বিএসএমএমইউ’র নতুন নাম চূড়ান্ত, ঘোষণা শিগগিরই

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর থেকে দেশে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের কার্যক্রম। এর মধ্যে সম্প্রতি ভারতে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিষয়টি আবারও সামনে আসে।
উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের শেখ হাসিনার পৈত্রিক বাড়ি। এর প্রভাব পড়ে সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায়। ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ চিকিৎসা শিক্ষার বিদ্যাপীঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও (বিএসএমএমইউ)।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম সম্বলিত সাইনবোর্ড। এরপরই নাম পরিবর্তনের বিষয়ে নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিশেষ সিন্ডিকেট সভা করে বিএসএমএমইউ প্রশাসন। সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ১০টির বেশি নাম উঠে আসে। তবে সিন্ডিকেট সভায় সর্বশেষ দুটি নাম বাছাই করা হয় এবং একটি নামকে সম্ভাব্য চূড়ান্ত বলে জানানো হয়।
নতুন যে নামে আসছে বিএসএমএমইউ
সম্ভাব্য চূড়ান্ত নামসহ দুটি বাছাই করা নাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে চূড়ান্ত বাছাই শেষে শিগগিরই রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে নতুন নাম ঘোষণা হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিন্ডিকেট সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় মোটামুটি একটি নাম সিলেক্ট করা হয়েছে। তবে সদস্যদের মতামত অনুযায়ী দুটি নাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পাঠানো হয়েছে, যার একটি হলো বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেস। আর অন্যটি হলো বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি। তবে এ দুটির মধ্যে অধিকাংশ সদস্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেস নামের পক্ষে মতামত দিয়েছেন।
নাম চূড়ান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন সময়ের দাবি। বিভিন্ন সময় জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি নাম চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছি। আশা করছি সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমরা নতুন নাম পেয়ে যাব।
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধুর নাম দিয়ে সীমাহীন লুটপাট
বঙ্গবন্ধুর নামে গড়া প্রতিষ্ঠানটিতে গত ১৫ বছর ধরে একক আধিপত্য চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসক নেতারা। প্রতিষ্ঠানটিতে বঙ্গবন্ধুর নাম থাকায় সরকারিভাবে অন্যদের তুলনায় সবসময় বেশি গুরুত্ব পেত হাসিনা পরিবারের আস্থাভাজনরা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, যেকোনো নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা নেওয়া হলে কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই হয়ে যেত অর্থছাড়। আর এ সুযোগ নিয়ে নজিরবিহীন লুটপাট চালিয়েছেন হাসিনা পরিবারের আস্থাভাজন কর্মকর্তারা।
ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দায়িত্ব পালন করা সব উপাচার্যের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেপরোয়া ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ। তার বেপরোয়া নিয়োগ বাণিজ্য আর স্বজনপ্রীতিতে অতিষ্ঠ ছিলেন অন্য কর্মকর্তারাও।
বিশ্ববিদ্যালয়টির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শারফুদ্দিন আহমেদের সময়ে ‘২০ লাখ না ৩০ লাখ’ এরকম একটা স্লোগান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি পদোন্নতিতে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা গুনতেন। তার এমন কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদেরই লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যেত। তার বিরুদ্ধে যেই কথা বলত, তাকেই মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হতো।
শুধু নাম পরিবর্তনই নয়, কাঠামোগত সংস্কারের দাবি
গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন চিকিৎসক-কর্মকর্তারা। তাদের প্রত্যাশা, এ ‘পরিবর্তন’ যেন নামেই সীমাবদ্ধ না থাকে। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কাঠামোগত সংস্কারও জরুরি বলে মনে করেন তারা।
রেসিডেন্সি চিকিৎসক ডা. মশিউর রহমান বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। হাসিনার পতনের ছয় মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিএসএমএমইউর নামটা পরিবর্তন করতে পারলাম না, এটা আমাদের জন্য লজ্জার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবার নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে, এটাকে স্বাগত জানাই।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নাম দিয়ে এতদিন যে লুটপাট আর স্বজনপ্রীতি হয়েছে, তা যেন আর কোনোদিন ফিরে না আসে। শুধু নামের পরিবর্তন নয়, আমরা চাই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হোক। বর্তমান উপাচার্যকে এসব ক্ষেত্রে খুবই বিচক্ষণ মনে হয়েছে, আশা করছি এতদিনের বদনাম তিনি ঘোচাতে পারবেন।’
এ প্রসঙ্গে আরেক চিকিৎসক ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমাদের কোনো ক্ষোভ নেই কিন্তু তার কন্যা গণহত্যা ও অপশাসন চালিয়ে দেশের পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে যে, এখন আর আমাদের কিছুই করার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম পরিবর্তনের পক্ষে। কারণ, বিগত প্রশাসন এ নাম দিয়ে লুটপাট চালিয়েছে।’
‘একদিকে আমরা যেমন নাম পরিবর্তন চাইছি, তেমনি যারা লুটপাট-দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কলঙ্কিত করেছে তাদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
নাম পরিবর্তন-সংস্কার নিয়ে কী ভাবছে বর্তমান প্রশাসন?
