আইআইইউসি ছিল নদভীর ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’
তিন বছর আগে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও আওয়ামী লীগের নেতা আবু রেজা মোহাম্মদ নদভী। তখন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে জামায়াত-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে চর দখলের মতো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। এরপর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক যত অর্থ ব্যয় করেছেন তার সিংহভাগই করা হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে। এ ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশও এসেছে প্রতিষ্ঠানটি থেকে। অবস্থা এমনই, নদভীর বাসায় ফুলের টব লাগবে— সেটিও আইআইইউসি থেকে নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে চট্টগ্রাম- ১৫ আসন থেকে দশম ও একাদশ নির্বাচনে দুবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন নদভী। জামায়াতের কর্মপরিষদের সাবেক সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর আমির প্রয়াত মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরীর জামাতা নদভী একসময় আইআইইউসি’র শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে বরখাস্ত করা হয় তাকে। জামায়াতের তকমা গায়ে থাকলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হওয়ার পর চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নদভী। তার হাতেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সাতকানিয়া-লোহাগাড়া জামায়াতের কয়েকজন নেতাকর্মী। এ ছাড়া মামলা-হামলায় বাড়িছাড়া হয়েছেন অনেকে। আওয়ামী লীগের অন্য সব নেতার তুলনায় নদভীর হাতেই জামায়াতের কর্মীরা বেশি নির্যাতিত হয়েছেন— এমন অভিযোগও রয়েছে।
আইআইইউসি টাওয়ার থেকে নদভী সম্মানী নিতেন ১০ লাখ নয় হাজার ৩৩৩ টাকা। এর বাইরে গাড়ির জ্বালানিবাবদ নিতেন ৫০ হাজার এবং মোবাইল বিলবাবদ নিতেন সাত হাজার টাকা। এ ছাড়া দুই ঈদে উৎসব ভাতা হিসেবে প্রতিবার নিতেন ছয় লাখ ২২ হাজার ২২৩ টাকা। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নদভীর বউ রিজিয়া রেজা সুলতানা টাওয়ার থেকে সম্মানী হিসেবে পেতেন দুই লাখ ৭০ হাজার ৬৬৭ টাকা। তিনি মোবাইল বিল পেতেন তিন হাজার টাকা। আর দুটি উৎসব ভাতার প্রতিটিতে পেতেন দুই লাখ ২২ হাজার ২২৩ টাকা
এমপি হিসেবে দায়িত্বপালনকালে নদভীর কাছে কেউ সহায়তা চাইলে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। তবে, সেই সহায়তা দেওয়া হতো আইআইইউসি’র ফান্ড থেকে। নদভীর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনে’ কেউ কিছুর জন্য আবেদন করলে সেটিও দেওয়া হতো বিশ্ববিদ্যালয়টির ফান্ড থেকে। এমপি হিসেবে নদভী যাতায়াতসহ নানা ভাতা সংসদ থেকে পেতেন। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো- ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত শুধুমাত্র দেশের ভেতরে যাতায়াতে বিমানের ভাড়াবাবদ নিয়েছেন ৩৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এর বাইরে তিনি আইআইইউসি’র কাছ থেকে তেল খরচসহ গাড়ির সুবিধা নিয়েছেন।
আগের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে। তাদের উপহার হিসেবে দেওয়া হতো আইআইইউসি’র ফান্ড থেকে মোটা অঙ্কের টাকা। শুধু এক দুদক কর্মকর্তাকে তিনি ঘুষ হিসেবে কাগজে-কলমে দিয়েছিলেন ১০ লাখ টাকা।
আইআইইউসি টাওয়ার থেকে বেশি লুটপাট
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থিত আইআইইউসি টাওয়ার। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও আইআইইউসি ফান্ডের সহায়তায় ১৫ তলাবিশিষ্ট ভবনটি নির্মিত হয়। এখান থেকে মাসে গড়ে ৯০ লাখ টাকা আয় হয়। কথা ছিল আইআইইউসি টাওয়ার থেকে অর্জিত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রদের কল্যাণে ব্যয় হবে। কিন্তু নদভী দায়িত্ব নেওয়ার পর টাওয়ারটির দিকে নজর দেন। দায়িত্বপালনকালে টাওয়ারটি থেকে নদভী সম্মানী নিতেন ১০ লাখ নয় হাজার ৩৩৩ টাকা। এর বাইরে গাড়ির জ্বালানিবাবদ নিতেন ৫০ হাজার এবং মোবাইল বিলবাবদ নিতেন সাত হাজার টাকা। এ ছাড়া দুই ঈদে উৎসব ভাতা হিসেবে প্রতিবার নিতেন ছয় লাখ ২২ হাজার ২২৩ টাকা। ওই সময় ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী দ্বীন মোহাম্মদ টাওয়ার থেকে সম্মানী নিতেন ছয় লাখ ৩০ হাজার ৬৬৭ টাকা। তিনিও আনলিমিটেড জ্বালানি এবং মোবাইল বিলবাবদ তিন হাজার টাকা করে পেতেন। এ ছাড়া বছরে দুটি উৎসব ভাতা হিসেবে প্রতিবার পেতেন চার লাখ ১৭ হাজার ৭৭৭ টাকা।
