এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে পাওনা ৫০০০ কোটি, ব্যবস্থা নিচ্ছে বেবিচক
ছাড় দিতে দিতে পাওনার পরিমাণ হয়েছে পাহাড়সম। এক কোটি, দুই কোটি, ৫ কোটি থেকে বাড়তে বাড়তে বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পাওনা হয়ে গেছে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি টাকা। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ফ্লাইট বন্ধ। এয়ারলাইন্সগুলোর আয়ও কমেছে। অনেকে এ কারণে বেবিচকের চার্জগুলো ঠিকমতো দিতে পারছে না। এতে বেবিচকের পাওনার পরিমাণ দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে পরিচালন ব্যয় আর কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হতে পারে বেবিচককে— বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই পাওনা আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছে বেবিচক।
বেবিচক সূত্রে আরও জানা গেছে, অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, ভ্যাট, আয়কর ও সারচার্জ মিলে বাংলাদেশে পরিচালিত এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে প্রায় পাঁচ হাজার ১৯০ কোটি (মার্চ ২০২১ পর্যন্ত) টাকা পাওনা বেবিচকের। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে পাওনার পরিমাণ ১৭২ কোটি টাকা (মে ২০২১ পর্যন্ত)।
অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, ভ্যাট, আয়কর ও সারচার্জ মিলে বাংলাদেশে পরিচালিত এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে প্রায় পাঁচ হাজার ১৯০ কোটি (মার্চ ২০২১ পর্যন্ত) টাকা পাওনা বেবিচকের। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে পাওনার পরিমাণ ১৭২ কোটি টাকা
বেবিচকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত তারা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে ৪৩১৫ কোটি টাকা, বন্ধ হয়ে যাওয়া জিএমজি এয়ারলাইন্সের কাছে ৩৬৮ কোটি টাকা, ফ্লাইট চলাচল স্থগিত রাখা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে ২৬৩ কোটি টাকা এবং ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে ২০৩ কোটি টাকা পাওনা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনাকারী বেসরকারি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের কাছে ১৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং নভোএয়ারের কাছে পাওনা আছে তিন কোটি ২৭ লাখ টাকা।
এসব পাওনা আদায়ে বেবিচকের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও করোনাকালীন সংকটের কথা বলছে এয়ারলাইন্সগুলো।
১৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা বকেয়ার বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যাত্রা শুরুর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বেবিচকের সবধরনের বিল পরিশোধ করে আসছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের প্রায় সব বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অবশিষ্ট বকেয়া সময়মতো পরিশোধ করা হবে।
বকেয়া পরিশোধের উপায় খুঁজছে বিমান
সবচেয়ে বেশি ৪৩১৫ কোটি টাকার দেনা নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বর্তমানে করোনার মধ্যেও তারা দেশের অভ্যন্তরীণ সব রুটে এবং আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ও যুক্তরাজ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
২০০৮ সালেও প্রায় ১৮০০ কোটি টাকার পাহাড়সম দেনায় পড়েছিল বিমান। ওই সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ১২১৬ কোটি টাকার সারচার্জ মওকুফ করিয়ে ৫৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে দায়মুক্তি পায় সংস্থাটি।
৪৩১৫ কোটি টাকার দেনার বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু সালেহ মোস্তফা কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বেবিচকের চেয়ারম্যান (এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান) বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনাপর্ষদের সদস্য। উনি বিমানের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানেন। আমরা আশা করব বেবিচকের পক্ষ থেকে তিনি চার্জ কমাবেন। এছাড়া বিমানের পক্ষ থেকেও কীভাবে বকেয়া পরিশোধ করা যায় আমরা সেই পরিকল্পনা করছি।’
উধাও জিএমজি-ইউনাইটেড, দেনা বাড়ছেই
২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে জিএমজি এয়ারলাইন্স। ২০১২ সালে ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ফ্লাইট বন্ধের কারণ হিসেবে তারা ‘জেট ফুয়েলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নেওয়ার উদ্যোগ’-এর কথা জানায়। তবে তারা ২০১৩ সালের মধ্যে ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তারা আর ফিরতে পারেনি। ফ্লাইট বন্ধের সময় জিএমজির কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সময়মতো পরিশোধ না করায় তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। এছাড়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জিএমজির একটি উড়োজাহাজ এখনো পড়ে আছে। সেটির চার্জসহ বর্তমানে দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৬৮ কোটি টাকায়।
