হারিয়ে যাচ্ছেন দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিকরা!
পূর্বপুরুষদের দেখানো পথে রাজনীতিতে এসে দারুণ আলোচিত হন তারা। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে সরাসরি অংশগ্রহণ ও প্রাণবন্ত বক্তব্য ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিবিদ’ হিসেবে তাদের পরিচিতি এনে দেয়। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে অথবা নিজ দলের ব্যানারে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশও নেন তারা। কেউ নির্বাচিত হন, আবার কেউ পরাজয় বরণ করেন। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তীতে রাজনীতির মাঠে তারা প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কোনোভাবেই আর তাদের দেখা মিলছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর দেশে করোনার সংক্রমণ দেখা দিলে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেন দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিকরা। কেউ আবার সরাসরি রাজনীতি থেকে সরেও দাঁড়ান। হারিয়ে যাওয়া উদীয়মান তরুণ রাজনীতিবিদদের নিয়ে আজ থাকছে ঢাকা পোস্টের বিশেষ আয়োজন।
জেবেল রহমান গানি
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নাতি এবং সাবেক মন্ত্রী শফিকুল গনি স্বপনের ছেলে জেবেল রহমান গানি। তিনি বর্তমানে বাপ-দাদার হাতে গড়া দল বাংলাদেশ ন্যাপের মূল অংশের চেয়ারম্যান। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান। যোগ দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে। জোটটি একাদশ সংসদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি গানির।
নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে নিজ দল ন্যাপ থেকে নীলফামারী-১ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু পরাজিত হন। এরপর রাজনীতির মাঠে সেভাবে আর দেখা যায়নি তরুণ এ রাজনীতিবিদকে।
জেবেল রহমান গানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৮ সালে আমরা বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেই। যদিও সেটা কোনো আনুষ্ঠানিক জোট ছিল না। আসলে নির্বাচনে আমাদের মতো ছোট-ছোট দলগুলোর একটা ব্যানার প্রয়োজন। ওই ব্যানারে নির্বাচন করলে ভালো হয়, এজন্যই করা... আর কী। নির্বাচনের পরই যুক্তফ্রন্টের কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।
‘২০১৮ সালের নির্বাচনে কী হয়েছে, সবাই দেখেছে। এরপর ২০১৯ সালটা আমরা নিজেদের রাজনৈতিক বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। আর ২০২০ সাল থেকে তো করোনা শুরু হয়ে গেল। এখন রাজনীতি করার সুযোগ কোথায় আছে, বলুন?’
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদে যাওয়াই সবার মূল লক্ষ্য— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য তো নির্বাচনকেন্দ্রিক হবেই। আগামী নির্বাচন ২০২৩ সালে। এ কারণে আমরা মনে করছি, এখনও কিছু সময় আছে। আর করোনার কারণে এ বছরও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ থাকবে বলে আমার মনে হয় না।’
দেশে বিরাজনীতিকরণের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করা যায়— এমন দাবি করে ন্যাপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা যারা সরকারের বাইরে আছি, তারাও নিজেদের সুসংগঠিত করতে পারিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। তারা তাদের শক্তি প্রয়োগ করে যাচ্ছে বিরোধী শক্তিগুলো দমনের জন্য। আমি মনে করি, এখন আওয়ামী লীগও রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে।’
‘তবে, দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন হবে তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ওপর। সেখানে খুব বেশি বামপন্থী বা খুব বেশি ডানপন্থী রাজনীতির সুযোগ থাকবে না। অন্তরে যাই থাকুক না কেন, মুখে তো আমরা অনেক কিছুই বলতে পারছি না।’
ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ
রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতি নাজিউর রহমান মঞ্জুর ছেলে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। পিতার হাতে গড়া দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি- বিজেপি’র চেয়ারম্যান তিনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ব্যানারে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ভোলা-১ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ওই সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারের কড়া সমালোচক ছিলেন পার্থ। সংসদ ও টক শোতে বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য দিয়ে দারুণ আলোচিত হয়ে ওঠেন নতুন প্রজন্মের এ রাজনীতিক।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে ঢাকা-১৮ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু পরাজিত হন। বিএনপির সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে পার্থের দল বিজেপি। এরপর থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় নেই দ্বিতীয় প্রজন্মের এ রাজনীতিবিদ।
রাজনীতিতে নিজের নিষ্ক্রিয়তার কথা স্বীকার করে আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন তো রাজনীতি নেই। কেউ রাজনীতি করে না। রাজনীতি থাকলে তো মাঠে থাকব। মাঠের রাজনীতি চলে গেছে। আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো রাজনীতি নেই। বিভিন্ন এলাকাতে দেখি আওয়ামী লীগের অনেক এমপি ইউএনও-ডিসির বিরুদ্ধে মিছিল করে। আর সংসদ তো লোক দেখানো।’
