গণতন্ত্রের পূর্ণতা আনতে প্রয়োজন নির্বাচন

ববি হাজ্জাজ; একাধারে লেখক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও অহিংস রাজনীতি চর্চা করার জন্য হাজ্জাজ বরাবরই জনপ্রিয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক এ শিক্ষার্থী দেশের শীর্ষ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন— এনডিএম’ এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যবস্থাপনা, জাতীয় নির্বাচন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হন। উন্মোচন করেন জাতীয় রাজনীতির ভেতর-বাহিরের নানা অধ্যায়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।
ঢাকা পোস্ট : দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও চর্চা নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলোচনা হচ্ছে। এ মুহূর্তে সরকারের কী কী উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ববি হাজ্জাজ : ক্ষমতা গ্রহণের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেকগুলো ভালো কাজ করেছে। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। আমাদেরকে নানাভাবে আস্থার জায়গায় নিয়ে গেছে। যেকোনো সরকারের যেমন কিছু ভালো গুণ থাকে, তেমন কিছু ভুল-ত্রুটিও থাকে। বর্তমান সরকারেরও ছোটখাটো কিছু ভুলত্রুটি আছে। সরকারের এসব ভুলত্রুটি নিয়ে আমরা তাদের জানানোর চেষ্টা করছি।
অন্যদিকে, তাদের ভালো সিদ্ধান্তগুলোকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। আমার মনে হয়, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। যদিও ৫ তারিখের (আগস্ট) পরই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। এখন এটির পূর্ণতা পেতে প্রয়োজন নির্বাচন। নির্বাচন দিতে হলে এর আগে কী কী কাজ করা প্রয়োজন, কী কী কাজ এখনও বাকি, সেগুলো কীভাবে সম্পন্ন করার কথা তারা চিন্তা করছে; বিষয়গুলো নিয়ে সব রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের জানানো সমুচিত বলে মনে করি।
এখানে সবারই একটা প্রস্তুতির বিষয় আছে। যারা ব্যবসা পরিচালনা করেন তাদের, গণমাধ্যমেরও একটা প্রস্তুতি আছে। রাজনৈতিক দলগুলো তো সরাসরি নির্বাচনে যাবে, তাদেরও প্রস্তুতির বিষয় আছে। সুতরাং এটি পরিষ্কার করে জানানো উচিত বলে মনে করি। এ কারণে আমরা প্রথম থেকে একটি কথাই বলে আসছি, সেটি হলো নির্বাচনী রোডম্যাপ। নির্বাচন দিতে যতটুকু সময় দেওয়ার কথা, এর বেশি সময় আপনারা নেন— সেটি কিন্তু আমরা চাই না।
আপনারা রোডম্যাপ দিলে তখন আমরা জানতে পারব কতটুকু সময়ের প্রয়োজন। তারপর আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করব। তবে, এ বিষয়ে একটু দুঃখ প্রকাশ করেই বলতে চাই, সরকারের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও কাজটি এখনও করা হয়নি। সবার আগে এটি করার প্রয়োজন ছিল।
ঢাকা পোস্ট : ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ মাসের বেশি সময় পার করেছে। সরকারের ব্যর্থতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করেছেন কি না? করলে সেগুলো কী?
ববি হাজ্জাজ : প্রতিটি সরকারেরই ব্যর্থতার কিছু জায়গা থাকে। এ সরকারের অনেকগুলো সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতার জায়গাও আছে। মোটাদাগে এ সরকারের একটি ব্যর্থতার কথা আমি বলব। এটির সঙ্গে অন্যান্য ব্যর্থতার বিষয়টিও সম্পৃক্ত। বর্তমান সরকার তাদের দায়িত্বের বিষয়টি পরিষ্কার করেনি। তারা যদি পরিষ্কার করতো এবং বলতো আমরা নির্বাচন দিতে এসেছি; তাহলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতাসহ আরও কিছু বিষয়ে তাদের সফলতা বা ব্যর্থতার দায় নিতে হতো না। এখন পর্যন্ত তারা তাদের লক্ষ্য পরিষ্কার করেনি।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এ সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল সংস্কারের জন্য পৃথক কমিশনের প্রয়োজন ছিল কি না?
ববি হাজ্জাজ : প্রথমত, অনেক বিষয় আছে যেগুলো সংস্কারের জন্য আসলে কোনো কমিশন গঠনের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সেগুলোর জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, রাজনৈতিক দল সংস্কারে কমিশন প্রয়োজন। কিন্তু আমি এটার প্রয়োজন দেখি না। রাজনৈতিক দল একটি প্রতিযোগিতামূলক খাত। আমরা যদি ব্যবসায়ীদের কথা বলি তাহলে দেখতে পাব, এখানে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। সুতরাং এ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে মুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কমিশন প্রয়োজন হতে পারে। আপনি যদি নির্বাচন দেন তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। যে রাজনৈতিক দল জনগণের জন্য কাজ করবে না, সে রাজনৈতিক দলকে জনগণ ভোট দেবে না।
এখন নির্বাচন দিলে দেখবেন আওয়ামী লীগের কোনো ভোট নেই। ১৫ থেকে ২০ বছর আগে দলটির নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট ব্যাংক ছিল। এখন সেটি পাবে না। কারণ, বিগত বছরগুলোতে দলটি যেভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না, জনগণের কল্যাণে কোনো কাজ করা হয়নি। সুতরাং জনগণ এখন তাদেরকে ভোট দেবে না। এখন আপনি যদি সঠিকভাবে আপনার দলকে পরিচালনা না করেন, তাহলে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেবে। দলটি এমনিতেই বাতিল হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার করতে হলে প্রয়োজন প্রবীণ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক। কিন্তু হাসপাতাল সংস্কার কমিশনে যদি দুজন পুলিশ সদস্য দেন তাহলে তো সেখানে সংস্কারের কিছু হবে না। তেমনি যারা কখনও রাজনীতি করেননি, তাদের দিয়ে যদি রাজনৈতিক দল সংস্কারের চেষ্টা করেন, সেটি হবে বড় ভুল। ওয়ার্ড, উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি এক রকম নয়। সুতরাং এসব জটিলতা কোনো সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে সুরাহা করা যাবে না। জেনুইন ডেমোক্রেটিক কম্পিটিশনের (প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা) মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব।
ঢাকা পোস্ট : বিভিন্ন মহল থেকে ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। আপনার দৃষ্টিতে দলটিকে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন আছে কি না?
