পেশাদার কূটনীতিকের অপেশাদারিত্ব, উপদেষ্টার ‘তদবির’!

২০২৪-এর অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধরে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। চলমান উদ্যোগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিশনে, মিশন থেকে মিশনে এবং মিশন থেকে ঢাকার সদরদপ্তরে পেশাদার কূটনীতিকদের পদায়ন করা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, মিশন থেকে মিশনে পদায়নের ক্ষেত্রে কয়েকজন পেশাদার কূটনীতিক অপেশাদার আচরণ করছেন। গত বছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ থেকে অফিস আদেশ জারির পরও কয়েকজন তাদের স্টেশন (মিশন) ছেড়ে পরবর্তী স্টেশনে যোগ দেননি। তাদের মধ্যে এক নারী কূটনীতিক রয়েছেন, যার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল এক উপদেষ্টা তদবিরও করেছেন। ওই উপদেষ্টার তদবির সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
স্থানীয় কূটনীতিকরা জানান, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে কয়টি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বেশকিছু মিশনে নতুন রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার নিয়োগ। ইতোমধ্যে অনেক মিশনে রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কিছু মিশনে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মন্ত্রণালয় থেকে বেশকিছু অফিস আদেশ জারি করা হয়। যার মধ্যে এক মিশন থেকে অন্য মিশনে অনেক কূটনীতিককে পদায়ন করা হয়। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ পেশাদার কূটনীতিক তাদের স্টেশন পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ শিগগিরই তাদের মিশন পরিবর্তন করার পথে রয়েছেন। তবে এখনও লন্ডন, অটোয়া ও বার্লিন মিশনের তিন কূটনীতিক তাদের স্টেশন পরিবর্তন করেননি
এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিশনে, মিশন থেকে মিশনে এবং মিশন থেকে ঢাকার সদরদপ্তরে পেশাদার কূটনীতিকদের পদায়ন করা হয়েছে।
জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মন্ত্রণালয় থেকে বেশকিছু অফিস আদেশ জারি করা হয়। যার মধ্যে এক মিশন থেকে অন্য মিশনে অনেক কূটনীতিককে পদায়ন করা হয়। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ পেশাদার কূটনীতিক তাদের স্টেশন পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ শিগগিরই তাদের মিশন পরিবর্তন করার পথে রয়েছেন।
আরও পড়ুন
তবে এখনো লন্ডন, অটোয়া ও পশ্চিমা আরেকটি মিশনের তিন কূটনীতিক তাদের স্টেশন পরিবর্তন করেননি। তাদের মধ্যে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের ৩১তম ব্যাচের এক নারী কূটনীতিক। তিনি ২০২১ সালের শুরু থেকে সেখানে কর্মরত।

লন্ডন-ঢাকার কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর গত বছরের অক্টোবর মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক অফিস আদেশে ওই নারী কূটনীতিককে পরবর্তী স্টেশনে বদলি করা হয়। ঘটনাক্রমে ওই অফিস আদেশ জারির মাসখানেকের মাথায় সরকারের এক প্রভাবশালী উপদেষ্টা এক সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডন সফর করেন। উপদেষ্টার সফরে লন্ডন হাইকমিশন থেকে প্রটোকলের দায়িত্ব পান ওই নারী কূটনীতিক।
লন্ডনে থাকাকালে সরকারের দায়িত্বশীল উপদেষ্টা ওই কূটনীতিককে লন্ডন হাইকমিশনে আরও কিছুদিন রেখে দিতে ফোনে তদবির করেন। সম্মেলন শেষে দেশে ফিরে ফের ফোনে এবং পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সশরীরে হাজির হয়ে ওই নারী কূটনীতিকের জন্য তদবির করেন তিনি।
