সম্পর্কে নতুন মোড়, অমীমাংসিত বিষয় ভোলেনি বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ পর স্থবির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিতে বেশ আগ্রহী ইসলামাবাদ। ঢাকাও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজি। এরই উদ্যোগ হিসেবে ১৫ বছর পর চলতি সপ্তাহে ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া চলতি মাসের শেষের দিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। সর্বশেষ ২০১২ সালে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার ঢাকা সফর করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগামী ১৭ এপ্রিল ঢাকায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন।

সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনার প্ল্যাটফর্ম এফওসির (ফরেন অফিস কনসালটেশন) এজেন্ডা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সার্বিক দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা হবে। এ প্ল্যাটফর্মে কোনো বিষয় বাদ থাকে না, সব আলোচনা হয়। অগ্রগতি কী আছে, কী করার আছে বা আরও কী করা যায়; কী কী দেওয়ার আছে বা নেওয়া যায়— সবই আলোচনার টেবিলে থাকবে। মোটা দাগে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কানেক্টিভিটি; বিশেষ করে আকাশপথে যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য, সংস্কৃতি ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। এছাড়া সার্ক, ওআইসি, ডি-৮ এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন
দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আন্তরিক বাংলাদেশ। তবে, অমীমাংসিত ইস্যুগুলো ভুলে যায়নি ঢাকা। বাংলাদেশ মনে করে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, যুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণ, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, সম্পদের হিস্যা, ১৯৭০ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড়ের সময় দেওয়া বৈদেশিক সহায়তার পাওনা পরিশোধের মতো বিষয়গুলোর সুরাহা জরুরি
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক যুগের বেশি সময় পর দুই দেশের মধ্যে ষষ্ঠ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। ২০১০ সালে সর্বশেষ ইসলামাবাদে বৈঠকে বসেছিল দুই দেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিবেরা। এছাড়া অর্থমন্ত্রী পর্যায়ের অর্থনৈতিক কমিশনের সর্বশেষ বৈঠক হয় ২০০৫ সালে। দীর্ঘদিনের জট খোলার পর আশা করা হচ্ছে এবারের আলোচনায় পরবর্তী অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক নিয়ে কথা হবে।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে দুই দেশের সম্পর্ক দৃঢ় করার প্রস্তাব। একইসঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে একটি যৌথ কমিশন পুনর্বহালের বিষয়টি তুলতে পারে পাকিস্তান। এছাড়া বাংলাদেশের দিক থেকে সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লক্ষ্যে একটি বিশেষায়িত কর্মসূচির প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে পাকিস্তানকে।
দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আন্তরিক বাংলাদেশ। তবে, অমীমাংসিত ইস্যুগুলো ভুলে যায়নি ঢাকা। বাংলাদেশ মনে করে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, যুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণ, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, সম্পদের হিস্যা, ১৯৭০ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড়ের সময় দেওয়া বৈদেশিক সহায়তার পাওনা পরিশোধের মতো বিষয়গুলোর সুরাহা জরুরি।
আরও পড়ুন
অমীমাংসিত বিষয়গুলো সুরাহা না করে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। ঢাকার চাওয়া, পাকিস্তান এগিয়ে আসুক। কারণ, অমীমাংসিত বিষয়গুলো সুরাহা যতদিন না হবে ততদিন সামনে আসবে। আলোচনার টেবিলে থাকবে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব বলেন বা মন্ত্রী বলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়গুলো থাকে। এসব ইস্যু যতদিন সুরাহা না হয়, ততদিন উঠতেই থাকবে; এটা স্বাভাবিক। আমরা চাই এগুলোর সুরাহা বা মিটমাট হয়ে যাক। একটা অবস্থান নিক ওরা। সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভালো হয় যদি তারা সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলে।

