‘বাংলাদেশ’ নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমে আলোচিত যত খবর

২০২৪ সাল, বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এক বছর। দেশ ও জনগণের বিজয়ের এ বছরে বাংলাদেশ স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। ছাত্র-জনতার অদম্য লড়াই আর হাজারও শহিদের রক্তের বিনিময়ে দেশ মুক্ত হয়েছে হায়েনার গ্রাস থেকে। কার্যত ১৯৭১ সালের পরে ২০২৪ সালই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাবহুল বছর।
এ বছরে নানা কারণে বিদেশি গণমাধ্যমে বারবার আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের দীর্ঘকালীন স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনাকে উৎখাত ছিল সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এ ছাড়া বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারাদণ্ড, ভারতবিরোধী প্রচারণা ও রাজনীতি, রাজধানীর বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি, বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাই, ভারতে বাংলাদেশের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিম নিখোঁজ, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ইস্যু বিদেশি গণমাধ্যমগুলো বেশ ফলাও করে প্রচার করছে।
পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সমীকরণের মুখে দূরত্ব ঘুচিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক স্থাপন, দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টিও বিদেশি গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে টানাপোড়েন ও উত্তাপ নিয়েও সংবাদ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যম।
ড. ইউনূসের কারাদণ্ড
২০২৪ সালের শুরুর দিনই অর্থাৎ ১ জানুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে দোষীসাব্যস্ত হন। তিনিসহ গ্রামীণ টেলিকমের অন্য তিনজনের প্রত্যেককে ঢাকার শ্রম আদালত ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন এবং পরবর্তীতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার শর্তে এক মাসের জামিন দেন। এ ছাড়া প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন ঢাকার শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের ওই মামলা নিয়ে এর আগেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও শতাধিক নোবেলজয়ী উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তবে, বছরের শুরুতে ড. ইউনূসকে দোষীসাব্যস্ত করে কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রকাশ করা হয়।
ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছয় মাসের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। শ্রম আইনের একটি মামলার রায়ে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করেছেন তার সমর্থকরা।
ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপির প্রতিবেদনই বিশ্বের বেশিরভাগ গণমাধ্যম প্রকাশ করেছিল। এ ছাড়া মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ, ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স, কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা, হংকং-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু, হিন্দুস্তান টাইমস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের গালফ নিউজ, মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম মালয়েশিয়ান ইনসাইট, পাকিস্তানের এআরওয়াই নিউজসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণার সেই সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল।
৭ জানুয়ারি : আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন
আগের বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে। সেই টানাপোড়েনের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপস্থিতি এবং ভোটার উপস্থিতির কম হারের কারণে বিতর্কিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
তবে, বিতর্কিত সেই নির্বাচনেই বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। বিএনপি ও জামায়াতবিহীন ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই শতাধিক আসন পেলেও আগের সংসদের ‘বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি আসন পায়। তবে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে পান ৬২টি আসন। ফলে সংসদে বিরোধী দল কে হবে, তা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়।
বিতর্কিত সেই নির্বাচনকে ঘিরে কয়েক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলে, বিতর্কিত নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয় নিশ্চিত করায় শেখ হাসিনা আরও পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করতে চলেছেন। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচন বর্জন করায়, শেখ হাসিনার দল এবং মিত্ররা বাকি আসনগুলোতেও জয়ী হবে বলে আগেই আশা করা হয়েছিল। বিএনপি এ নির্বাচনকে বানোয়াট বলে অভিযোগ করেছে।
আরও পড়ুন
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, এ নির্বাচনের চমক হিসেবে সামনে এসেছে দ্বিতীয় অবস্থানে স্বতন্ত্রদের উঠে আসা। কোনো রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোট ৬৩টি আসন পেয়েছে, যা হাসিনার আওয়ামী লীগের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এটিই দেশটিতে সংসদীয় বিরোধী দল খুঁজে পেতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
