মায়ের ‘অনুপ্রেরণায়’ কাটাছেঁড়া ছাড়াই ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম, স্বপ্নবাজ এক তরুণ চিকিৎসক। কাজ করছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। কার্ডিয়াক সার্জন্স সোসাইটি অব বাংলাদেশের (সিএসএসবি) সাধারণ সম্পাদক পদেও আছেন তিনি। এশিয়া মহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ এ কার্ডিয়াক সার্জনের নেশাই হলো প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করা। ইতোমধ্যে দেশে প্রথমবারের মতো ২-৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে (মিনিমালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি) বা কাটাছেঁড়া ছাড়া হৃদ্যন্ত্রের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন করে দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছেন তিনি।
এতেই ক্ষান্ত দিতে চান না কার্ডিয়াক এ সার্জন। পরবর্তী পরিকল্পনা, দেশের মাটিতে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট (হৃদ্যন্ত্র প্রতিস্থাপন)সহ নতুন কিছুর মাধ্যমে অন্যদেশ থেকে রোগীদের বাংলাদেশমুখী করা। এছাড়া তিনি স্বপ্ন দেখেন কার্ডিয়াক সার্জারির ব্যাপ্তি আরও প্রসারিত করে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার।
সম্ভাবনাময় তরুণ এ চিকিৎসক জীবনের নানা পরিকল্পনা এবং দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তার ভাবনার কথা জানিয়েছেন ঢাকা পোস্টকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : দেশে প্রথমবারের মতো ২-৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাই…
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : হার্টের ডাবল ভাল্ব অপারেশন অত্যন্ত জটিল। এমআইসিএস পদ্ধতিতে মাত্র ২-৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে ভাল্ব প্রতিস্থাপন সারাবিশ্বে অত্যন্ত বিরল। গত মঙ্গলবার (২৫ মে) আমিসহ ১০ জন চিকিৎসকের একটি দল চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় হাসিনা বেগম (৩০) নামের এক রোগীর দেহে সফলভাবে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করি।
সারাবিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে এ ধরনের আধুনিক পদ্ধতিতে অপারেশন হয়। আজ আমরাও সেই মাইলস্টোনে পা দিতে পেরেছি এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পেরেছি।
ঢাকা পোস্ট : এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন বিশ্বের ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা, আপনার অনুভূতি জানতে চাই...
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : অনুভূতি অনেক ভালো। জটিল একটা কাজ করে সফল হওয়া, অনেক ভালোলাগার বিষয়। অনেক আনন্দ ও উৎসাহ পাওয়া যায়। পাশাপাশি যখন দেখি রোগী ভালো হয়ে গেছে এবং তার মুখে হাসি ফুটেছে, তখন সেই আনন্দটা ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি মনে হয়।
এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সহযোগিতা ছিল। তার সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছি। এটাও বড় আনন্দ ও ভালোলাগার বিষয়।
ঢাকা পোস্ট : এ ধরনের অপারেশন সারা পৃথিবীতে খুব কম হয়। এটা নিয়ে কাজ করতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে কি না? কেনই বা এমন জটিল একটা অপারেশনের সাহস করলেন?
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : আমরা যারা তরুণ, তাদের তো সবসময় নতুন কিছু করার স্পৃহা থাকে। নতুন কাজ করা, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালো কিছু করার স্বপ্ন থাকে। এছাড়া আমার মাথায় সবসময় একটা বিষয় কাজ করে যে, কিছু হলেই দেশের মানুষ অন্য দেশে চিকিৎসা নিতে চলে যায়। যখন চিকিৎসক হয়েছি তখন থেকেই ভাবি, আমরা কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব? অন্য দেশ থেকে আমাদের দেশে মানুষ চিকিৎসার জন্য আসবে— এটা আমার স্বপ্ন। আমি এখন যে কাজটা শুরু করলাম, এটা যদি ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারি, আমরা ফাইভ স্টার মানের হসপিটালাইজড সেবা দিতে না পারলেও বিদেশিরা চিকিৎসার জন্য আমাদের দেশে আসবে।
ঢাকা পোস্ট : ভাল্ব প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা বা জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে কি না?