তবে বারবার চিঠি দেওয়ার পরও জিএমজি এবং তার শেয়ার কিনে নেওয়া বেক্সিমকো গ্রুপের কেউই বকেয়া অর্থ পরিশোধে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
২০০৭ সালে ফ্লাইট অপারেশন শুরু করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দেয় তারা। বন্ধ হওয়ার সময় ইউনাইটেড বলেছিল, ‘বহরে থাকা ১০টি উড়োজাহাজের সবকটির রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। এছাড়া তাদের ওই সময় এত টাকাও ছিল না।’ দুই সপ্তাহ পর ফিরে আসার আশা ব্যক্ত করলেও পাঁচ বছরেও ফিরতে পারেনি সংস্থাটি।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরের জায়গা দখল করে আছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আটটি উড়োজাহাজ। সবমিলে তাদের কাছে বেবিচকের পাওনা ২০৩ কোটি টাকা। কয়েক বছর ধরে পাওনা আদায়ে চিঠি দিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ আদায় করতে পারেনি বেবিচক।
এদিকে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙে সম্প্রতি নতুন সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসি। এই সাতজনের মধ্যে এভিয়েশন ও ভ্রমণ বিষয়ক সাময়িকী ‘বাংলাদেশ মনিটর’ সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে পরিচালনাপর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
বেবিচকের পাওনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নবগঠিত পরিচালনাপর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শুধু বেবিচক নয়, আমাদের (ইউনাইটেড) আরও অনেক দায়দেনা আছে। সবমিলে আমরা একটা ওয়ার্কিং প্ল্যান তৈরি করছি। আমরা কীভাবে দায়দেনাগুলো পরিশোধ করব, সেটা ঠিক করছি। তবে বকেয়া নিয়ে আমরা বেবিচকের সহযোগিতা চাই। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করব।
সমঝোতায় অপারেশনে ফিরতে চায় রিজেন্ট
২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় সবধরনের ফ্লাইট স্থগিত করা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে ২৮৩ কোটি টাকা পায় বেবিচক। টাকা পরিশোধের উদ্যোগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আশিস রায় চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেনার বিষয়ে আমরা বেবিচকের সঙ্গে একটা সমঝোতায় যাব। বেবিচক আমাদের বলেছে, অপারেশনে ফিরতে হলে মোটা অঙ্কের একটা বিল দিতে হবে। সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা একটা সাবস্টেনশিয়াল (সঙ্গতিসম্পন্ন) অঙ্কের বিল পরিশোধের লক্ষ্যে কাজ করছি।’
১৭২ কোটি টাকা আটকে রেখেছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো
এদিকে, করোনার দোহাই দিয়ে ১৭২ কোটি টাকার বিল আটকে দিয়েছে বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করা ২৪টি বিদেশি এয়ারলাইন্স। বিল আদায়ে তাদেরও তাগাদা দিচ্ছে বেবিচক। তবে ভবিষ্যতে যেন কোনো বিদেশি এয়ারলাইন্স এভাবে টাকা বকেয়া রাখতে না পারে সেজন্য ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার আগে তাদের কাছ থেকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার জামানত রাখার চিন্তাভাবনা চলছে। বকেয়া না দিলে এই জামানত থেকে টাকা কেটে রাখার পরিকল্পনা করছে বেবিচক।
বর্তমানে বেবিচকের কাছে ইরান এয়ার, ইরাকি এয়ারওয়েজ, গারুদা ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়ান এয়ার ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স নতুন করে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়েছে।
টাকা উদ্ধারে কী করবে বেবিচক
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছর বেবিচকের ব্যয় হয় ১৪০০-১৫০০ কোটি টাকা। আমাদের আগে বছরে ১৬০০ থেকে ১৭০০ কোটি টাকা আয় হতো। অতিরিক্ত আয়ের অর্থ বেবিচকের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমে লাগানো হতো। তবে ২০২০ সালে রাজস্ব কমে হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
বকেয়ার টাকা আদায়ের বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘পাওনাগুলো আদায়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
টাকা আদায়ে এয়ারলাইন্সগুলোকে সারচার্জ ছাড় দেওয়া হবে কি না— জানতে চাইলে এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘কাউকে ছাড় দেওয়া বা চার্জ মওকুফের কোনো পরিকল্পনা নেই। বেবিচক যেহেতু স্বাধীনভাবে চলে, তাই ইচ্ছা করলেই আমরা তাদের সারচার্জ মওকুফ করতে পারি না। এটি করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে। আর স্বপ্রণোদিত হয়ে কাউকে ছাড় দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। এটা করলে সরকারের ক্ষতি হবে, আয়ও কমবে।’
তিনি আরও বলেন, টাকাগুলো রিকভারি (পুনরুদ্ধার) হলে বেবিচকের উন্নয়ন কাজগুলো আরও ত্বরান্বিত হবে। এ মুহূর্তে সরকারের কাছ থেকে এসব কাজে অনুদান পাওয়া একটু কঠিন। আয় বেশি হলে কাজগুলো আমরা আরও দ্রুত শেষ করতে পারব।
এআর/এমএআর/