পাহাড়ে গর্ত করে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে তারা
টেকনাফবাসীর আতঙ্কের আরেক নাম হ্নীলা এলাকার শালবনের দুর্গম পাহাড়গুলো। সম্প্রতি টেকনাফের সড়ক থেকে বেশ কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। হাত ও মুখ বেঁধে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় শালবনের পাহাড়ে। এরপর চলে নির্মম নির্যাতন। পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফের সড়কে অপহরণের সঙ্গে জড়িত সবাই ‘আল-ইয়াকিন’ বাহিনীর সদস্য। তাদের দাবি, ‘আব্দুল হাকিম’ ওরফে ‘হাকিম ডাকাত’ সশস্ত্র এ সংগঠন পরিচালনা করছেন। তারা টেকনাফে অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় আল-ইয়াকিন বাহিনীর কাছ থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া এক যুবকের। নাম কামরুল হাসান। পেশায় সিএনজিচালক। কামরুলের বাবা পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ১১ দিন পর তাকে ফিরিয়ে আনেন। তবে, স্থানীয় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-এপিবিএন অবশ্য তাকে উদ্ধারের দাবি করে। তারা কামরুলকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করে।
যেভাবে অপহরণ করা হয় কামরুলকে
আল-ইয়াকিন বাহিনীর অপহরণের সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন কামরুল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মে মাসের ১৪/১৫ তারিখের দিকে সিএনজি চালিয়ে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার শহরে যাই। সেখানে দুজন মহিলা আমাকে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) যাব কি না জিজ্ঞাসা করে। আমি এক হাজার টাকা ভাড়া চাই। তারা সহজেই এ ভাড়ায় রিজার্ভ নিতে রাজি হন। আমি তাদের লেদা ক্যাম্পে নামিয়ে দেই। তাদের দুজনই বোরকা পরা ছিল। মুখ ছিল ঢাকা। গলার স্বর শুনে মধ্যবয়স্ক মনে হয়েছিল। লেদা ক্যাম্পে নামার পর ওই দুই মহিলা আমার ফোন নম্বর চান। তারা বলেন, প্রায়ই তারা এ রুটে চলাচল করেন। পরবর্তীতে তারা কক্সবাজার গেলে আমাকে ফোন দেবেন। আমি আমার ফোন নম্বর দেই।
ফোন পেয়ে সিএনজি নিয়ে আমি লেদা ক্যাম্পের সামনে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে পাইনি। তাদের একজনকে ফোন দিলে আমাকে ক্যাম্পের ভেতরে এস-ব্লকে যেতে বলা হয়। এস-ব্লকেও তাদের কারও দেখা নেই। পাঁচ মিনিট সেখানে অপেক্ষা করি। একপর্যায়ে সেই দুই মহিলার একজন আমার কাছে আসেন। বলেন, ক্যাম্পের আরও ভেতরে গর্ভবতী এক মহিলা আছেন। সেখান থেকে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে
দুদিন পর তারা আমাকে ফোন দিয়ে কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্প থেকে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলেন। আমি তাদের পৌঁছে দেই। আমাকে ১৫০০ টাকা ভাড়া দেন তারা।
এর তিনদিন পর ওই দুই মহিলার একজন আমাকে ফোন দিয়ে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে আসতে বলেন। ফোন পেয়ে সিএনজি নিয়ে আমি লেদা ক্যাম্পের সামনে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে পাইনি। তাদের একজনকে ফোন দিলে আমাকে ক্যাম্পের ভেতরে এস-ব্লকে যেতে বলা হয়। এস-ব্লকেও তাদের কারও দেখা নেই। পাঁচ মিনিট সেখানে অপেক্ষা করি। একপর্যায়ে সেই দুই মহিলার একজন আমার কাছে আসেন। বলেন, ক্যাম্পের আরও ভেতরে গর্ভবতী এক মহিলা আছেন। সেখান থেকে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।
ক্যাম্পের আরেকটু ভেতরে যেতেই আল-ইয়াকিনের ১০-১২ জন সদস্য সিএনজিসহ আমাকে ঘিরে ফেলে। আমাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে সিএনজি থেকে বের করে ক্যাম্পের আরও ভেতরে নিয়ে যায়। দুই হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে।
পাহাড়ের চূড়ায় গর্তে ফেলে নির্যাতন
কামরুল বলেন, ক্যাম্পের পাশ দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাকে পাহাড়ের ওপরে তোলা হয়। পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে তারা আমার চোখ খুলে দেয়। কিন্তু হাতের সঙ্গে পাও বেঁধে ফেলে। সেখানে কবরের মতো তিন-চার ফিট গভীর একটি গর্ত ছিল। সেই গর্তে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আমাকে ফেলে রাখা হয়।