ববি হাজ্জাজ : আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য আমরা মামলা করেছি। একমাত্র আমার দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন- এনডিএম এই উদ্যোগ নিয়েছে। মামলাটি করার মাধ্যমে আমরা পরিষ্কার করে দিয়েছি যে, আমরা তাদের নিষিদ্ধ দেখতে চাই। বাংলাদেশে সঠিকভাবে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে আইনের শাসনের বাইরে গিয়ে আর কোনো ধরনের কর্মসূচি আমরা করতে পারি না। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যেসব কর্মকাণ্ড করেছে, সেটার জন্য আইনগতভাবে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা যায়। তারা বড় ধরনের যেসব অপরাধ করেছে, যেমন- গণহত্যা, ভোটচুরি এবং অর্থনৈতিক লুটপাট; এগুলোর সঙ্গে কিন্তু তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়িত। তাদের সবাই দণ্ডনীয় অপরাধী। এই দণ্ড যদি কার্যকর হয় তাহলে তারা কোনোভাবেই কোনো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় থাকতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো একটি দলের যদি ১৫ থেকে ২০ হাজার নেতাকর্মী নির্বাচনে যেতে না পারে তাহলে সেই দল কী নির্বাচন করবে? সুতরাং আওয়ামী লীগ এমনি এমনি বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সেটি যেন সঠিক আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : আপনার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটগুলো কী এবং তা নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন ধরনের ভূমিকা থাকা উচিত?
ববি হাজ্জাজ : রাজনৈতিক সংকট সবসময় সর্বত্র বিরাজ করে। দেশে জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেটি একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। আওয়ামী লীগের এখনও যারা বিচারের আওতায় আসেনি এবং খোলামেলাভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে; আগামীতে তাদের যাতে বিচারের আওতায় আসতে না হয় সেজন্য তারা ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে, বিদেশি যেসব শক্তি আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে এবং করবে; তারা আমাদের দেশকে নিয়ে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছে বা করবে। এগুলো আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সরকার। যেটি নির্বাচনের মাধ্যমে আনা যেতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : বর্তমান তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে, যেটি আগে কখনও দেখা যায়নি। তাদের আগ্রহ বাড়াতে কোন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
ববি হাজ্জাজ : আমরা তরুণদের নিয়ে অনবরত কাজ করছি। তাদের দাওয়াত দিচ্ছি। তাদের কাছ থেকে বেশ সাড়াও পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, ভালো কিছু হবে। গত ১৫ বছর দেশের তরুণ সমাজ যেমন রাজনীতিবিমুখ ছিল, আশা করি সেটি আগামীতে আর থাকবে না। আগামীতে তরুণদের মধ্য থেকে অনেক মেধাবী ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ আমরা পাব।
ঢাকা পোস্ট : এত বড় বিপ্লবের পর কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
ববি হাজ্জাজ : আমরা সুন্দর একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমাদের এখন যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বেশি); আমাদের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ তরুণ। ভূরাজনৈতিক দিক বিবেচনায় আমরা একটি গোল্ডেন জায়গায় আছি। এটির সঠিক ব্যবহার যদি রাজনৈতিকভাবে আমরা করতে পারি তাহলে আমার বিশ্বাস, আগামী এক থেকে দুই দশকের মধ্যে আমরা দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানে যেভাবে ‘ইকোনমিক মিরাকল’ হয়েছে, সেটি বাংলাদেশেও বাস্তবিকভাবে দেখতে পাব।
ঢাকা পোস্ট : ১৮ কোটি মানুষ যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজপথে নেমেছিল, বর্তমানে সেটির বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে করেন কি না?
ববি হাজ্জাজ : মানুষ যে আশা নিয়ে মাঠে নেমেছিল সেগুলোর অনেক কিছু পূরণ হচ্ছে। এখন মানুষের বাকস্বাধীনতা আছে। এই যে আজ আপনারা যেকোনো স্টোরি ছাপাতে পারছেন। অবশ্য দেশে এখন আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্যের অবস্থা ভালো না। একটা বড় পরিবর্তন বা বিপ্লবের পর এমন অনেক বিষয় থাকে। তবে, পরিস্থিতিগুলো আরও ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করা যেত। মোটাদাগে বলতে গেলে, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষের প্রাপ্তি অনেক।
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ববি হাজ্জাজ : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা।
এমএম