আল জাজিরা আরও জানায়, প্রায় সব বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী এমন লোক ছিল যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কিন্তু দলের নেতৃত্ব তাদের ‘ডামি প্রার্থী’ হিসেবে ভোটে দাঁড়াতে বলে। যাতে নির্বাচনকে বিশ্বের সামনে একটি প্রতিযোগিতামূলক ভোট হিসেবে দেখানো যায়। প্রখ্যাত বাংলাদেশি অধিকার কর্মী এবং ফটোগ্রাফারও আল জাজিরাকে বলেন, ‘এটি একটি উদ্ভট নির্বাচনের একটি উদ্ভট ফলাফল। ডামি নির্বাচনে ডামি প্রার্থীরা এখন ডামি সংসদে যাবে।’
এ ছাড়া ফরাসি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স২৪ ছাড়াও মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ, বার্তাসংস্থা রয়টার্স, পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডন, দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, জিও নিউজ, ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু, তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিতর্কিত ওই নির্বাচন নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
ভারতবিরোধী রাজনীতি ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
বিতর্কিত ওই নির্বাচনের পরপরই নতুন রূপে ভারতবিরোধী রাজনীতি দানা বাঁধতে শুরু করে বাংলাদেশে। এ সময় ‘ভারতীয় পণ্য বয়কট’, ‘বয়কট ইন্ডিয়া’ ও ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনও বেশ গতি পায়।
বিতর্কিত নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার জন্য দায়ী করা হয় ভারতের সমর্থনকে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে রীতিমতো রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক শুরু হয়। এ বিষয়ে আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সামনে আসে।
পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি সচল থাকলেও ভিসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে উভয় দেশের জনসাধারণ পর্যায়েও সম্পর্কের বড় অবনতি ঘটে।
আরও পড়ুন
একদিকে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংখ্যালঘু ও হিন্দুদের ওপর হামলা এবং অত্যাচারের নানা রকম তথ্য, অপতথ্য ও গুজব ব্যাপকভাবে প্রচার হতে থাকে। অন্যদিকে, অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতা ও বাংলাদেশের শীর্ষপর্যায় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিগুলো থেকে ভারতকে নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য করা হয় তাতেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-বিবৃতিও চলতে থাকে। আগস্টের শেষ ভাগে বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করে। প্রাথমিকভাবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার খবর জানা গেলেও পরবর্তীতে রাজ্য সরকার দাবি করে, পানি উপচে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশকে প্লাবিত করেছে। তবে, এ ঘটনায় ভারত সরকারের প্রতি অসহযোগিতা ও অমানবিকতার অভিযোগ করেন বহু বাংলাদেশি।
ভয়াবহ ওই বন্যা, পাশাপাশি অন্যান্য ইস্যুতে ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্ক নিয়ে প্রায় সব ভারতীয় গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডের একটি রেস্টুরেন্ট ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আরও ৭০ জনেরও বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে আহত অবস্থায় উদ্ধার হন। গ্রিন কোজি নামক বহুতল ভবনে ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। ভবনটিতে একাধিক রেস্তোরাঁ ও দোকান ছিল।
ওই ঘটনা আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা রয়টার্স, এএফপি, এপি, এএনআই, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, সিএনএন, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, আল আরাবিয়া নিউজ, আরব নিউজ, এনডিটিভি ও হিন্দুস্তান টাইমসসহ প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশ পায়। এমনকি দুর্ঘটনার পর থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘তাৎক্ষণিক খবর’ হিসেবেও এটি প্রচার করা হয়।
ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে গ্রিন কজি কটেজ নামে একটি ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। খুব অল্প সময়েই পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটির নিচের দিকে আগুন লাগে এবং পড়ে তা ওপরে ছড়িয়ে পড়ে। নিচতলায় আগুন লাগার কারণে ভবনটির ওপরের তলাগুলোতে আটকে পড়েন অনেকে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য ওপর থেকে মানুষ লাফিয়ে পড়েন। সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেও অনেকে ব্যর্থ হন।
আরও পড়ুন
সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার থাকার কারণে পুরো সিঁড়ি ‘অগ্নিচুল্লি’ হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারেননি। ভবনটিতে আগুন নেভানোর তেমন ব্যবস্থা ছিল না বলেও জানায় ফায়ার সার্ভিস। বিবিসি ওই সময় অগ্নিকাণ্ডের খবর প্রকাশ করে বলে, বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে আগুন লাগা বেশ সাধারণ ঘটনা। এসব অগ্নিকাণ্ডের জন্য প্রায়ই দুর্বল নিরাপত্তা সচেতনতা এবং আইনের অপর্যাপ্ত প্রয়োগকে দায়ী করা হয়।
