ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী উঠাচ্ছে রেলওয়ে নিজেই!

আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে আসন নির্ধারিত থাকে। নিয়ম না থাকলেও যাত্রীদের অনুরোধের কথা বলে নির্ধারিত আসনগুলোর মধ্যে শোভন ও সুলভ শ্রেণির আসনের বিপরীতে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট (দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিট) ইস্যু করে থাকে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু এর বাইরেও ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী উঠাচ্ছে রেলওয়ে নিজেই! আন্তঃনগর ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করছে লোকাল বাস সার্ভিসের মতো।
বিজ্ঞাপন
প্রতিটি টিকিটধারী যাত্রীই চান ট্রেনে তার ভ্রমণ নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হোক। এজন্যই যাত্রীরা নির্ধারিত ট্রেনের বরাদ্দ আসন থেকে টিকিট সংগ্রহ করেন। ট্রেনের আসন পরিপূর্ণ থাকলে যতটুকু জায়গা বাকি থাকে, তাতে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে ট্রেনের ভেতর চলাচল, খাবার গাড়িতে যাওয়া ও জরুরি কাজ সারতে পারেন। এর বাইরে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিটের যাত্রী ওঠার পরও যে পরিমাণ জায়গা থাকে, তাতেও আসনসহ টিকিটধারী যাত্রীদের তেমন অসুবিধা হয় না।
অসংখ্য মানুষ এখনও বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করেন। বিনা টিকিটের এসব মানুষদের ট্রেন ভ্রমণ প্রতিরোধসহ ডিজিটাল সিস্টেম প্রবর্তন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্রেনেই পজ মেশিন (পয়েন্ট অব সেলস) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় রেলওয়ে। এবং সেটি কার্যকর হয় ২০২৩ সালের ১ মার্চ থেকে
বিজ্ঞাপন
কিন্তু রেলওয়ের ‘অসংখ্য অতিরিক্ত’ যাত্রী নেওয়ার ফলে আসনসহ টিকিটধারী যাত্রীরা পড়ছেন বিপাকে। ট্রেনে আসনসহ টিকিটধারী যাত্রীর যে সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। না পারছেন কাউকে কিছু বলতে, না পারছেন সহ্য করতে। আর এ অসুবিধা তৈরি করছে রেলওয়ে নিজেই।
বিষয়টি নিয়ে যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করছে, আসনসহ টিকিটধারী যাত্রীর সঙ্গে রেলওয়ের কোনো বাণিজ্য নেই। তাই তারা লাভের জন্য অতিরিক্ত যাত্রী তুলছে ট্রেনে।
বিজ্ঞাপন
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, কোনোভাবেই ডিক্লেয়ার পলিসির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই রেলওয়ের। এতে সেবার মান কমে যাবে। মান কমে গেলে কিন্তু ভাড়ার দামও কম হতে হবে।
অসংখ্য মানুষ এখনও বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করেন। বিনা টিকিটের এসব মানুষদের ট্রেন ভ্রমণ প্রতিরোধসহ ডিজিটাল সিস্টেম প্রবর্তন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্রেনেই পজ মেশিন (পয়েন্ট অব সেলস) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় রেলওয়ে। এবং সেটি কার্যকর হয় ২০২৩ সালের ১ মার্চ থেকে।
তৎকালীন রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছিলেন, পজ মেশিনে একটি অ্যাপ ইন্সটল করা আছে যা রেলওয়ের টিকিটিং সিস্টেমের প্রধান ডাটাবেজের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে মেশিনটির মাধ্যমে অনলাইন ও কাউন্টার থেকে দেওয়া টিকিট যাচাই করা যাবে। ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষকরা (টিটিই) বিনা টিকিটের যাত্রী কিনা তা যাচাই করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন। একইসঙ্গে যেকোনো রুটের টিকিটও খুব সহজে দেওয়া যাবে।
কিন্তু এই পজ মেশিন এখন ব্যবহার করা হচ্ছে রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে। ট্রেনের বরাদ্দ আসন বিক্রি শেষে, যাত্রা শুরুর আগে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রির পরেও এই পজ মেশিনের মাধ্যমে প্রারম্ভিক স্টেশন থেকে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করে অতিরিক্ত যাত্রী উঠানো হচ্ছে ট্রেনে। এতে আসনসহ টিকিটধারী যাত্রীরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে বিরক্ত হচ্ছেন।
আরও পড়ুন
গত ২৪ ও ২৫ মার্চ দেশের প্রধান ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন (কমলাপুর) ঘুরে দেখা যায়, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের আগে টিটিইরা যাত্রীদের টিকিট চেক করছেন। যাদের কাছে টিকিট নেই, তাদের গন্তব্যের ভাড়াসহ ঢাকা থেকে বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত (৫০ টাকা) জরিমানা ধরে টিকিট ইস্যু করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, ঢাকা থেকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত আন্তঃনগর ট্রেনে শোভন চেয়ার শ্রেণির আসনের ভাড়া ৭০ টাকা। এর সঙ্গে ৫০ টাকা জরিমানা হিসেবে যুক্ত করে মোট ১২০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এই ঘটনা প্রতিটি রুটেই ঈদের সময় ছাড়াও প্রতিনিয়ত ঘটছে।
প্রারম্ভিক স্টেশনেই জরিমানাসহ গন্তব্যের টিকিট সংগ্রহ করেছেন এমন একাধিক অতিরিক্ত যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট। তারা জানিয়েছেন, গন্তব্যে যেতেই হবে, তাই বাধ্য হয়ে এই পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। রেলওয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে সুযোগ দিয়েছে বলেই, এটি তারা ব্যবহার করছে।
