করোনা চিকিৎসার কেনাকাটায় দুর্নীতি নিয়ে ফের অনুসন্ধান দুদকের

বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য সরঞ্জাম ক্রয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে ফের নড়েচড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিজ্ঞাপন
প্রধান অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের (ইআরপিপি) আওতায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার কাজে মাস্ক-পিপিই, হাসপাতালের সরঞ্জামাদি, সচেতনতায় বিজ্ঞাপন ও অ্যাপ নির্মাণে দুর্নীতি। করোনা মহামারি-২০২০ এর পাঁচ বছর পর অনুসন্ধানের জন্য এবার পাঁচ সদস্যের টিম গঠন করেছে দুদক।
সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে টিমের অপর সদস্যরা হলেন– সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান, মো. শাহজাহান মিরাজ, মো. ফারুক হোসেন ও উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন।
বিজ্ঞাপন
যদিও করোনার মতো মহামারির মধ্যে নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয় ও সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের (সিএমএসডি) ছয় কর্মকর্তা ও জেএমআই হাসপাতাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের কর্ণধার মো. আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল দুদক। তবে ওই মামলার তদন্ত আর এগোয়নি বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
মামলার এজাহারে জেএমআই গ্রুপের ২০ হাজার ৬১০টি সরবরাহ করা মাস্ক এন৯৫ ছিল না– এমন প্রমাণ পাওয়ার পরও অদৃশ্য কারণে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন আসামিরা। ওই অভিযোগের সঙ্গে এবার নতুন অভিযোগ যুক্ত হয়েছে। যা আমলে নিয়ে নতুন করে অনুসন্ধানে নেমেই নতুন টিম গত ২০ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছেন বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।
তলবি চিঠিতে যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে– ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রজেক্টেন (ইআরপিপি) আওতায় ছয়টি প্রতিষ্ঠান জাদিদ অটো মোবাইলস আইএআই (জাহিদ), এসআরএস ডিজাইন অ্যান্ড ফ্যাশন লিমিটেড, এসআইএম কর্পোরেশন, ইনশা ট্রেড কর্পোরেশন, ব্রেইন স্টেশন ২৩ লিমিটেড ও ই-মিউজিকের মাধ্যমে ২০২০ সালে মাস্ক, পিপিই এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয় সংক্রান্ত অনুমোদনপত্র, বরাদ্দপত্র, বাজারদর যাচাই প্রতিবেদন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি, ঠিকাদার কর্তৃক দাখিল করা দরপত্রের কপি।
আরও চাওয়া হয়েছে ওই প্রজেক্টের দাখিল করা রেকর্ডপত্র, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন ও দরপত্রের তুলনামূলক বিবরণী, ঠিকাদার কর্তৃক সরবরাহ করা মালামাল আমদানি সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র, মালামাল রিসিভ কমিটি গঠন, মালামাল বুঝে নেওয়া সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র, বিল রেজিস্ট্রার, বিল ভাউচারসহ এসব মালামাল ক্রয় সংক্রান্ত নথির সত্যায়িত ফটোকপি। এসব রেকর্ডপত্র জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্যের মহাপরিচালককে অনুরোধ করেছে দুদক টিম।
এ বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার নিমিত্তে নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গঠিত অনুসন্ধান দল দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে কাজ শুরু করেছে। অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারব।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিলে বিশ্ব ব্যাংক ও বাংলাদেশ যৌথভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। এতে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকও অতিরিক্ত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়। ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের (ইআরপিপি) আওতায় মাস্ক-পিপিই, হাসপাতালের সরঞ্জামাদি, সচেতনতায় বিজ্ঞাপন ও অ্যাপ নির্মাণে ঠিকাদারি কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ও পিডি ডা. ইকবাল কবির পদে পদে নানা অনিয়ম করেন। কাজ পাওয়া ছয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণও মিলেছে।
বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদন সম্প্রতি দুদকে জমা হয়েছে।
আরও পড়ুন
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জাদিদ অটোমোবাইলস পায় মাস্ক-পিপিই সরবরাহের কাজ। অনৈতিকভাবে কাজ পেয়ে সরবরাহ করে নিম্নমানের সরঞ্জামাদি। এ ছাড়া পিডির স্ত্রীর কোম্পানিকে ২৯ হাজার ৫০০ ডলার ঘুষ দেওয়ারও অভিযোগ আছে। কাজ শেষের আগেই অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ, পিডির পরিচিত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়াসহ নানা অসংগতি মিলেছে।
এ অবস্থায় তদন্ত প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে দুদককে পরামর্শ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।
অন্যদিকে, করোনা মোকাবিলায় নেওয়া ইআরপিপি প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে– এমন অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। যেখানে উঠে এসেছে করোনাকালে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিইর মতো জরুরি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকল্প থেকে ৩২ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে নামসর্বস্ব অটোমোবাইলস কোম্পানিকে (গাড়ি ব্যবসায়ী)। সাড়ে ৯ কোটি টাকা আগাম দেওয়ার পরও যথাসময়ে কোনো মালামাল দেওয়া হয়নি। পরে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে কিছু মাস্ক ও গ্লাভস সরবরাহ করে তারা, যার মধ্যে ২৪ হাজার মাস্ক ব্যবহারের অনুপযোগী।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করা প্রকল্পের বিপুল কেনাকাটায় সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর) ও ক্রয় আইন (পিপিএ) লঙ্ঘনের অভিযোগও আনা হয়। প্রতিবেদনে উঠে আসে কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা যাচাই ছাড়াই জাদিদ অটোমোবাইলসকে ৩২ কোটি টাকার কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তার সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল।
ইআরপিপি প্রকল্প নিয়ে আগের আরেকটি অভিযোগ বলছে, করোনাকালে এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রথমে স্বাস্থ্য কেনাকাটার দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এন-৯৫-এর মোড়কে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) কর্তৃপক্ষ। জানা যায় এন-৯৫-এর মোড়কে সাধারণ মাস্কগুলো সিএমএসডিকে সরবরাহ করেছিল জেএমআই হাসপাতাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। যদিও সিএমএসডি দাবি করে, তারা এন-৯৫ মাস্কের কোনো কার্যাদেশ জেএমআইকে দেয়নি। পরে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। তাছাড়া এন-৯৫ মাস্ক এবং পিপিই ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতি বা প্রতারণার কিছু অভিযোগ দুদকের হটলাইন ১০৬-এ আসে। যার সূত্র ধরে ২০২০ সালের জুনে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক।
আরএম/এসএসএইচ