রয়টার্স জানায়, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশ সাধারণ। আগুনের ঘটনা এখন নতুন ভবনেও বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত এসব ভবন প্রায়ই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মিত। ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার, এয়ার কন্ডিশনার এবং দুর্বল বৈদ্যুতিক তারের কারণে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাই
২০২৪ সালের মার্চে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। মূলত গত ১২ মার্চ দুপুরে এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়। আটকের পর জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জিম্মি থাকা অবস্থায় মালিকপক্ষের তৎপরতায় সমঝোতা হয় জলদস্যুদের সঙ্গে।
একপর্যায়ে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ৩টার পর এমভি আবদুল্লাহ থেকে দস্যুরা নেমে যায়। একই দিন বিকেলে দস্যুরা তাদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ বুঝে নেন। একটি বিশেষ উড়োজাহাজে মুক্তিপণ বাবদ তিনটি ব্যাগভর্তি ডলার এমভি আবদুল্লাহর পাশে সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়। স্পিড বোট দিয়ে দস্যুরা ব্যাগ তিনটি কুড়িয়ে নেন। দস্যুমুক্ত হয়ে সোমালিয়ার উপকূল থেকে আরব আমিরাতের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ।
চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় গণমাধ্যমসহ বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদের শিরোনাম হয়। এ ছাড়া বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিয়মিত সংবাদে সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি এ জাহাজের গতিবিধি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিজস্ব নৌবাহিনী ও ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ পর্যবেক্ষণ করে বলে জানা যায়। এমনকি এমভি আবদুল্লাহতে সোমালি জলদস্যুরা বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র বসিয়েছে বলেও খবর প্রকাশ পায়।
আরও পড়ুন
ওই বছরের ১৮ মার্চ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধারে দেশটির পুলিশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর সদস্যরা মিলে যৌথ অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। জলদস্যুদের হাত থেকে ভারতীয় নৌবাহিনী অন্য একটি জাহাজ উদ্ধারের দুদিন পর এ অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয় বলে দেশটির পুন্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ জানায়।
বার্তাসংস্থাটি আরও জানায়, প্রায় এক দশক ধরে ওই অঞ্চলের সমুদ্রপথে সোমালি জলদস্যুরা ছিনতাই চালিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে (ওই সময় পর্যন্ত) ২০টিরও বেশি জাহাজে আক্রমণ চালিয়েছে তারা। সোমালি জলদস্যুদের সর্বশেষ ছিনতাইয়ের শিকার বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ।
ভারতে সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিম নিখোঁজ
২০২৪ সালের ২২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ উদ্ধার হয়। ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে ১৩ মে থেকে নিখোঁজ হন তিনি। ২০ মে পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, ২২ মে সকালে কলকাতার নিউটাউনে অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেন থেকে তার শরীরের কিছু অংশ উদ্ধার হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, গত ১৩ মে নিউটাউনের সেই বাড়িতে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
ঘটনাটি বাংলাদেশ ও ভারতে, বিশেষ করে ভারতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশটির কলকাতাভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোর পাশাপাশি সর্বভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশি সংসদ সদস্য নিখোঁজ ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গুরুত্বসহকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রসঙ্গত, ১২ মে পশ্চিমবঙ্গে যান ঝিনাইদহের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে যান। পরদিন ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলে জানান তিনি। বিধাননগর পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি। চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আনার তার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেন।
১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকার সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করা হয়। ২২ মে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়, কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে টুকরো টুকরো করে খুন করা হয়েছে। কলকাতা পুলিশ অভিযান চালিয়ে সঞ্জীবা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রায় চার কেজি মাংস উদ্ধার করে। ঘাতকরা সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্লাটে এমপি আনারের মরদেহ টুকরো টুকরো করে টয়লেটে ফ্ল্যাশ করেন। এ ছাড়া শরীরের হাড় কলকাতার ভাঙ্গরের বাগজোলা খালের বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয় তারা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং গৌরবোজ্জ্বল গণঅভ্যুত্থান