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি আসছে। আমরা তখনই নীতিগতভাবে পরিবর্তনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর পৃথক কমিটি করে নাম যাচাই-বাছাই শুরু করেছি। সবশেষ আমরা দুটি নাম চূড়ান্ত করেছি, যা ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া। আমরা চাইলেই যেকোনো মুহূর্তে নাম পরিবর্তন করে নতুন ব্যানার টানিয়ে দিতে পারি না। আমরা নাম পাঠিয়েছি, সেটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চূড়ান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে নাম পরিবর্তনের ঘোষণা আসবে। সেই হিসেবে আমরা পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মাঝামাঝি অবস্থানে আছি।’
সংস্কার প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যে প্রশাসন এসেছে, আমরা চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে, তদন্ত সম্পন্ন করে আমরা দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এ ছাড়া বিগত সময়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি, বিশেষ করে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজি; এগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন বেশ কিছু তদন্ত কমিটি করেছে।’
তিনি বলেন, ‘তদন্ত রিপোর্টগুলো একের পর এক আমাদের হাতে আসতে শুরু করেছে। এসবের ওপর নির্ভর করে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম চলছে। যদি এ সংস্কারগুলো করতে পারি, সব অনিয়ম-দুর্নীতির মূলহোতাদের যদি আইনের আওতায় আনতে পারি, তাহলে আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসবে।’
আইপিজিএমআর থেকে যেভাবে বিএসএমএমইউ
১৯৬৫ সালে চিকিৎসায় স্নাতকোত্তর কোর্স চালুর জন্য সর্বপ্রথম ঢাকায় ‘ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ’ (আইপিজিএমআর) প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ কাউন্সিলের উপদেষ্টা স্যার জেমস ডি এস কেমেরন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও অধ্যাপক একেএস আহম্মদ– এ তিনজনকে নিয়ে গড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা-গবেষণার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও ডিগ্রি দেওয়ার এখতিয়ার ছিল না এ প্রতিষ্ঠানের। তখন আইপিজিএমআর’র কার্যক্রমসহ অনেক মেডিকেল কলেজেরই এমবিবিএস ডিগ্রি দিতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের অনুরোধে তৎকালীন মন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী মুসলিম লীগের পরিত্যক্ত ভবনকে (ব্লক-এ) পোস্টগ্র্যাজুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেন। এরপর ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয় করে নাম দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, যার প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক কাদরী। নতুন নামকরণ হলেও সেই সময় থেকে এখনো অনেকে এ হাসপাতালকে পিজি হাসপাতাল হিসেবেই চেনেন।
একনজরে বিএসএমএমইউ
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন আইপিজিএমআরের যাত্রা শুরু হয়েছিল সাতটি কোর্স দিয়ে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমডি, এমএস, এমপিএইচ, এমফিল, ডিপ্লোমাসহ পোস্টগ্র্যাজুয়েট বিষয়ের সংখ্যা ১০৬টি। রেসিডেন্সি কোর্সের সংখ্যা ৭০টি। অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫৪টি। অনুষদের সংখ্যা সাতটি। বিভাগের সংখ্যা ৫৭টি। রয়েছে ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)।
বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে প্রতি বছর আট শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন এবং প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকছে ক্যাম্পাস। দেশের শিক্ষার্থী ছাড়াও নেপাল, ভারত, বতসোয়ানা, সোমালিয়া, ইরান, কানাডা, মালদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছেন। চালু করা হয়েছে বহুল প্রত্যাশিত পিএইচডি প্রোগ্রামও।
টিআই/এমজে/এসএসএইচ