বদলি-পদায়নে ‘আ. লীগের ভূত আতঙ্ক’, কাটাতে গোয়েন্দা নির্ভরতা

গত ৮ জানুয়ারি যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে পদায়ন করা হয় অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানকে। তিনি সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। অভিযোগ আছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় তিনি ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নেন। সেই কর্মকর্তাকে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদে পদায়নের পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
পদায়নের ঠিক ১০ দিনের মাথায় ২০ জানুয়ারি তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। শুধু কামাল নন, গত সাড়ে পাঁচ মাসে অন্তত শতাধিক কর্মকর্তাকে বিভিন্ন দপ্তরে পদায়ন নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরে সেসব আদেশ বাতিল করা হয়।
জুলাই বিপ্লবের পর শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। এটি করতে গিয়ে নানামুখী চাপে পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সাড়ে পাঁচ মাসে অন্তত শতাধিক পদায়ন স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত পদায়ন করা হয়নি বেশকিছু কর্মকর্তাকে
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ও কলেজ শাখার সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শিক্ষা প্রশাসনে পদায়নের ক্ষেত্রে ‘আওয়ামী লীগের ভূত আতঙ্ক’ এখনও মাথা থেকে যায়নি। এজন্য গোয়েন্দা নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। আগে চারটি দপ্তরের প্রধান, ১১টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ২০টি পদে পদায়নে গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেওয়া হতো। এখন সেই সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে।

জানা যায়, বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের আগে বিভিন্ন পর্যায় থেকে খোঁজখবর নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তদবিরও আসে। তদবির করতে যারা আসেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অতীতের তথ্য গোপন করেন। অথচ পদায়ন করার পর জানা যায় তিনি আওয়ামী লীগের অমুক মন্ত্রী বা নেতার আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠজন। এজন্য বিভিন্ন দপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক, গুরুত্বপূর্ণ উপপরিচালক, শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, আঞ্চলিক পরিচালক পদে পদায়নে গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি প্রতিবেদন নেওয়া হচ্ছে। ফলে এক মাস ধরে ফাঁকা ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ।
শিক্ষা প্রশাসনে পদায়নের ক্ষেত্রে ‘আওয়ামী লীগের ভূত আতঙ্ক’ এখনও মাথা থেকে যায়নি। এজন্য গোয়েন্দা নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। আগে চারটি দপ্তরের প্রধান, ১১টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ২০টি পদে পদায়নে গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেওয়া হতো। এখন সেই সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সৎ ও যোগ্য লোক খুঁজতে গিয়ে পদায়নে দীর্ঘ সময় লাগছে। কিন্তু লোক তো খুঁজে পাওয়া যায় না। সবকিছু ঠিক হওয়ার পর জানা যায় তিনি সাবেক সরকারের অমুক মন্ত্রী বা নেতার ঘনিষ্ঠ। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে পদায়ন করতে হচ্ছে।’
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়মিত প্রক্রিয়া। পদায়নের পর বিতর্ক এড়াতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরিধি একটু বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া দেশজুড়ে আমার ছাত্র, বন্ধুবান্ধবসহ সুহৃদ ব্যক্তিদের কাজে লাগানো হচ্ছে।’
আরও পড়ুন
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (কলেজ) মো. নুরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, “পদায়ন প্রক্রিয়ায় ‘আওয়ামী লীগের ভূত আতঙ্ক’, বিষয়টি এমন নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পদায়নের পর জানতে পেরেছি যে, উনি তথ্য গোপন করেছেন বা তার ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে। তখন তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এগুলো প্রথম দিকে হয়েছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।”
‘পদায়ন হওয়ার পর কাউকে যেন প্রত্যাহার করতে না হয় সেজন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পদায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটাকে খারাপভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই কিন্তু অরাজনৈতিক। তারপরও কেউ কেউ অমুক মন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলের প্রতি বিশেষ সখ্যতা বা দুর্বলতা দেখিয়েছিলেন। তাদের বিষয়ে আমরা সতর্ক।’

আরও পড়ুন
সতর্কতার পরও হচ্ছে ভুল পদায়ন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে (ডিআইএ) প্রথম পদায়ন পান অধ্যাপক কাজী কাইয়ুম। পদায়নের পর থেকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। নিজ দপ্তরে আওয়ামী লীগ আমলের কর্মকর্তাদের রক্ষা ও আশ্রয়, অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে তিন মাস পর তাকে বদলি করা হয়। একই অভিযোগে ডিআইএ দপ্তর থেকে সোমবার সরিয়ে দেওয়া হয় যুগ্ম পরিচালক আবুয়াল কায়সারকে। তার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ ওঠে।
১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হিসেবে পদায়ন পান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাগনি জামাই ড. ছরওয়ার আলম। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময় তিনি মাদ্রাসা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার পরিচালক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার পরিবারের লোক এবং গোপালগঞ্জে বাড়ি পরিচয় দিয়ে সব জায়গায় প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। কথায় কথায় তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করতেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
জানা যায়, গত ১৬ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর মাউশিতে কিছু আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তার পদায়ন হয়। তারা বিগত সরকারের ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করে শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তরে গিয়ে টেবিল চাপড়িয়ে পদায়ন নেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক প্রিম রিজভী ও সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মুহাম্মদ সফিউল বশর। প্রিম রিজভী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যানবেইসের উপপরিচালকসহ বিভিন্ন প্রকল্পের চাকরি করেছেন। একদিনের জন্য তিনি ঢাকার বাইরে যাননি। একইভাবে রাজনৈতিক কোনো পরিচয় না থাকার পরও পদ বাগিয়ে নেন সফিউল বশর। মাউশিতে আসার পর সেবা নিতে আসা কলেজ শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
গত ১৬ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর মাউশিতে কিছু আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তার পদায়ন হয়। তারা বিগত সরকারের ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করে শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তরে গিয়ে টেবিল চাপড়িয়ে পদায়ন নেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক প্রিম রিজভী ও সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মুহাম্মদ সফিউল বশর

এনসিটিবির সাবেক সচিব ও সর্বশেষ কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. নিজামুল করিমের পদায়ন, বদলি ও প্রত্যাহার নিয়ে বেশ নাটক করা হয়। গত ১৫ দিনে একবার তাকে নিজ পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে সেই আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সর্বশেষ তিনদিন আগে তাকে আবারও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
এ ছাড়া গত ১২ জানুয়ারি ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পান সরকারি তিতুমীর কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক নাছিমা আক্তার চৌধুরী। অবসরে যাওয়ার তিনদিন আগে তাকে ওই পদে পদায়ন করা হয়। অভিযোগ ওঠে, একজন সমন্বয়কের চাপে তাকে ওই পদে পদায়ন করা হয়। যদিও পরে তিনি অবসরে চলে যান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই বিপ্লবের পর শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। এটি করতে গিয়ে নানামুখী চাপে পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সাড়ে পাঁচ মাসে অন্তত শতাধিক পদায়ন স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত পদায়ন করা হয়নি বেশকিছু কর্মকর্তাকে।
এনএম/এমএআর/এমজে