ঢাকার একটি সূত্র বলছে, উপদেষ্টার তদবিরের ভরসায় ওই নারী কূটনীতিক সদরদপ্তর ঢাকাকে জানান যে, যুক্তরাজ্যের পরবর্তী নির্বাচন অবধি লন্ডন হাইকমিশনে তার থাকাটা জরুরি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর গত বছরের অক্টোবর মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক অফিস আদেশে ওই নারী কূটনীতিককে পরবর্তী স্টেশনে বদলি করা হয়। ঘটনাক্রমে ওই অফিস আদেশ জারির মাসখানেকের মাথায় সরকারের এক প্রভাবশালী উপদেষ্টা এক সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডন সফর করেন। উপদেষ্টার সফরে লন্ডন হাইকমিশন থেকে প্রটোকলের দায়িত্ব পান ওই নারী কূটনীতিক। লন্ডনে থাকাকালে সরকারের দায়িত্বশীল উপদেষ্টা ওই কূটনীতিককে লন্ডন হাইকমিশনে আরও কিছুদিন রেখে দিতে ফোনে তদবির করেন। সম্মেলন শেষে দেশে ফিরে ফের ফোনে এবং পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সশরীরে হাজির হয়ে ওই নারী কূটনীতিকের জন্য তদবির করেন উপদেষ্টা
আরও জানা যায়, বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২২ ব্যাচের এক কূটনীতিক বর্তমানে অটোয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত। অটোয়া মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ওই কূটনীতিকের মিশনও পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু তিনি এখনও আগের স্টেশনে কাজ করে যাচ্ছেন।
পশ্চিমা অন্য একটি দেশেও আরেক পেশাদার কূটনীতিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশের পরও এখনো তার পূর্বের স্টেশন পরিবর্তন করেননি। এ ছাড়া একই মিশনে চার বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করছেন অন্য এক কূটনীতিক। তার খুব শিগগিরই বর্তমান স্টেশন ছাড়ার কথা রয়েছে।
সম্প্রতি ক্যানবেরা ও লন্ডনের বাংলাদেশ মিশন থেকে দুই কূটনীতিক ঢাকায় ফিরেছেন। বর্তমানে তারা সদরদপ্তর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। তাদের ফেরাতে সংশ্লিষ্টদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুই মিশনের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারের বিরুদ্ধে তাদের না ছাড়ার অভিযোগও রয়েছে।

২০২১ সালে পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য একটি পদায়ন নীতিমালা করা হয়। নীতিমালায় বলা হয়, কোনো মিশনে সন্তোষজনকভাবে ৩০ মাস চাকরি করার পর অন্য গ্রুপের কোনো মিশনে পদায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বিবেচিত হবেন। নীতিমালায় আরও বলা হয়, সাধারণভাবে মিশনে এক-একটি পদায়ন অনধিক তিন বছর এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি পদায়ন কমপক্ষে দুই বছর গণ্য করা হবে। বিদেশে অবস্থিত মিশনসমূহে কর্মকাল একাদিক্রমে ছয় বছর বা তার কাছাকাছি সময় অতিক্রান্ত হলে একজন কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে পদায়িত হবেন। মন্ত্রণালয়ে মোট কর্মকাল দুই বছর না হলে কোনো কর্মকর্তা বিদেশে পদায়নের জন্য বিবেচিত হবেন না। লিয়েন, উচ্চশিক্ষা ও বাধ্যতামূলক বা অন্যান্য প্রশিক্ষণের সময় এক্ষেত্রে গণ্য হবে না। তবে, সরকার/মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনে উচ্চ শিক্ষায় প্রেরিত হলে সে সময় পদায়ন হিসেবে গণ্য হবে।
সেখানে আরও বলা আছে, বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব নিরুৎসাহিত করা হবে এবং এ ধরনের তদবির তার ব্যক্তিগত নথিতে সংরক্ষণ করা হবে।