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : যেকোনো কাজ করতে গেলে কিছু না কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ কাজ করতে গিয়ে শুরুতে নিজেকে অনেক বেশি প্রশিক্ষিত হতে হয়েছে, দক্ষতা অর্জন করতে হয়েছে। পাশাপাশি এখানে অর্থনৈতিক ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যাপার রয়েছে।
যখন আপনি খোলা জায়গায় কাজ করবেন, সেটা তত সহজভাবে করতে পারবেন। যখন আপনি সুতা দিয়ে লেপারস্কোপিক করবেন, অবশ্যই সেটা করতে একটু সমস্যা হবে। ভালো প্রশিক্ষিত হতে হবে। তা না হলে এভাবে সাধারণত অপারেশন করা যায় না। এ কারণে পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক সার্জনই এ ধরনের কাজ করেন। যেহেতু আমি নিজে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম এবং কাজটা করতে নিজেকে যথেষ্ট দক্ষতাসম্পন্ন মনে হয়েছে, এ কারণে আমি সহজভাবে কাজটা করতে পেরেছি এবং করে যাচ্ছি।
ঢাকা পোস্ট : যেহেতু দেশে এ পদ্ধতিতে বাল্ব প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এটা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন?
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : এটা যদি আমরা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারি, আশা করি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা এগিয়ে যাবে। এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপন হলো কার্ডিয়াক সার্জারির নতুন একটি ধাপ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খুব স্বল্প পরিসরে এ অপারেশন হয়ে থাকে। এখন থেকে ২০ বছর আগে যখন পৃথিবীতে বিটিং হার্ট সার্জারি শুরু হলো, তখন কিন্তু কেউ বিটিং হার্ট সার্জারি করতে চাইতেন না। ধীরে ধীরে চিকিৎসকরা প্রশিক্ষিত হয়েছেন। এখন দেশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কেস বিটিং হার্ট সার্জারির মাধ্যমে হয়ে থাকে। এমআইসিএস পদ্ধতি যেহেতু পৃথিবীতে নতুন, এটা প্রতিষ্ঠিত হতে এবং এর শতভাগ সুফল মানুষের কাছে পৌঁছাতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লেগে যেতে পারে।
একটা সময় পিত্ত থলিতে অপারেশন করতে চাইলে পেট কেটে অপারেশন করতে হতো। এখন কি কেউ পেট কেটে অপারেশন করতে চান? যেখানেই যাবেন, দেখবেন যে লেপারস্কোপিকে করছে। তেমনি এটা হার্টের লেপারস্কোপিক সার্জারি।
ঢাকা পোস্ট : এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কেমন খরচ হতে পারে?
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : সরকারি হাসপাতালে সবকিছুই আমাদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে হয়তো ভাল্ব সাপ্লাই না থাকলে এটা কিনে নিতে হয়। আর আনুষঙ্গিক কিছু খরচ হয়ে থাকতে পারে। তবে প্রাইভেট হাসপাতালে এ চিকিৎসায় যা খরচ হবে, তার এক-তৃতীয়াংশও সরকারি হাসপাতালে হবে না।
সরকারি হাসপাতালের খরচ হাসপাতাল ভেদে ভিন্ন হতে পারে। এখনো কোনো বেসরকারি হাসপাতালে এ অপারেশন কেউ করেনি, শুরু হলে বলা যাবে কেমন খরচ পড়তে পারে।
ঢাকা পোস্ট : দেশে প্রথমবারের মতো এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন, এটা তো নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। এ অর্জনের কৃতিত্ব আপনি কাকে দিতে চান?