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর হিসেবে বিবেচিত হবে ২০২৪ সাল। এ বছরই গত সাড়ে তিন দশকে দ্বিতীয়বারের মতো অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের ঘটনা ঘটে। ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এ বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন নতুন না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতায় থাকা কোনো সরকারপ্রধানের আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ এবং অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার নজির এটাই প্রথম।
বাংলাদেশের টানা চারবারের প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রীর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বিশ্বগণমাধ্যমে প্রধান শিরোনাম হিসেবে স্থান পায়। তার পালিয়ে যাওয়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়নের খবর প্রকাশ করেছিল ‘বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের নেত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন’ শিরোনামে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর জনগণ গণভবনে প্রবেশ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির সামনে জনতার ক্ষোভ প্রকাশের দৃশ্যও উঠে আসে তাদের প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া বিবিসির শিরোনাম ছিল— ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, আন্দোলনকারীরা গণভবন দখল করেছে’। আল জাজিরার শিরোনাম ছিল— ‘সামরিক হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা, গণভবনে ঢুকে পড়েছেন হাজারও মানুষ’।
এএফপির শিরোনাম ছিল— ‘শেখ হাসিনা নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছেন। হাজারও মানুষ গণভবনে প্রবেশ করেছেন’। রয়টার্সের খবর ছিল— ‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন এবং ছেড়ে গেছেন বাংলাদেশও’।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের শিরোনাম ছিল— ‘এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ও আন্দোলনের পর পদত্যাগ করলেন শেখ হাসিনা’। ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছিল— ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং দ্রুত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তুতি চলছে’।
এ ছাড়া ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রধান খবর হিসেবে প্রকাশ করা হয়। দেশটির রাজধানী দিল্লি থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিকগুলোর শীর্ষ শিরোনাম ছিল বাংলাদেশ নিয়ে। চারটি জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’, ‘দ্য হিন্দু’, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ও ‘হিন্দুস্তান টাইমস’র শীর্ষ শিরোনাম অনেকটা একই রকম।
শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার বিষয়টিকে সব পত্রিকার শীর্ষ শিরোনামে ‘পলায়ন’ বলে লেখা হয়েছিল। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছিল, ‘Sheikh Hasina Flees, Army In Charge’। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের শিরোনাম ছিল, ‘Hasina falls, flees, Army takes Dhaka’।
দ্য হিন্দু শীর্ষ খবরটির শিরোনাম দিয়েছিল, ‘Hasina quits, flees Bangladesh, lands in India as protests surge’। হিন্দুস্তান টাইমসের শিরোনামও অনেকটা একই ধরনের। তারা লিখেছিল, ‘Hasina Flees Bangladesh’।
মূলত গেল বছরের ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের মাধ্যমে আবারও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের দুই শ্রেণিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হয়।
এরই জেরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের কথা বলেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে দাবির সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের একই সময়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা থেকে নিজেদের নাম কাটাতে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। জুন মাসে ধীরগতিতে আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল জুলাইয়ের শুরুতে এসে সেটি গতি পায়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পৃথক আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, একইসঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন
টানা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া ফেলে। ১০ জুলাই হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দেয় আপিল বিভাগ। তবে, পরবর্তী শুনানির সময় ধার্য করে চার সপ্তাহ পর। ১৪ জুলাই চীন সফর উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’
তার ওই বক্তব্যের জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ওই রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে স্লোগান ওঠে– ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’। বিক্ষোভ মোকাবিলায় বলপ্রয়োগের পথে হাঁটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর জানা যায়। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘাতে আহত হয় অনেকে।
১৬ জুলাই প্রথম প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় সারা দেশে ছয়জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদের পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো এবং নিহত হওয়ার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দেশজুড়ে বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে ওঠেন রংপুরের এ শিক্ষার্থী। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। যা ক্ষমতাসীন দলের কোনো সংগঠনের জন্য একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
