‘২০২৪’ আর ফিরে আসুক, চায় না আওয়ামী লীগ
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। শপথ নেন সংসদ সদস্যরা। গঠন করা হয় মন্ত্রিপরিষদ। হাতে নেওয়া হয় আগামীর পাঁচ বছরের পরিকল্পনা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পায়নি টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ। মাত্র সাত মাসের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হয় দলটি। গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে যান দলের নেতাকর্মীরা। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন। আর বিত্তবান নেতারা পাড়ি জমান বিদেশে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ‘নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। একই দাবি উঠেছে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ টানা ১৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি আজ দেউলিয়ার পথে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের শুরুতে টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে দলটি। একই বছরে আওয়ামী লীগের এমন করুণ প্রস্থান— কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ঠিক যেন কল্পনার মতো।
বিষয়টি স্বীকার করে নেন ভারতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা। নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হলেও দিনশেষে আমরা কিন্তু পরাজিত একটি শক্তি। আমরা এখন দেশছাড়া। স্বাভাবিক জীবনে নেই আমরা। ২০২৪ সাল আমাদের জন্য অন্ধকার ডেকে এনেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু পারেনি। ২০২৪ সালেও একই কায়দায় আমাদের ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু এবারও তারা সফল হবে না। আমরা চাই না ২০২৪ যেন আর ফিরে আসুক।’
শুরুতে বিজয়ের আনন্দ, আছে বিতর্কও
নির্বাচনী আমেজে শুরু হয় ২০২৪ সাল। সাত দিনের মাথায় (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নেন। আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে বিজয়ী হয়। জাতীয় পার্টি (জাপা) পায় ১১টি আসনে; বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি করে আসনে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে, ৬৩টি আসন দখল করেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
এ নির্বাচনকে ‘একতরফা’ ও ‘ডামি নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যান নেতাকর্মীরা। সরকারকে ‘অবৈধ’ দাবি করে দ্রুত পদত্যাগ এবং অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানায় তারা।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী দলকে অভিবাদন জানায় বিভিন্ন দেশ। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। ফল ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যে কোনো পশ্চিমা দেশ শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়নি। উল্টো ৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। সেখানে আরও বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য করেছে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন নিয়ে জয়ী হয়েছে। তবে, হাজারও বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।’
আরও পড়ুন
দুই সিটির নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন, আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে সমালোচিত
জাতীয় নির্বাচনের পরই কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের উপনির্বাচনে মেয়র পদে আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার নিজ মেয়েকে জোরপূর্বক পাস করান। সেখানে অন্য প্রার্থীদের কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ ওঠে। একই কায়দায় অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। তবে, ওই দুই নির্বাচনের চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে বেশি সমালোচিত হয় আওয়ামী লীগ।
গত ৬ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের দুই দিনব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল, হাতাহাতি, মারামারি ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত তা মামলায় গড়ায়। শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত পাঁচ আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলায় স্বতন্ত্র সম্পাদক প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথী ও বিএনপির সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুসসহ ২০ আইনজীবীকে আসামি করা হয়। এভাবে বিরোধী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাদের গ্রেপ্তারের ঘটনা নতুন করে সমালোচনার মুখে ফেলে আওয়ামী লীগকে।
আরও পড়ুন
ছাগলকাণ্ড, আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে জন-অসন্তোষ
পরবর্তীতে ‘ছাগলকাণ্ড’ নতুন করে বিতর্কে ফেলে ক্ষমতাসীন দলটিকে। ঈদুল আজহার সময় দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান। ঘটনার সূত্রপাত তার ছেলেকে নিয়ে। মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ কোরবানি ঈদের আগে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। সেখানে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি উচ্চবংশীয় ছাগল কিনতে দেখা যায় তাকে। এত টাকা দামের ছাগল এবং কে এই ক্রেতা— এটি খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে তৎকালীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য মতিউর রহমানের নাম। যদিও প্রথম দিকে তিনি তার ছেলেকে অস্বীকার করেন। