সমতাভিত্তিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়তে চাই

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। একাধারে লেখক-প্রতিথযশা অর্থনীতিবিদ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরে যাওয়ার পর ২০০৫ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পান ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ পদ সামলান তিনি। গভর্নরের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর দেশের ঘুণে ধরা অর্থনীতির চাকা সচল করার দায়িত্ব পড়ে সাবেক এ গভর্নরের কাঁধে। বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের পুঁজিবাজার, ব্যাংক খাতের অস্থিরতা, বিদেশি বিনিয়োগসহ নানা সংকটে থাকা অর্থ খাতকে দায়িত্বের সঙ্গে সামলাচ্ছেন তিনি।
উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জসমূহ, বিদেশি বিনিয়োগ ও সংস্কার-পরবর্তী বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হন তিনি। একান্ত সাক্ষাৎকারে এ খাতের বিভিন্ন সংকট ও সম্ভাবনার কথা জানান অর্থ উপদেষ্টা। দেন সমাধানের উপায়ও। ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো-
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : সংস্কার-পরবর্তী কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার করার চেষ্টা করছে। তবে, মনে রাখা ভালো সংস্কারের মধ্যে কিছু আছে আশুকরণীয় এবং কিছু জিনিস সময়সাপেক্ষ। আবার কিছু জিনিস আছে যেগুলো ওই দুটির মাঝামাঝি সময় সম্পন্ন করা সম্ভব। আমরা হয়তো আশুকরণীয় বিষয়গুলো সম্পন্ন করতে পারব। আর মধ্যমেয়াদি বিষয়গুলো একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রেখে যেতে পারব।
সংস্কার বিষয়টি হলো ব্যাপক একটি কর্মযজ্ঞ। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেটি আমরা শুরু করে দিয়েছি। রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে অর্থনৈতিক; তথ্য, বিজ্ঞান কিংবা স্বাস্থ্য— সবকিছু এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মোট কথা, একটি দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক চলে আসে সংস্কারের মধ্যে। এটি সম্পন্ন হলে যেটি হবে, এতদিন আমরা যেগুলো ন্যারেটিভ শুনেছি, যেমন- বাংলাদেশ উন্নত হয়েছে; হ্যাঁ, বাংলাদেশ যথেষ্ট ভালো করেছে কিন্তু উন্নতির সুফলটা ঠিকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।
আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ যেন একটি সমতাভিত্তিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সবার জন্য যেন একটি ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্র হয়। যার যা অবদান, সে যেন তার ফল পায়। সেই বাংলাদেশ দেখার জন্য আমরা তাকিয়ে আছি।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না, যদি নিয়ে থাকে তাহলে সেগুলো কী কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এটা ঠিক যে, পূর্বের তুলনায় আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে দেশে নানা অস্থিরতা চলে আসছে। এরপর তো জুলাই বিপ্লব হলো।
বিদেশি বিনিয়োগটা আসলে কমে গেছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে হবে, এটিই মূল বিষয়। তারা যে এখানে আসবেন এবং ব্যবসা করবেন, সেই পরিবেশটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষ তৎপরতা প্রয়োজন। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে যেন দুর্নীতি না হয়, তারা যেন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে; পাশাপাশি বন্দর-কাস্টমসহ সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেন যথাসময়ে সেবা প্রদান করতে পারে, সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া সরকারের নীতিনির্ধারণ কার্যক্রম যেন আরও স্পষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি হয়, সেই বিষয়েও আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। এগুলো করতে পারলে বাইরের বিনিয়োগকারীদের আমরা আরও বেশি আকৃষ্ট করতে পারব। তারাও বুঝতে সক্ষম হবেন যে, এখানে বিনিয়োগ করলে তারা লাভবান হবেন।
ঢাকা পোস্ট : দায়িত্বগ্রহণের পর আপনার মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সার্বিকভাবে আমার মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। চ্যালেঞ্জটা এখনও আছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং সেক্টরে চলমান বিশৃঙ্খলাগুলো শৃঙ্খলার মধ্যে আনা, এটিও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে ফরেন রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল, এটিও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আরেকটি বিষয় ছিল জ্বালানির সংকট। এটিও আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি, বাইরে থেকে প্রচুর জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
এটি ঠিক যে, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ না থাকার কারণে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটেছে। আমরা চেষ্টা করেছি সেগুলো কাটিয়ে উঠতে।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : ১৬ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরে পা দিচ্ছে ঢাকা পোস্ট। প্রতিষ্ঠানটির কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য বিশেষ কোনো বার্তা দেবেন কি না?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : ঢাকা পোস্ট সবসময় মানুষের জীবনস্পর্শী সংবাদ পরিবেশন করে আসছে। আমি ঢাকা পোস্টের সকল কলাকুশলী ও সংবাদকর্মীর মঙ্গল কামনা করছি। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ এবং নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যারা সম্পৃক্ত, তাদের নিয়ে ঢাকা পোস্ট যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করবে, সেগুলোতেও মানুষ উপকৃত হবেন এবং ঢাকা পোস্টের জনপ্রিয়তা বাড়বে।
একই সঙ্গে আমার প্রত্যাশা, গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সামনের দিনগুলোতে যে সংগ্রামে জাতিকে অবতীর্ণ হতে হবে, সেই লড়াইয়ে জনমত গঠনে ঢাকা পোস্ট সাহসী ভূমিকা পালন করবে।
এমএম/এসআর/এমজে