এমপি হিসেবে দায়িত্বপালনকালে নদভীর কাছে কেউ সহায়তা চাইলে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। তবে, সেই সহায়তা দেওয়া হতো আইআইইউসি’র ফান্ড থেকে। নদভীর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনে’ কেউ কিছুর জন্য আবেদন করলে সেটিও দেওয়া হতো বিশ্ববিদ্যালয়টির ফান্ড থেকে। এমপি হিসেবে নদভী যাতায়াতসহ নানা ভাতা সংসদ থেকে পেতেন। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো- ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত শুধু দেশের ভেতরে যাতায়াতে বিমানভাড়া বাবদ নিয়েছেন ৩৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এর বাইরে তিনি আইআইইউসি’র কাছ থেকে তেল খরচসহ গাড়ির সুবিধা নিয়েছেন
ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নদভীর বউ রিজিয়া রেজা সুলতানা টাওয়ার থেকে সম্মানী হিসেবে পেতেন দুই লাখ ৭০ হাজার ৬৬৭ টাকা। তিনি মোবাইল বিল পেতেন তিন হাজার টাকা। আর দুটি উৎসব ভাতার প্রতিটিতে পেতেন দুই লাখ ২২ হাজার ২২৩ টাকা।
নদভীর লুটপাটে সহায়তাকারীরাও পেতেন ভাতা
আইআইইউসিতে চাকরি করেন এমন অন্তত আটজনকে অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হতো টাওয়ারের আয় থেকে। ভবনটির ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন না হলেও অতিরিক্ত এসব কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের ভাতা দেওয়া হতো।
আরও পড়ুন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইআইইউসি’র বেতনের পাশাপাশি টাওয়ার থেকে সম্মানী হিসেবে তৎকালীন রেজিস্ট্রার আখতারুজ্জামান কায়সারকে ৭০ হাজার, ট্রেজারার মহিউদ্দিন মাহীকে ৮৫ হাজার, ডিরেক্টর (ইনচার্জ) মাহফুজুর রহমানকে ৪০ হাজার, ইফতেখার উদ্দিনকে ২৫ হাজার, ফয়সাল আহমেদকে ২৫ হাজার, ডিরেক্টর (ইনচার্জ) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইফতেখারুল আলমকে ২৫ হাজার, কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিয়াউর রহমানকে ২০ হাজার এবং ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সারোয়ার আলমকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হতো। ‘নদভীর লুটপাটে সহায়তাকারী’ বিবেচনায় তাদের অতিরিক্ত এ ভাতা দেওয়া হতো বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তা-শিক্ষকেরা।
জালিয়াতি করে নদভীর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠানো হয় দুবাই
নিয়ম অনুযায়ী, আইআইইউসি’র টাওয়ার কমিটির কোনো সদস্য মেডিকেল ভাতা পান না। কিন্তু রিজিয়া রেজা দুবাইয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য টাকা পাঠাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন নদভী। গলব্লাডার (পিত্তথলি) অপারেশনের জন্য নদভীর স্ত্রীর জন্য টাওয়ার থেকে পাঠানো হয় ৩০ লাখ টাকা। এরপর ওই টাকা সমন্বয় করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন কর্মকর্তারা। এ কারণে নদভী ওই সময় টাওয়ার কমিটির মিটিংয়ের রেজুলেশন সংশোধন করতে বলেন।
আরও পড়ুন
টাওয়ার কমিটির ১৫তম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের ১৪ মার্চ। ওই দিনের দুটি রেজুলেশনের কপি এ প্রতিবেদকের হাতে আসে। এর মধ্যে একটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু রেজা নদভী ও তৎকালীন রেজিস্ট্রার সফিউর রহমানের সই রয়েছে। তবে, মেডিকেল ভাতার কথা উল্লেখ করে জালিয়াতি করা রেজুলেশনে সই রয়েছে তিনজনের। সেখানে গৃহীত সিদ্ধান্তের তালিকায় মেডিকেল ভাতা প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর নদভীর স্ত্রী রিজিয়ার জন্য পাঠানো ৩০ লাখ টাকা সমন্বয় করা হয়।