ওই কূটনীতিক আরও বলেন, ৫৪ বছর হয়ে গেল কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এখন তারা কী চায়, আলোচনা করে বলুক। নতুন কিছু তো বলুক। আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে ওদের অস্বস্তি আছে, সেটা তো বোঝাই যায়। এছাড়া আটকেপড়াদের নিয়ে যাওয়া বলেন, টাকা-পয়সা বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বলেন, তারা কমফোর্টেবল হলে আগেই সব মিটে যেত। তাদের নিশ্চয়ই কোনো একটা বিষয় আছে। দেখা যাক, আলোচনায় কী আসে!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পাকিস্তানের অতি আগ্রহের কারণে মনে হয়েছে দুই দেশ বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ঢাকা-ইসলামাবাদের সম্পর্কে যে নতুন মাত্রা পেয়েছে, সেটি দৃশ্যমান। ইতোমধ্যে বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। প্রথমে নিউইয়র্ক এবং পরে মিসরে। প্রথম সাক্ষাতে ড. ইউনূস একাত্তরের প্রসঙ্গ না তোলায় দেশের অনেকে নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন। তবে, মিসরে একাত্তরের জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি প্রধান উপদেষ্টা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে বেশকিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা গেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— দুই দেশের মধ্যে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনারবাহী একটি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে, যে সুযোগ আগে ছিল না। গত ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশের ভিসাপ্রাপ্তি সহজ করার নির্দেশ দেয়। আগে পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত উন্নত দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রদানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র লাগত। এছাড়া সেপ্টেম্বরের শুরুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তানের ভিসার চার্জ লাগবে না। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি উড়োজাহাজ চলাচলের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের এক সামরিক কর্মকর্তা ইসলামাবাদ সফর করেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফপিসিসিআই) একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।
বর্তমান সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ কি না— এমন প্রশ্নে দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে একটা অস্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল। স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না। অস্বাভাবিক সম্পর্কটা স্বাভাবিকীকরণের একটা প্রক্রিয়া চলছে, নরমালাইজেশন বলতে পারেন। তবে, বেশিকিছু মনে করাটা এখন ঠিক হবে না। বলতে পারেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আপনি যদি কারও সঙ্গে আলোচনায় না বসেন তাহলে তো হলো না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিগত সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে; কিন্তু আলোচনার টেবিলে বসার মানসিকতা ছিল না বা আগ্রহ ছিল না।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের অতি আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে। তিনি বরাবরই বলে আসছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন বাদ রেখে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো বার্তা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি। আমরা মোটেই তাদেরকে এ প্রসঙ্গে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করিনি যে, একাত্তরকে বাদ দিয়ে আমরা ভালো সম্পর্ক রাখব। ভালো সম্পর্ক নিশ্চয়ই তৈরি করার চেষ্টা করব, সেখানে একাত্তরও থাকবে।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়টি খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন না তৌহিদ হোসেন। তবে তিনি মনে করেন, পাকিস্তান যদি এ সাহসটুকু দেখায়, এখানে ১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা উদ্ধৃত করে তারা যদি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এটা তো দোষের কিছু নয়।
আরও পড়ুন
এদিকে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের ইসলামাবাদ ফেরার সপ্তাহখানেক বা তারও দু-একদিন পর ঢাকায় আসবেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। তার সফর নিয়ে এক কূটনীতিক জানান, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের পরপরই আসার কথা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। সপ্তাহ ব্যবধানের আগেই আসার কথা ছিল, সেটা এখন হচ্ছে না। তবে, এ মাসের শেষের দিকে অর্থাৎ ২৬-২৮ এপ্রিলের দিকে হতে পারে।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের ঢাকা সফরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওই সময় ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালের জুলাইয়ে সেই হিনা রাব্বানির ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তিনি তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু হিনা রাব্বানি ঢাকায় আসেননি।