‘আমলারা রাজনীতি খেয়ে ফেলেছে। বিরোধী দলের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। আসলে ৩০০ আসনে ছোট ছোট ৩০০ রাজা বসে আছে। যার যেমন ইচ্ছা দেশ চালাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, এখন দেশে তো রাজনীতি নেই, করব কীভাবে? কোনো ইস্যুতে আমি ১০-১৫ জনকে নিয়ে মাঠে নামব, কিন্তু সরকার তো করতে দেবে না। হেফাজত হলে মিছিল করতে দেবে, আবার পিটিয়ে উঠিয়ে দেবে। এভাবে রাজনীতি করা যায় না। আপনি যদি সিনেমা-ই না বানান, নায়ক দেখবেন কোথা থেকে? একইভাবে রাজনীতি না থাকলে আমাদের কীভাবে দেখা যাবে? এখন বিরোধীদলীয় সব রাজনীতিবিদ ঘরে বসে আছেন। বিএনপি যথারীতি একটা প্রেস রিলিজ দেয়। দিতে হয়, দেখানোর জন্য, তাই তারা দেয়।
ড. রেজা কিবরিয়া
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া। বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ছেলে হাঁটেন উল্টো পথে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। যোগ দেন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে। নির্বাচনের আগে গণফোরাম-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল মিলে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ জোটের অধীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধানের শীর্ষ প্রতীক নিয়ে হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন রেজা কিবরিয়া। কিন্তু পরাজিত হন।
প্রেসিডিয়াম মেম্বার হিসেবে গণফোরামে তার যাত্রা শুরু। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলটির বিশেষ কাউন্সিলে তাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রেজা কিবরিয়ার উড়ে এসে জুড়ে বসায় দলটির মধ্যে দেখা দেয় বিভক্তি ও কোন্দল। একের পর এক বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে চলতি বছরের শুরুতে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি নেন রেজা কিবরিয়া। বর্তমানে কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন দ্বিতীয় প্রজন্মের এ রাজনীতিবিদ। তবে, মাঝেমধ্যে তাকে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকতে দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে ড. রেজা কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আসলে সবকিছু নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। এটা ঠিক, আমি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রোগ্রামে সশরীরে অথবা ভার্চুয়ালি যুক্ত হই।’
নতুন কোনো দলে যোগ দিচ্ছেন কি না— জানতে চাইলে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। কোনো দলে যোগ দিলে নিশ্চয়ই খোঁজ পাবেন। এ বিষয়ে এখনও কোনো পরিকল্পনা নেই।’
মাহী বি. চৌধুরী
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরী। বাবার মতো ছেলেও বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এ দল থেকে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে নানা জটিলতার কারণে বিএনপি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠন করেন বি. চৌধুরী। বর্তমানে তিনি দলটির যুগ্ম মহাসচিব। পিতা আছেন চেয়ারম্যান হিসেবে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ‘প্লান-বি’ নামের একটি উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় আসেন মাহী বি. চৌধুরী। মূলত, তরুণদের বেশি করে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তার এ উদ্যোগ। ওই সময় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার শর্ত হিসেবে ১৫০টি আসন চেয়ে বসে দলটি। এমন ঘটনায় বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হন তরুণ এ নেতা। শেষ পর্যন্ত বিএনপি তাদের বাদ দিয়ে আলাদা জোট গঠন করে। অন্যদিকে, নানা নাটকীয়তার মধ্যে যুক্তফ্রন্ট নামে আলাদা জোট করেন বি. চৌধুরী। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয় এ জোট।
কিন্তু নির্বাচনের পর রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন মাহী। অভিযোগ আছে, গত বছর দেশে করোনা মহামারি দেখা দিলে নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষ তাকে কাছে পাননি। বরং মহামারির সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে চলে যান। যদিও এ সময় ভার্চুয়ালি এলাকার কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাকে যুক্ত থাকতে দেখা যায়
মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন দ্বিতীয় প্রজন্মের এ রাজনীতিক। কিন্তু নির্বাচনের পর রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন মাহী। অভিযোগ আছে, গত বছর দেশে করোনা মহামারি দেখা দিলে নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষ তাকে কাছে পাননি। বরং মহামারির সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে চলে যান। যদিও এ সময় ভার্চুয়ালি এলাকার কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাকে যুক্ত থাকতে দেখা যায়।
সম্প্রতি বাজেট অধিবেশনে যোগ দিতে দেশে ফেরেন মাহী বি. চৌধুরী। রাজনীতিতে হঠাৎ নিষ্ক্রিয় কেন— জানতে একাধিক মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বাবা বি. চৌধুরীর প্রেস সচিব জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাহী বি. চৌধুরী কয়েকদিন আগে দেশে ফিরেছেন। তিনি সংসদের বাজেট অধিবেশনেও যোগ দিয়েছেন।
এএইচআর/এমএআর/