টাওয়ারের আয়-ব্যয় যোগ হতো না মূল অ্যাকাউন্টে
জুলাই ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাববিবরণীতে আইআইইউসি টাওয়ার থেকে কোনো আয় দেখানো হয়নি। টাওয়ার ফান্ড থেকে চ্যান্সেলরের পূর্বানুমতি ছাড়া ডেবিট ভাউচারের মাধ্যমে দুই দফায় চার লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪৪ (৬) ধারার লঙ্ঘন। টাওয়ারের ইসলামী ব্যাংকের স্টেটমেন্টে এটির প্রমাণ মেলে। আবার টাওয়ার থেকে প্রাপ্ত মাসিক অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা না দিয়ে আলাদাভাবে জমা রাখা হতো। এরপর এসব টাকা নয়ছয় করা হতো। তিন বছরে এভাবে অন্তত ৩২ কোটি টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আয় একটি মাত্র অ্যাকাউন্টে জমা হবে এবং একটি মাত্র অ্যাকাউন্ট থেকেই অর্থব্যয় হবে। এ ছাড়া এ টাওয়ারের দাতা সংস্থা ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকেও বলা হয়েছিল যে, এ টাওয়ার হতে অর্জিত অর্থ শুধু আইআইইউসি’র উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে।
পাকিস্তানের নাগরিককে চাকরি দেওয়া
দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদভী আইআইইউসিতে চাকরি দিয়েছিলেন আমিন নদভী নামের একজনকে। পাকিস্তান থেকে যিনি বাংলাদেশে ভ্রমণ ভিসায় আসেন। তাকে আইআইইউসি’র ক্যাম্পাস কো-অর্ডিনেটর, মোরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের ডিরেক্টর এবং মসজিদ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও তার ভিসায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘চাকরি নিষিদ্ধ’।
এ ছাড়া আমিন নদভীর বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। তারপরও তাকে আইআইইউসি থেকে মাসে অন্তত চার লাখ টাকা ক্যাশে সম্মানী দেওয়া হতো। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হলে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ব্যাখ্যা চায় ইউজিসি। যদিও বিষয়টি নিয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি সংস্থাটি।
আইআইইউসি’র টাওয়ার কমিটির কোনো সদস্য মেডিকেল ভাতা পান না। কিন্তু রিজিয়া রেজা দুবাইয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য টাকা পাঠাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন নদভী। গলব্লাডার (পিত্তথলি) অপারেশনের জন্য নদভীর স্ত্রীর জন্য টাওয়ার থেকে পাঠানো হয় ৩০ লাখ টাকা। এরপর ওই টাকা সমন্বয় করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন কর্মকর্তারা। এ কারণে নদভী ওই সময় টাওয়ার কমিটির মিটিংয়ের রেজুলেশন সংশোধন করতে বলেন
আইআইইউসির গাছ বিক্রি করে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাৎ
নদভী ও তার অনুসারীরা ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উসমান হল ও ফার্মেসি ভবনের সামনের ২০ লাখ টাকার গাছ কেটে বিক্রি করে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া সর্বশেষ ঈদুল ফিতরের ছুটির সময় বিক্রি করেন আরও ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকার গাছ। গাছ কাটা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেই কমিটিকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মহিউদ্দিন মাহির নির্দেশে গাছ কাটা ও পাচারের সব সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলা হয়। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কনভেনার (আহ্বায়ক) মিটিংয়ে সিসিটিভি ফুটেজ চাইলে ড. মহিউদ্দিন মাহি ‘দিচ্ছি-দিব’ বলে আর সরবরাহ করেননি। আবু রেজা নদভীও এ ব্যাপারে মৌখিকভাবে তদন্ত কমিটির কনভেনারকে আর না এগোতে নির্দেশনা দেন বলেও অভিযোগ আছে।
প্রধানমন্ত্রীর বরখাস্ত এপিএস লিকুর নাম ভাঙিয়ে অর্থ আত্মসাৎ
কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন এপিএস-২ হাফিজুর রহমান লিকুসহ অন্যরা। তাদেরকে পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসন ব্লুতে রাখা, আপ্যায়ন ও সংবর্ধনা দেয় আইআইইউসি। যেখানে প্রকৃত বিল পাওয়া যায় ২০ লাখ টাকা। অথচ নদভী এ বিষয়ে আইআইইউসি থেকে নেন অন্তত অর্ধ কোটি টাকা। পরবর্তীতে বিভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বিমানের ফ্লাইটের টিকিট ও হোটেল বুকিংয়ের ভুয়া বিল তৈরি করে খরচ সমন্বয় করা হয়।