স্থানীয় কূটনীতিকরা বলছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি কোনো কর্মকর্তাকে মুভ (স্থানান্তর) করতে বলে তাহলে তার থাকার কোনো সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয় প্রথমে অফিস আদেশ জারি করে অবিলম্বে পরের কর্মস্থলে যেতে বলে। অবিলম্বে পরের কর্মস্থলে না গেলে বা মুভমেন্টের কোনো লক্ষণ না দেখা গেলে তখন ঢাকা থেকে চিঠি দেওয়া হয়। যদি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কোনো ইস্যু থাকে তিনি চিঠি লিখে কারণ জানান। তখন মন্ত্রণালয় ভেবে দেখবে তাকে সময় দেওয়া যায় কি না? তার আলোকে মন্ত্রণালয় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে। যদি ‘না বলে, ওই কর্মকর্তা প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে মুভ করার জন্য প্রস্তুতি নেবেন। যদি দেখা যায় তিনি সরছেন না, তখন মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দিয়ে অফিসারের মুভমেন্ট পরিকল্পনা জানানোর কথা বলা হবে।
আরও পড়ুন
মুভমেন্ট পরিকল্পনা জানানো বা না জানানোর পরেও যদি তিনি মুভ না করেন, তখন যদি মন্ত্রণালয়ের সন্দেহ হয় যে কর্মকর্তার উদ্দেশ্য ভালো নয়; তখন তাকে আরও কঠোর শিডিউল দেওয়া হয় এবং ফ্লাইট শিডিউল জানতে চাওয়া হয়। ফ্লাইট শিডিউল না জানালে সর্বশেষ ধাপে একটি নির্ধারিত তারিখ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলা হয়, ‘আপনাকে এত তারিখের মধ্যে মিশন ত্যাগ করে নতুন কর্মস্থলে যেতে হবে।’ তারপরও যদি অফিসার নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে না যান তখন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অফিসারকে জানিয়ে দেয় যে, আপনাকে এই তারিখ থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হলো। স্ট্যান্ড রিলিজে যে তারিখ উল্লেখ করা হয় ওইদিন থেকে অটোমেটিক স্ট্যান্ড রিলিজ কার্যকর হয়।

এ বিষয়ে দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এখন রাজনৈতিক সরকার নেই। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাচ্ছে। সরকারের একজন উপদেষ্টা যদি তদবির করেন, সেটা সত্যিই দুঃখজনক। তাহলে রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পার্থক্য কোথায়?’
আরও পড়ুন
নাম প্রকাশ না করে সাবেক এক রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটা নিশ্চিতভাবে অপেশাদারিত্ব এবং খুবই দুঃখজনক ঘটনা। অফিসারকে ডাকা হলে তিনি কেন আসবেন না? সবাই দেখেছে যে তদবির করলে কাজে দেয়, সুতরাং তিনি তদবির করেছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তদবিরকে কেন প্রশ্রয় দেব বা প্রশ্রয় দিচ্ছি? এক কূটনীতিককে অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্যাংকক দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে গেলেন। তাকে তিনবার স্ট্যান্ড রিলিজ করা হলো, তাও তিনি নোট ফেলে দিয়ে মিশনে থেকে গেলেন। হাইকমিশনার কেন এটি অ্যালাও করবেন? লন্ডনে ছয় থেকে সাতজন অফিসার। অথচ সেখানে একজন অফিসারকে হাইকমিশনার ধরে রাখলেন, সেটাও আমাদের জানা। এসব কেন করতে হবে? এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয়টি জড়িত।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘এটি একেবারেই উচিত নয়। যারা নড়াচড়া করতে চান না, তারা পেশাগত দিক থেকেও উপযুক্ত নন। আপনি বিভিন্ন দেশে যদি না যান তাহলে কূটনীতির যে বিচিত্রতা, নানা বাস্তবিক জ্ঞান; সেগুলো তো আপনি জানতে পারবেন না। দক্ষ কূটনীতিক হিসেবে যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, সেটি আপনি অর্জন করতে পারবেন না।’
‘যারা এটি করেন, আমি তাদের সমর্থন করছি না। আমি মনে করি, মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে আরও শক্ত অবস্থান নেওয়া দরকার। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের। এখানে বাইরের হস্তক্ষেপ অযাচিত এবং সেটি হলে পেশাগত দক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
এনআই/