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে তিনি ও তার পরিবারের দুর্নীতির নানা খবর। মতিউরসহ তার দুই স্ত্রী ও দুই সন্তানের সম্পদের বিবরণ জমা দিতে নোটিশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ ছাড়া চলতি বছরের মার্চের দিকে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে একের পর এক আওয়ামী লীগপন্থি আমলাদের দুর্নীতি ও টাকা পাচারের তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার হতে থাকে। তাদের মধ্যে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী (পিয়ন) জাহাঙ্গীর আলমের নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের দুর্নীতির খবরগুলো প্রকাশ্যে আসায় জনমনে আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভব তৈরি হয়। একই সঙ্গে দলটির সাধারণ নেতাকর্মীদের মনেও প্রশ্ন উঠতে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ধারাবাহিকভাবে এমন দুর্নীতির খবর জনমনে অসন্তোষ তৈরি করতে থাকে। একপর্যায়ে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনেরও নানা ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে। কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সর্বশেষ এক দফা ‘সরকার পতন আন্দোলন’।
কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
২০২৪ সালের ৫ জুন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কর্পোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ফের রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। ২৬ জুলাই এটি ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে সংগঠিত হন এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনর্বহালের দাবিতে টিএসসি এলাকায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন। আস্তে আস্তে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৫ জুন হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরের দিন ৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দেন।
১৪ জুলাই সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন আন্দোলনকারীরা। ওই দিন সন্ধ্যায় চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসে শেখ হাসিনা একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন। তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে অভিহিত করেন। ওই মন্তব্যের পর রাতেই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা স্লোগান দেন, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা নির্বিচারে হামলা চালায়। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে আহত বিক্ষোভকারীদের ওপরও হামলা চালায়। ওই দিন উভয়পক্ষের তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়। ১৬ জুলাই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহত হন। সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের হল খালি করতে বলা হয়। সরকার ছয়টি জেলায় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মোতায়েন করে। ওই দিন রাতেই শিক্ষার্থীরা ঢাবি ও রাবির অধিকাংশ হলের দখল নেন। তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হলছাড়া করেন।
আবু সাঈদকে হত্যা ও নয় দফা ঘোষণা
১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮ জুলাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ১৯ জেলায় সংঘটিত সংঘর্ষ ও সহিংসতায় কমপক্ষে ২৯ জন নিহত হন। অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করা হয়।
১৯ জুলাই দিনব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন কয়েক শ মানুষ। এ দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নয় দফা দাবি ঘোষণা করেন। যার মধ্যে ছিল ‘শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে’, ‘কয়েকজন মন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পদত্যাগ করতে হবে’, ‘হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ ও পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দিতে হবে’, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষা দিতে হবে’। এ দিন মধ্যরাত থেকে সরকার দেশব্যাপী কারফিউ ঘোষণা করে এবং সেনা মোতায়েন করে।
কারফিউ জারি, জাতীয় ঐক্য ও সরকার পতনের আহ্বান বিএনপির
২০ জুলাই থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়। এ দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে অন্তত ২১ জন নিহত হন। ২৩ জুলাই সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় ৯৩ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে করার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কেরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ দিন জাতীয় ঐক্য ও সরকার পতনের আহ্বান জানায় বিএনপি।
২৮ জুলাই, দেশব্যাপী পুলিশের অভিযান চলমান থাকে। শুধু ঢাকাতেই ২০০টিরও বেশি মামলায় দুই লাখ ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়। মোবাইল ইন্টারনেট সচল হলেও বন্ধ রাখা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ৩০ জুলাই কোটা আন্দোলন ঘিরে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দেশব্যাপী শোক পালনের আহ্বান জানায় সরকার। এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় দিয়ে মুখ ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং তা অনলাইনে প্রচারের কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা।
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি
১ আগস্ট, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ দিন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তাদের নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই সময় বলেছিলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সরকারের পদত্যাগের এক দফা, ঢাকায় লং-মার্চের ঘোষণা
৩ আগস্ট, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায় কর্মসূচি ঘোষণা করে। ৪ আগস্ট সারা দেশে আওয়ামী লীগের সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সহিংস সংঘর্ষ হয়। দেশব্যাপী অন্তত ৯৩ জন নিহত হন। এদিন মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে ‘শক্ত হাতে নাশকতাকারীদের প্রতিহত করার’ আহ্বান জানান। অন্যদিকে, এ দিন ঢাকার উদ্দেশে লং-মার্চ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা
