পাহাড়সম দেনা রেখে কাগজে-কলমে লাভ দেখাল বিমান!
দেশে জেট ফুয়েল সরবরাহকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল। এটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
পদ্মা অয়েলের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিমানের কাছে ১২৭৭ কোটি টাকা পাবে তারা।
এদিকে, অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল মিলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও (বেবিচক) বিমানের কাছে পাবে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এসব বকেয়া পরিশোধ না করে কাগজে-কলমে মুনাফা দেখিয়ে নিজেদের ‘লাভজনক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে ঘোষণা করে চলেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করে বিমান। এতে বলা হয়, এই অর্থবছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মোট ১০ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা আয় করেছে। এর মধ্যে নিট লাভ হয়েছে ২৮২ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে পদ্মা অয়েলের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিমান বাংলাদেশের কাছে তারা মোট ১২৭৭ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা পাওনা আছে।
পদ্মা অয়েল সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিমান নানা অজুহাত দেখিয়ে বকেয়া পরিশোধে অনীহা প্রকাশ করে। এরপর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে চাপ প্রয়োগ করে বকেয়া মওকুফের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে ঋণ পরিশোধে লম্বা সময়ের কিস্তি মঞ্জুর করিয়ে নেয় তারা।
জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (প্রশাসন-২) মোহাম্মদ ফারুক বলেন, বাংলাদেশ বিমানের কাছে যে বকেয়া রয়েছে তা পরিশোধ করার জন্য তাদের বারবার বলা হচ্ছে এবং আমাদের মিটিংয়েও বিষয়টা উঠে আসে। তারা এখন প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা করে পরিশোধ করছে কিন্তু আমরা বলেছি পরিমাণটা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, যাতে বকেয়াটা পরিশোধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, এটা মওকুফ করার কোনো সুযোগ নেই, বিমানকে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে।
জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে পদ্মা অয়েলের টাকা বকেয়া রাখা শুরু করে বিমান। ২০২০ সালে বকেয়ার পরিমাণ ২১০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এ বছরগুলোতে বিমান প্রতি মাসে ৩০০ কোটি টাকার জেট ফুয়েল কিনত। কিন্তু পরিশোধ করত ২০ কোটি টাকার মতো। হঠাৎ সেসময় দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে এভিয়েশন খাতের লোকসানের কথা উল্লেখ করে বকেয়া মওকুফের আবেদন করে বিপিসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল বিমান। তবে বিল মওকুফের আবেদন খারিজ করে বিপিসি। ২০২৩ সালে পাওনা আদায়ের উদ্যোগ নেয় তারা। মাসিক ১০-১৫ কোটি টাকার ছোট ছোট কিস্তিতে বিমান আগের পাওনা পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বিমান বলছে, ২০২৬-২৭ সালের মধ্যে এসব বকেয়া পরিশোধ করতে পারবে তারা। তবে বর্তমান কিস্তি অনুযায়ী বকেয়া পরিশোধে ১৭-২০ বছর লেগে যাবে বলে জানিয়েছে পদ্মা অয়েল।
আবারও ‘মাফ’ পাবে বিমান?
পদ্মা অয়েলের মতো বেবিচকের দেনাদারের খাতায়ও সবার ওপরে নাম আছে বিমান বাংলাদেশের। বেবিচকের অধীনে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিকসহ মোট আটটি বিমানবন্দর রয়েছে। তাদের আদায় করা অ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলোর মধ্যে রয়েছে– বিমানের ল্যান্ডিং চার্জ, রুট নেভিগেশন সার্ভিস চার্জ, বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহার চার্জ ও এমবারকেশন। নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলো হলো– গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, চেক-ইন কাউন্টার ভাড়া, কার পার্কিং ও এভিয়েশন ক্যাটারিং সার্ভিস।
বেবিচক সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিমানের বিভিন্ন অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জের বকেয়া এবং সারচার্জ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ছিল। বর্তমানে এটি ৬ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। তবে পাওনা পরিশোধে তেমন কোনো তোড়জোড় নেই বিমানের। বরং বকেয়া এক পাশে রেখে রেকর্ড পরিমাণ আয় ও নিট লাভ দেখিয়ে চলেছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানটি।
আরও পড়ুন
এর আগে, ২০০৮ সালে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকার পাহাড়সম দেনায় পড়ে বিমান। ওই সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে ১২১৬ কোটি টাকার সারচার্জ মওকুফ পায় প্রতিষ্ঠানটি। বাকি ৫৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে দায়মুক্তি পায়। ২০১৭ সালেও তাদের বকেয়া ১৭০০ কোটি টাকা মাফ করে দেয় বেবিচক। তবে এবার আর মাফ পাচ্ছে না তারা।
বেবিচকের সদস্য (অর্থ) এস এম লাবলু রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানের এখনো অনেক চার্জ বকেয়া রয়েছে। এগুলো মওকুফ করা হয়নি। মওকুফের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বা আলোচনাও হয়নি।
এদিকে পাহাড়সম বকেয়ার বিষয়ে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা অয়েলের কাছে আমাদের কোনো বকেয়া নেই। যে বকেয়া ছিল সেটা ডিস্পিউটেড (আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে)। এগুলো ২০২০ সালের আগের বকেয়া। ২০২০ সালের পর পদ্মায় আমাদের কোনো বকেয়া নেই।
বেবিচকের পাওনার বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলোও ২০২০ সালের আগের। ২০২০ সালের পর কোনো পাওনা নেই। আগের পাওনাগুলো ২০২৭-২৮ অর্থবছরে পরিশোধ করা হবে বলে বেবিচককে জানানো হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে যা বলেছে বিমান
বিমানের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তারা রেকর্ড পরিমাণ আয় করেছে, যার পরিমাণ ১০ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ৯ শতাংশ বেশি। এ অর্থবছরে বিমান ১৫৫৬ কোটি টাকা অপারেশনাল মুনাফা অর্জন করেছে, তবে এক্সচেঞ্জ লস ও ট্যাক্স পরবর্তী ২৮২ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জিত হয়েছে। এ নিয়ে করোনা মহামারির পর টানা চতুর্থবারের মতো লাভের ধারা অব্যাহত রেখেছে বিমান এবং সর্বশেষ ১০ অর্থবছরে আট বারই নিট মুনাফা অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ অর্থবছরে ২১টি উড়োজাহাজের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ৩০টি গন্তব্যে মোট ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮৫ জন যাত্রী পরিবহন করেছে বিমান, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় এক লাখ বেশি। এ ছাড়া ৪৩ হাজার ৪৪ টন কার্গো পরিবহন করে ৬৩৭ কোটি টাকা আয় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩ লাখ ৫০ হাজার ২২২ মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডেল করে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৩.১ শতাংশ বেশি। বিমান বিদেশি ৩২টি যাত্রীবাহী এয়ারলাইন্স ও ১৭টি কার্গো এয়ারলাইন্সকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিষেবা দিয়েছে। এ অর্থবছরে বিদেশি এয়ারলাইন্সের ৩৩ হাজার ২৯৭টি ফ্লাইটের ৬৬ লাখ ৩২ হাজার ৭৬০ জন যাত্রীকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিমান দাবি করেছে, গত ৫৩ বছরে বিমান সরকার থেকে কোনো প্রকার ভর্তুকি গ্রহণ করেনি। সম্পূর্ণ নিজস্ব তহবিল থেকে ১৩টি নতুন উড়োজাহাজ ক্রয় বাবদ (লোন ও সুদসহ) নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ১২ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ ১০৫ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে।
এআর/ওএফএ/এসএসএইচ