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : আমার যত অর্জন তার কৃতিত্ব সর্বপ্রথম মাকে দিতে চাই। কারণ তার অনুপ্রেরণায় আমি চিকিৎসক হয়েছি। সঙ্গে বাবা, ভাই-বোন ও পরিবার থেকেও অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। তারপর এ কাজটা সম্পন্নের জন্য আমি যখন স্বপ্ন দেখেছি, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করেছেন। যখন আমি সরাসরি ওনার সঙ্গে দেখা করে বলেছি যে, আমি এটা করতে চাই; তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যন্ত্রপাতি কিনে দেওয়াসহ সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেন।
ঢাকা পোস্ট : আগামী দিনে আপনার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে?
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : সামনের দিনে যতটুকু সম্ভব এমআইসিএস পদ্ধতিটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এ কাজে দক্ষ জনবল তৈরি করা। এরপর তাদের বিভিন্ন সেন্টারে ছড়িয়ে দিয়ে এ সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। দেশে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট (প্রতিস্থাপন) হয় না। সার্বিক সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করারও ইচ্ছা আছে।
এক নজরে ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম
শরীয়তপুরের কৃতি সন্তান ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম। বাবা প্রকৌশলী মো. আবুল হাসেম মিয়া। মা বেগম আশরাফুন্নেসা, রত্নগর্ভা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে। পরিবারে রয়েছে তিন ভাই ও এক বোন।
বড় ভাই এ কে এম এনামুল হক শামীম, বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেজ ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। একমাত্র বোন শামীম আরা হক কাকলী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত।
আশ্রাফুলের মনে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন তার মা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। মা বরাবরই প্রেরণা দিতেন চিকিৎসক হওয়ার জন্য। মায়ের প্রেরণা আর স্বপ্নপূরণের চেষ্টায় পরিশ্রম করেছেন তিনি।
ঢাকার খিলগাঁও সরকারি স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এমবিবিএস পড়া অবস্থায় ২০০২-২০০৪ সালের দিকে যখন দেখেন এ দেশে মাত্র বাইপাস সার্জারি স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে এবং দেশের বেশির ভাগ মানুষ এ রোগের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন, তখন থেকে স্বপ্ন দেখেন একজন কার্ডিয়াক সার্জন হয়ে দেশের মানুষের সেবা করার। এমবিবিএস শেষ করার পর তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালের প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন ডা. লুৎফর রহমানের তত্ত্বাবধানে তিন বছর কাজ করেন। কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে এমএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ও প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন ডা. ফারুক আহমেদের সঙ্গেও কাজ করেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন আশ্রাফুল হক সিয়াম। এরপর এমএস করার জন্য বেছে নেন কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক সার্জারি। ২০১৬ সালে তিনি কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক সার্জারিতে এমএস শেষ করে কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে যখন চিকিৎসা ক্যারিয়ার শুরু করেন তখন তার বয়স ৩৫ বছর। কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে ইউনিট চিফ বা প্রধান হওয়া অত্যন্ত সম্মানের। ২৬তম ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব থোরাসিক অ্যান্ড কার্ডিওভাসকুলার সার্জনস অব এশিয়া’ কনফারেন্সে সবচেয়ে তরুণ কার্ডিয়াক সার্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মাননা পান তিনি। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আবাসিক সার্জন হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান।
কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের ইউনিট- ৯ এর চিফ বা প্রধান হিসেবে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে দায়িত্ব পালন শুরু করেন ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম। তখন তার বয়স ৩৬ বছর। বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২০ জনের মতো চিফ কার্ডিয়াক সার্জন/ইউনিট চিফ আছেন। তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ তিনি।
ডা. সিয়াম সরকারি হাসপাতালে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট প্রথম এমআইসিএস পদ্ধতিতে ২-২.৫ ইঞ্চি ছিদ্র করে হার্টের অপারেশন শুরু করায় টিওওয়াইপি-২০১৯ (TOYP-2019) অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
স্ত্রী তাসমীন রুবাইয়াত অরিনও পেশায় চিকিৎসক। সোয়াইদাহ আশ্রাফী আরীবাহ, আদিয়াত ঋক্ষ হাসেমী ও আযফীর রুঝলান হাসেম নামের তিন সন্তানের জনক ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম।
টিআই/এইচকে/এমএআর/