কিছু সময় গড়াতেই আমাকে মারধর শুরু করে তারা। অনবরত চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারতে থাকে। একপর্যায়ে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। তখন তারা ১০ লাখ টাকা চেয়ে আমার বাবাকে ফোন দিতে বলে। আমি বাবাকে ফোন দেই। বাবা টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করেন। তবে, ১০ লাখ টাকা জড়ো করতে সময় লাগছিল। তখন তারা আমার ওপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে অস্ত্র দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে।
অপহরণের পর প্রতিদিন সকালে তারা আমাকে মারধর করত আর বলত, ১০ লাখ টাকা না দিলে মেরে ফেলবে। টাকা দিতে দেরি হচ্ছিল দেখে একদিন বাবাকে ফোন দিয়ে ফাঁকা গুলির শব্দ শোনায়। বাবা এতে ভয় পেয়ে যান। পাহাড়ে ওরা ১২-১৪ জন ছিল। সবার হাতে নাইন এমএম পিস্তল। আবার কয়েকজনের কাছে একাধিক পিস্তল ছিল। সারাদিন তারা খোলা আকাশের নিচে থাকত। বৃষ্টি হলে পাশের একটি ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিত। আমি গর্তের ভেতরে ভিজতাম। দুজন পালাক্রমে পাহারা দিত, যাতে আমি পালাতে না পারি।
এদিকে গুলির শব্দ শুনে আমার বাবা ভয় পেয়ে যান। মুক্তিপণের টাকা জোগাড়ে জোর চেষ্টা চালান। কয়েক দিনের মাথায় ধাপে ধাপে আমার বিকাশ নম্বরে পাঁচ লাখ টাকা পাঠান বাবা। তারা আমার বিকাশ নম্বর থেকে টাকা তুলে (ক্যাশ আউট) নেয়। বাবা তাদের বারবার দেখা করে সরাসরি টাকা নেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তারা রাজি হয়নি। ফোনেই সব টাকার লেনদেন হয়।
টাকা পেয়ে কামরুলের জামা-কাপড় খুলে নেয় তারা
১ জুন, যেদিন সবমিলিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয় তাদের, সেদিন আমাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চোখ, মুখ আর দু’হাত বেঁধে ক্যাম্পের নিচে আনা হয়। আমার সারা শরীরে তখন কাদা। তারা প্যান্ট ও গেঞ্জি খুলতে বলে। আমি খুলে ফেলি। জুতাও তাদের দিয়ে দেই। তারা আমার জামাকাপড় পরে ফেলে। তাদের একজনের প্যান্ট আমাকে পরিয়ে দেয়। আমার সামনেই তারা পাঁচ লাখ টাকা ভাগ করে নেয়। এরপর তারা আমাকে ক্যাম্পের যেখান থেকে তুলে নিয়েছিল সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। সেখান থেকে এপিবিএনের সদস্যরা আমাকে উদ্ধার করেন।
কামরুলের বাবার বক্তব্য
ছেলের অপহরণের বিষয়ে কামরুলের বাবা জাফর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আল-ইয়াকিনের সদস্যরা আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায়। র্যাব-পুলিশ সবাইকে বিষয়টি জানাই। তারা চেষ্টাও করে, কিন্তু কাজ হয়নি। আমি বারবার অপহরণকারীদের বলেছি, ১০ লাখ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নাই। কিন্তু তাদের মনে কোনো দয়ামায়া নাই। তারা নির্দয়। গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যানকে দিয়েও ফোন করিয়েছি, কাজ হয়নি। তাদের শুধু টাকা চাই।
‘প্রতিদিন তারা আমার ছেলেকে মারধর করত, মেরে ফেলার ভয়ও দেখাত। তারা (আল-ইয়াকিনের সদস্যরা) আমার এলাকার একজনের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছিল। কিন্তু তাকে (অপহৃত ব্যক্তি) আর ফেরত দেয়নি, লাশও পাওয়া যায়নি। আমার ছেলেকেও তারা মেরে ফেলবে— এ ভয়ে কষ্টে টাকা জোগাড় করে ছেলেকে ফিরিয়ে আনি।’
তিনি আরও বলেন, পুলিশ তাদের ধরার বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু পাহাড়ের অনেক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া আছে। পুলিশ সেখানে যায় না, কারণ তাদের কাছে অনেক অস্ত্র আছে।
আল-ইয়াকিনের অস্তিত্ব নিয়ে ‘মন্তব্য নেই’ কক্সবাজারের এসপির
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক আল-ইয়াকিন কিংবা আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) মতো উগ্রবাদী সংগঠনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) হাসানুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৩ জুন ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি সেদিন বিকেলে ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে দেখা করতে বলেন। বিকেলে তার কার্যালয়ে দেখা হয়। কিন্তু প্রশ্ন শুনে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। নিজেকে ‘ব্যস্ত’ বলে দাবি করেন। ব্যস্ততার কারণে তিন দিনের আগে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বলেও জানান।
পরে এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। তারপরও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
যদিও ২০২০ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন ‘আব্দুল হাকিম’ ওরফে ‘হাকিম ডাকাত’-কে গ্রেফতারে পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন।
এআর/জেইউ/এমএআর/