শুরুতে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আহ্বান জানানো হলেও পরে তা এক দিন এগিয়ে আনা হয়। ৫ আগস্ট হাজার হাজার ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে ঢাকার একাধিক মোড়ে জড়ো হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করা শুরু করেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাক-আউট রাখা হয়। দুপুর ২টায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেন। অন্যদিকে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারযোগে দেশ ছাড়েন। পরে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন। শেখ হাসিনার পতন উদযাপন করতে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভাঙচুর চালানো হয়।
আরও পড়ুন
ড. ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন
৮ আগস্ট দুপুরে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। ওই সময় সাংবাদিকদের ড. ইউনূস বলেন, ‘আমার প্রথম কাজ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।’ রাতে বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ ১৪ জন উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
মাঠ থেকে হাওয়া, সামাজিক মাধ্যমে সরব থাকার চেষ্টা
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগকে আর মাঠে দেখা যায়নি। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুটা সরব উপস্থিতি দেখা গেলেও মাঠের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি ১৫ আগস্ট কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও জাতীয় কোনো নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। অথচ প্রতি বছর পুরো জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় দিনটি ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালন করত। এ দিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের পুড়িয়ে দেওয়া বাড়ির সামনে আওয়ামী লীগের প্রবীণ কিছু সমর্থক ও কর্মী আসলেও শিক্ষার্থীদের হাতে নাজেহাল হন তারা। তবে, টুঙ্গিপাড়াসহ কয়েকটি স্থানে সীমিত পরিসরে দলীয় নেতাকর্মীরা দিবসটি পালন করেন।
পরবর্তীতে ১৭ অক্টোবর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসসহ আটটি জাতীয় দিবস উদ্যাপন বা পালন না করার সিদ্ধান্ত জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। ওই দিন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। দিবসগুলো হলো- ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস এবং ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ, কার্যালয় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে এ ছাত্রসংগঠনকে ‘নিষিদ্ধ সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন থেকে দাবি উঠেছে। কেউ কেউ এটি বাস্তবায়নে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করেছেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের কার্যালয়গুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। ধানমন্ডি ৩/এ দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় এবং গুলিস্তানের দলের প্রধান কার্যালয়েও আগুন দেওয়া হয়। সেখানকার সব জিনিসপত্র লুট করা হয়। শুধু কেন্দ্র নয়, জেলা ও উপজেলায় অবস্থিত আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
মামলা-গ্রেপ্তারে নাজেহাল আওয়ামী লীগ
এদিকে, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাবেক সরকারের মন্ত্রী, আমলা, পুলিশসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। এখনও তাদের জনসম্মুখে দেখা যাচ্ছে না। শীর্ষ নেতারা দেশে আছেন, না কি বিদেশে পালিয়েছেন— তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। গ্রেপ্তার করা হয়েছে দলের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ও কর্নেল ফারুক খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক মন্ত্রী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আহমদ হোসেন, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সোবহান গোলাপ।
এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় ও হাজি মো. সেলিম গ্রেপ্তার হয়েছেন।
আরও পড়ুন
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক সংসদ সদস্য শাহে আলম, সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ছাড়া শেখ হাসিনার আমলের সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান, সাবেক জননিরাপত্তা সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ পুলিশের সাবেক ১৭ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
এদিকে, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রীদের মধ্যে ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মাহবুব-উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দেশের বাহিরে অবস্থান করার খবর পাওয়া গেছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ, মামলা অসংখ্য
৩০ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ (অভিযোগপত্র) দিয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা। গুম করার ঘটনায় তিনি এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সারা দেশে ২৫৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলার সংখ্যা ২১৫।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানাসহ ছয়জনের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচারের অভিযোগও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। পাশাপাশি শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট–বিএফআইইউ।
বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
এমএসআই/এমএআর/এমজে