৫ জুন কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল ঘিরে যে অসন্তোষ দানা বাঁধে ঠিক দুই মাসের মাথায় সেটিই সরকারের ভিত একেবারে নড়বড়ে করে দেয়। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে দেশ ছেড়ে পালানোর গুজব ছড়ানোর পর শেখ হাসিনা সদর্পে বলেছিলেন— ‘শেখ হাসিনা পালায় না’। অথচ, দুই সপ্তাহের মাথায় ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সাক্ষী হয় সরকারপ্রধানের পালিয়ে যাওয়ার মতো নজিরবিহীন এক ঘটনার।
পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে দিল্লিতে চলে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি সচল থাকলেও ভিসা কার্যক্রম মোটামুটি বন্ধ হয়ে পড়ে। উভয় দেশের জনসাধারণ পর্যায়েও সম্পর্কের একটা বড় অবনতি ঘটে।
একদিকে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংখ্যালঘু ও হিন্দুদের ওপর হামলা এবং অত্যাচারের নানা রকম তথ্য, অপতথ্য ও গুজব ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখা যায়। অন্যদিকে অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতা, বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিগুলো থেকে ভারতকে নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য করা হয় তাতেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-বিবৃতিও চলতে থাকে। বিষয়টি আরও জটিল হয় সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার এবং তার জামিন নামঞ্জুরকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতা। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সমর্থকদের হাতে সরকারি আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যার বিষয়টি যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।
চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন অভিমুখে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে শুরু করে। ভারতে আরও কয়েকটি বাংলাদেশি মিশনের কাছেও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের খবর পাওয়া যায়। ২ ডিসেম্বর হঠাৎ আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। অন্যদিকে ভারত দুঃখ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে এ ঘটনায় কয়েকজনকে আটক ও তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এ সময় ভারতীয় গণমাধ্যমে অপতথ্য প্রচার ব্যাপক মাত্রা লাভ করে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তত ১৪৮টি ভুল বা অপতথ্য প্রচারিত হয়। বিশেষ করে জুলাই মাসে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আগস্ট ও ডিসেম্বর মাসে অপতথ্যের এ প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পাওয়া যায়। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে আসে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এর সঙ্গে ভারতীয় মিডিয়াও জড়িত বলে জানান তিনি। বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এবং পতিত স্বৈরাচার, চোরতন্ত্রের জননী ও গুমের জননী চাইছেন বাংলাদেশের ন্যারেটিভকে (বয়ান) চ্যালেঞ্জ করতে। তারা বলছেন তিন হাজার পুলিশ মারা গেছে, তাদের ওয়েবসাইটে অধ্যাপক ইউনূসকে জঙ্গিদের নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটা খুবই পরিকল্পিত অপপ্রচার। এর সঙ্গে ভারতীয় মিডিয়াও জড়িত।’
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন বাস্তবতা ও সমীকরণ
শেখ হাসিনার পতন ও দেশ ছেড়ে ভারতে পলায়নের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা এবং বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বিশেষ করে, উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা এবং কূটনৈতিক যোগাযোগের উন্নতি নিয়েও বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
মূলত শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে। দুই দেশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানও বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। পাকিস্তান সরকার ও ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো আশা করে, বাংলাদেশের সঙ্গে এক বছরের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য বেড়ে তিন বিলিয়ন ডলার হতে পারে, যা বর্তমান সময়ের চেয়ে চারগুণ বেশি।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে সফর ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ দুবার সাক্ষাৎ করেছেন। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল এস এম কামরুল হাসান ইসলামাবাদ সফর করেন এবং সেখানে তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেন।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, দেশটির এয়ার ফোর্সের প্রধানের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানের উন্নত সামরিক সরঞ্জামের পাশাপাশি অত্যাধুনিক জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমানের বিষয়ে বাংলাদেশের উচ্চ-পর্যায়ের ওই প্রতিরক্ষা প্রতিনিধিদল গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে উভয় পক্ষ সামরিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং তাদের বিমান বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়ানোর উপায় নিয়েও আলোচনা করেন বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়।
টিএম/