তার ঢাকা সফর বাতিল হওয়ার কারণ হিসেবে তৎকালীন ঢাকার দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য ছিল, ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আগমুহূর্তে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সঙ্গে পাকিস্তানের পতাকা জুড়ে দিয়ে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন ফেসবুকে একটি ছবি প্রকাশ করে। এ নিয়ে ওই সময় ঢাকার প্রতিক্রিয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় পাকিস্তান হাইকমিশনকে। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি পাকিস্তান।
এছাড়া ২০২১ সালে পাকিস্তানে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মন্ত্রী পর্যায়ের জরুরি বৈঠকে অংশ নিতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের। কিন্তু শেষ সময়ে তিনি সফরটি বাতিল করেন। তার বদলে বৈঠকে পাঠানো হয় তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে। এর বাইরে ২০২২ সালের মার্চে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে ইসলামাবাদে দুই দিনব্যাপী ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনিও সফরে না গিয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিবকে পাঠান।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের অতি আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে। তিনি বরাবরই বলে আসছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন বাদ রেখে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো বার্তা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি। আমরা মোটেই তাদেরকে এ প্রসঙ্গে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করিনি যে, একাত্তরকে বাদ দিয়ে আমরা ভালো সম্পর্ক রাখব। ভালো সম্পর্ক নিশ্চয়ই তৈরি করার চেষ্টা করব, সেখানে একাত্তরও থাকবে
সম্ভাবনা জাগিয়ে হিনা রাব্বানির সফর বাতিলের পর পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ভার্চুয়ালি ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন
পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশের সাবেক এক হাইকমিশনার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ভারসাম্য তৈরির ক্ষেত্রে। এটাকে আমরা কূটনৈতিক টুল হিসেবে কাজে লাগাতে পারি। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। স্বাভাবিক রাখতে হবে সম্পর্ক। বিগত সরকারের ২০০৯-১৩ সাল পর্যন্ত সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু এরপর আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছি। বিশেষ করে বিগত সরকারের শেষ সময়ে। আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে পারি, পাকিস্তানের সঙ্গেও। এক্ষেত্রে ভারতের উদ্বেগ একটাই, কোনোভাবে যেন বাংলাদেশের সীমানা পাকিস্তানিরা ব্যবহার না করে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের চাওয়া কাশ্মীরসহ অন্যান্য ইস্যুতে যেন আমরা তাদের সমর্থন করি। কিন্তু এটা ভারত পছন্দ করে না। তবে, বিষয়টি সহজে পাশ কাটানোর উপাদান আমাদের সংবিধানে আছে, আমরা কারও পক্ষে যেতে পারি না।
পাকিস্তানে দীর্ঘসময় কাজের অভিজ্ঞতা থাকা সাবেক এ হাইকমিশনার কেন দেশটিকে বাংলাদেশের প্রয়োজন সেটিও তুলে ধরেন। বলেন, কূটনীতিতে সম্পর্ক খারাপ হলেও দেখা যায় ব্যবসা-বাণিজ্য চলতে থাকে। অথচ স্বাভাবিক থাকলে সেটা আরও ভালো হয়। কোনো পণ্যের সংকট হলে পাকিস্তান আমাদের বিকল্প উৎস। বড় আকারে না হলেও আমরা সংকটে পড়লে পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ, চিনি, চালসহ আরও কিছু পণ্য আমদানি করতে পারি। বিপদের সময়ে খাদ্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমাদের ভালো সোর্স। এছাড়া তিন মিলিয়ন বাঙালি পাকিস্তানে আছেন। সম্পর্ক খারাপ হলে এর প্রভাব তাদের ওপর পড়ে, দেশের ওপরও পড়ে।

পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্ক বিবেচনায় অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানের উত্তম সময় এখনই— এমন আখ্যা দিয়ে সাবেক এ হাইকমিশনার আরও বলেন, আমাদের কিছু অমীমাংসিত ইস্যু আছে। আমরা চাইলে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে বিষয়টি সমাধান করতে পারি। সংকটের মধ্যে কিছু সুযোগ তৈরি হয়। এটি একটি সুযোগ এবং আমাদের তা কাজে লাগাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া চলছে, এটা ঠিক। তবে, স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতি রেখেই করতে হবে। আমরা এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক বজায় রাখি, সেটা মনে রেখে সম্পর্ক করতে হবে। আমার ধারণা, পাকিস্তানের দিক থেকেও সেটা মনে রেখে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করবে। দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যেসব স্বার্থ আছে সেগুলো আমাদের জাতীয় স্বার্থে তুলতে হবে। কখনও কখনও অপ্রিয় হলেও সেটা তুলতে হবে।
‘আমরা মনে করি, অমীমাংসিত ইস্যুগুলো তুলে যথাসম্ভব সেগুলোর সমাধান করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই উত্তম। সর্বোপরি, আমরা তো এ অঞ্চলেরই দেশ।’
এনআই/