ব্যক্তিস্বার্থে অহেতুক কনফারেন্স-সেমিনার করে অর্থের অপচয়
নদভী অপ্রয়োজনীয় সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজন করে ট্রাস্টের বিশাল অঙ্কের টাকা অপচয় করেছেন, যা ট্রাস্ট আইন- ১৮৮২ এর ১৮ নম্বর ধারার লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্বিবার্ষিক সম্মেলন করেছেন নদভী। এতে দেশি-বিদেশি নানা ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে আইআইইউসিতে আনা হয়। ওই অনুষ্ঠানে খরচ হয় দেড় কোটি টাকারও বেশি। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য নীতিনির্ধারককে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, আমন্ত্রিত অতিথিরা অন্তত এক হাজার কোটি টাকা অনুদান প্রদান করবেন। অথচ তারা এক টাকাও অনুদান প্রদান করেননি। অতিথিদের বেশির ভাগই ছিল তার ব্যক্তিগত ফাউন্ডেশনের (আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন) দাতা।
২০২৩ সালের ৩১ মে আইআইইউসিতে ‘আন্তর্জাতিক নদভী সেমিনার’-এর আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ খরচ করে আবু রেজা নদভী তার ১২০০ বন্ধুকে আইআইইউসিতে আনেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিমানে অথবা বিলাসবহুল স্লিপার বাসে তাদের আনা হয়। আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের পাশাপাশি নগদ অর্থও উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। অথচ এত বড় একটি সেমিনারের কোনো রেকর্ড অর্থাৎ খরচের বিবরণী বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা না হলেও সমুদয় অর্থ ভুয়া অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়, যার পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা।
টাওয়ার ফান্ড থেকে চ্যান্সেলরের পূর্বানুমতি ছাড়া ডেবিট ভাউচারের মাধ্যমে দুই দফায় চার লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪৪ (৬) ধারার লঙ্ঘন। টাওয়ারের ইসলামী ব্যাংকের স্টেটমেন্টে এটির প্রমাণ মেলে
অবৈধভাবে আইআইইউসির সম্পদ বিক্রি করে আত্মসাৎ
জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে অনুমোদন হওয়ার আগে ট্রাস্টের সম্পদ বেচাকেনা করে ট্রাস্ট আইন লঙ্ঘন করেন নদভী। তিনি ট্রাস্ট বা আদালত থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে ট্রাস্টের জায়গা ও সম্পদ বিক্রি করেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নগরের চকবাজার এলাকার কেবি প্লাজার ফার্মেসি বিল্ডিং, সুবসতী চক আর্কেডের দুটি ফ্ল্যাট বেচাকেনার হিসাবে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা গরমিল পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া আইআইইউসি’র বিভিন্ন সচল যন্ত্রাংশ, এয়ার কন্ডিশনার স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী কোনো চরম আর্থিক সমস্যা দেখা না দিলে জায়গা, যে কোনো সম্পদ, স্ক্র্যাপ বা পচনশীল দ্রব্য বিক্রি করলে তা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু জায়গা ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে প্রায় সাত কোটি টাকা কোনো লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়নি যা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় হবে। এসব সম্পদ বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থে বিদেশ সফর, সভা ও সেমিনারসহ বিভিন্ন বেআইনি খাতে খরচ করা করেন নদভী।
ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে তছরুপ করেন নদভী