কালনী এক্সপ্রেসে ট্রেনে ঢাকা থেকে নরসিংদী যাবেন মনিরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি নরসিংদী যাবো। কিন্তু কাউন্টারে কোনো টিকিট নেই। এখন আমাকে ৫০ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। সাধারণত নরসিংদীর ভাড়া ৭০ টাকা। এখন এই টিকিট আমাকে নিতে হয়েছে ১২০ টাকা দিয়ে। তাও যেতে হবে দাঁড়িয়ে।’
আছিয়া বেগম নামে একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার তো টাচ মোবাইল নেই। আমি অনলাইন থেকে টিকিট কিনতে পারিনি। স্টেশনে এসে শুনলাম টিকিট আরও ১০ দিন আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এখন জামালপুর যাবো। টিটি বলছে ৫০ টাকা জরিমানাসহ ভাড়ার টাকা দিতে।’
ট্রেনের একজন নিয়মিত যাত্রী জাহিদ আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি স্বাচ্ছন্দ্যে নিরাপদে ভ্রমণের জন্যই সিটসহ টিকিট সংগ্রহ করি। এরপর দেখা যায়, আমার সিটে যেতেই আমাকে বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়। তারপরে যখন গিয়ে সিটে বসলাম, তখন দেখি আমার আশেপাশে আরো দুই-তিনজন দাঁড়িয়ে আছেন। এতে করে আমার প্রাইভেসি নষ্ট হয়। এইসব দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির ওপর ক্ষোভ নেই। আসলে পুরো ম্যানেজমেন্ট যারা করেন, তাদের ওপর আমি বিরক্ত। সুশৃঙ্খলভাবে যাতায়াতের জন্যই টিকিটটা কেটেছি। কিন্তু পুরো জার্নিটা আমার জন্য একটা ভয়াবহ বিরক্তির মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এটা শুধু আমি নই। যেসব যাত্রী ভাই সিটসহ টিকিট সংগ্রহ করেন, সবারই একই অভিমত।
বিষয়টি জানিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেলওয়ে তাদের লাভের জন্য অতিরিক্ত যাত্রী তুলছে। আপনি যে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠলেন, এখানে আপনাকে নিয়ে রেলের কোনো বাণিজ্য নেই। বরং টিকিটবিহীন যাত্রীতে তাদের মুনাফা বেশি হয়। সেজন্যই তারা টিকিটবিহীন যাত্রী তুলতে আগ্রহী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেও আগ্রহী। এর জন্য যাদের দায়িত্ব এটি পরিদর্শন করে দেখার, তারা না দেখার ভান করে থাকেন। এতে নিয়মিত যাত্রীরা রেলের ওপর বেশ বিরক্ত। কিন্তু গণপরিবহন সংকট থাকায় আমাদের বাধ্য হয়ে এভাবে চলতে হয়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা রেলওয়ে কোনোভাবেই করতে পারে না। প্রথম যেটা ডিক্লায়ারেশন দেয়, সিটিংয়ের বাইরে আমি ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং দেব এবং এটা কতটুকু হতে পারে সেটা ধরেই কিন্তু ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। যাত্রীর সংখ্যাও কিন্তু সেভাবেই নির্ধারণ করা হয়। এর থেকে বেশি যাত্রী তোলার অর্থই হচ্ছে রেলের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সেবার মান নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা। পাশাপাশি এখান থেকে কিছু জরিমানা ক্যাশ হিসাবে তৈরি হওয়া। কোনোভাবেই ডিক্লেয়ার পলিসির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি করতেই হয় তাহলে ২৫ শতাংশ কেন, সরকারি ঘোষণা দেওয়া হোক ৩৫-৪০ শতাংশ।
তিনি বলেন, এটা কেন বলছে না রেলওয়ে, কারণ এটা বললে ট্রেনে ভিড় আরও বেড়ে যাবে। সেবার মান কমে যাবে। মান কমে গেলে কিন্তু ভাড়ার দামও কম হতে হবে।
এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, রেলওয়ে একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। সেবা যদি দিতে হয় তাহলে কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকতে হবে। আর না হলে এটা শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এটা বলা কঠিন। ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং ডিক্লায়ারেশন করা আছে। আর বাকিগুলো হচ্ছে রেলওয়ের আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এটা যদি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে না রাখা হয় তাহলে এই যাত্রী তোলার প্রবণতা বাড়ার দিকে থাকবে। সুতরাং ডিক্লেয়ারেশনে যে পরিমাণ সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে, সেই পরিমাণেই কিন্তু যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এর বেশি যাত্রী পরিবহনের সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমি পরিবার নিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করব। কিন্তু আমার সিটের আশেপাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকবে, এটা আমার প্রাইভেসির জন্য খারাপ দেখা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানোর কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত আছে যাত্রা শুরুর আগে নন-এসি কোচের শতকরা ২৫ ভাগ টিকিট স্টেশন থেকে যাবে। তারা শুধুমাত্র শোভন ও সুলভ শ্রেণিতে ভ্রমণ করতে পারবেন।
কিন্তু পজ মেশিনের মাধ্যমে প্রারম্ভিক স্টেশন থেকেই জরিমানাসহ গন্তব্যের ভাড়া আদায় করে অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে ট্রেনে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ডিআরএমকে (রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক) বলে দিচ্ছি। শর্ট রুটের জরিমানা করে তাদের ট্রেনে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি আটকে দেওয়া হবে।
এমএইচএন/এসএম