আসতেন, তার চেয়ে এখন অনেক বেশি আসেন। দেশীয় ট্যুরিস্টদের সংখ্যাও বেড়েছে। এটার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। ইউনিটটি গঠনের আগে ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত জনবল ছিল না। যে কারণে অনেক সমস্যার সমাধান হতো না। এখন আমরা অপরাধ নিবারণ নয়, নির্মূলের চেষ্টা করি।
আগে সন্ধ্যার পর বখাটেদের উৎপাতে ট্যুরিস্টরা বিচে অবস্থান করতে পারতেন না। এখন সারারাত তারা বিচে থাকতে পারেন। কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা ও সহায়তায় ২৪ ঘণ্টা সজাগ থাকি আমরা।
ঢাকা পোস্ট : কক্সবাজারের কোন কোন এলাকায় ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম চলছে?
সাকের আহমেদ : কক্সবাজারের প্রায় সব বিচেই ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা দায়িত্বপালন করছেন। এছাড়া ঝাউবন, সেন্টমার্টিন, টেকনাফের সব ট্যুরিস্ট স্পটে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন বিনোদন নিশ্চিতে কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
ঢাকা পোস্ট : আপনার দৃষ্টিতে কক্সবাজারের কোন কোন বিচ অধিক অপরাধপ্রবণ...
সাকের আহমেদ : কক্সবাজারে এমন কিছু স্পট আছে যেগুলো একটু ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন- সুগন্ধা বিচ। এখানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছেন যারা ট্যুরিস্টদের ঠকানোর চেষ্টা করেন। এছাড়া রোহিঙ্গাদের একটা আগ্রাসন তো আছে। বিচগুলোতে ভাসমান রোহিঙ্গারা চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটায়। এ কারণে সুগন্ধা বিচটি বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : আপনাদের কাছে কোন ধরনের অভিযোগ বেশি আসে। সেগুলো সমাধানে কী পদক্ষেপ নেন?
সাকের আহমেদ : মূলত নিরবচ্ছিন্ন ও একান্তে সময় কাটাতে পর্যটকরা কক্সবাজারে আসেন। তারা চান না কোনো ধরনের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ুক। এক শ্রেণির দুষ্কৃতকারী আছেন, যারা তাদের (পর্যটক) মালামাল চুরি বা ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। কেউ আবার প্রতারণাও করেন। ইভটিজিং কিংবা অটোচালকদের বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগও আমাদের কাছে আসে। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তা সমাধানের চেষ্টা করি। দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
ঢাকা পোস্ট : অনেক বিদেশি আছেন যারা কাজের সুবাদে এখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করেন?
সাকের আহমেদ : কাজের সুবাদে কক্সবাজারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি পর্যটক অবস্থান করেন। তারা মূলত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মী। বসবাসের পাশাপাশি বিনোদনের জন্যও তারা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে আসেন, বিচে নামেন। আমরা (ট্যুরিস্ট পুলিশ) তাদের নিরাপত্তায় অধিক যত্নশীল। কারণ, বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, কোথায় থাকছেন, হোটেলে বা আবাসিক স্থানে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কি না— বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
ঢাকা পোস্ট : পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডেও আপনারা অংশ নিচ্ছেন। কাজগুলো কীভাবে সমন্বয় করছেন?
সাকের আহমেদ : প্রতিটি স্পটে সাদা পোশাকেও ট্যুরিস্ট পুলিশ নিয়োজিত আছে। পাশাপাশি আমাদের রয়েছে শক্তিশালী হেল্প ডেস্ক। তথ্য সহায়তার পাশাপাশি সেখানে সুপেয় পানি, ফার্স্ট এইডেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ট্যুরিস্টরা যেকোনো সমস্যা নিয়ে হেল্প ডেস্কে আসতে পারেন। সেখানে নিয়োজিতরা তা সমাধানের চেষ্টা করেন। তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান না হলে সেক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়। পরবর্তীতে তারা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেন।
ঢাকা পোস্ট : প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ট্যুরিস্ট পুলিশের সক্ষমতা কতটুকু?
সাকের আহমেদ : প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা মোকাবিলায় আমাদের রয়েছে রেসকিউ টিম (উদ্ধারকারী দল)। তারা ওয়াটার বাইকে (জেটস্কি) দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেন। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। তাদের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করি আমরা।
এছাড়া পরিবেশগত দুর্যোগ অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় বা ঝড়ের আগাম বার্তা পেলে বিচে কী কী করণীয় বা বর্জনীয় তা প্রচার করি এবং ট্যুরিস্টদের সচেতন করি।
ঢাকা পোস্ট : চুরি বা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় অনেকেই হয়রানির ভয়ে অভিযোগ করতে চান না। সেক্ষেত্রে অপরাধ দমন বা অপরাধী শনাক্তে বেগ পেতে হয় কি না?
সাকের আহমেদ : এখানে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক আসেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চুরি বা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা করতে চান না ভুক্তভোগীরা। কিছুদিনের জন্য ঘুরতে এসে তারা মামলার বোঝা নিতে চান না। সেক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্তে আমাদের বেগ পেতে হয়। কখনও কখনও আমরা নিজেরাই মামলা করি। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, আপনারা মামলা করুন। ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অন দ্য স্পট (ঘটনাস্থল) সমস্যার সমাধান করা হয়। এছাড়া অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী নিজেরাই যদি সমস্যার সমাধান চান, সেক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগিতা করি।
ঢাকা পোস্ট : কক্সবাজারে ‘বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ রয়েছে। কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক (ডিসি)। ট্যুরিস্ট পুলিশও এ কমিটির সদস্য। এর কার্যক্রম সম্পর্কে যদি বলতেন...
সাকের আহমেদ : বিচকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ করে এ কমিটি। কমিটির সদস্য হিসেবে বিচের আইনশৃঙ্খলাজনিত বিষয়গুলো দেখভাল করে ট্যুরিস্ট পুলিশ। আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সুশৃঙ্খলভাবে সব কাজ সম্পন্ন করি।
জেইউ/এআর/এমএআর/