ইউজিসি থেকে নিষেধ করা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিক্সড ডিপোজিট থেকে আট কোটি টাকার অধিক অর্থ নয়ছয় করেন আবু রেজা নদভী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ অনুযায়ী, পাঁচ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রাখতে বাধ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। নদভী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ বছরের পুরোনো এ ডিপোজিট জোরপূর্বক ভেঙে ফেলেন। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ এর ৬ (৯)-এর লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া আইন লঙ্ঘন করে নদভী বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শাখায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোনালী ব্যাংক পিএলসি, রূপালী ব্যাংক পিএলসি ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির অন্তত ১৮টি অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতা আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া আইআইইউসি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা পলাতক থাকায় তারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি
সংসদ ও আইআইইউসি থেকে একই সময়ে টিএ-ডিএ গ্রহণ
আবু রেজা নদভী এমপি থাকাকালীন দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের জন্য সংসদ সদস্য হিসেবে সরকারি টিএ-ডিএ পেতেন। তবে, তিনি এটির পাশাপাশি আইআইইউসি থেকে টিএ-ডিএবাবদ ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩৮ লাখ টাকা নেন। এর বাইরে বিদেশ ভ্রমণবাবদও আইআইইউসি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নেন তিনি।
আরও পড়ুন
আইআইইউসির টাকায় ভাড়া নেওয়া হয় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট
সংসদ সদস্য থাকাকালে ঢাকায় নদভী থাকতেন এমপি হোস্টেলে। কিন্তু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর সেটি তাকে ছেড়ে দিতে হয়। ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকার দুশ্চিন্তা দূর করতে নদভী আইআইইউসি’র টাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। রাজধানীর বনানী বি-ব্লকে অবস্থিত তার থাকার ফ্ল্যাটটির প্রতি মাসে ভাড়াবাবদ ধরা হয় এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তীতে ২৪ মাসের জন্য এটি ভাড়া নেয় আইআইইউসি। আবার এটি দেখভাল করার জন্য ৫০ হাজার টাকা বেতনে আহমাদুল হক বাবু নামে একজনকে সুপারভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেন নদভী।
নদভী দম্পতির হানিমুন-বিদেশ সফরের ব্যয় দেয় আইআইইউসি
আইআইইউসি’র টাকায় আবু রেজা নদভী, রিজিয়া রেজা ও কাজী দ্বীন মোহাম্মদ অন্তত ১৫ বার অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে খরচ হয়েছে অন্তত তিন কোটি টাকা। ভ্রমণকালীন তারা প্রতিদিন ২০০ ডলার করে ভাতা হিসেবে আরও অন্তত দুই কোটি টাকা গ্রহণ করেন। মূলত বৈদেশিক সাহায্য আনার প্রলোভন দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা খরচ করেন তারা। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ট্রাস্টি বোর্ড সভার রেজুলেশনে। নদভী শুধু আইআইইউসি’র দশম ট্রাস্টি সভায় ৩৫০ কোটি টাকার অধিক আর্থিক অনুদান এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যার কিছুই বাস্তবতার মুখ দেখেনি।
এইচএসসি পাস করা ব্যক্তিকে মাস্টার্স পাস দেখিয়ে নিয়োগ
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ ফয়সাল। কাগজে-কলমে তিনি এইচএসসি পাস। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন মাস্টার্স পাস। সেই আবেদনের ভিত্তিতে নদভী তাকে এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের ডিরেক্টর (ইনচার্জ) হিসেবে নিয়োগ দেন। যদিও গত ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক রয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন
নিয়োগ মার্চে, কার্যকর জানুয়ারি থেকে
মাওলানা আহমদুল হক বাবু। নদভীর দীর্ঘদিনের পিএস। আগে থেকে ঢাকার যাবতীয় কাজ বাবুকে দিয়ে করাতেন নদভী। আইআইইউসি’র ঢাকার গেস্ট হাউজে তাকে মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়। তার নিয়োগপত্রে রেজিস্ট্রার সই করেন চলতি বছরের ২০ মার্চ। তবে, নিয়োগপত্রে উল্লেখ করা হয় জানুয়ারি মাস। অর্থাৎ প্রায় তিন মাস চাকরি না করে বেতন পান পিএস বাবু।
নদভীর নামে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখা, আইআইইউসির ব্যয় ২৭ লাখ
বাংলা, আরবি ও ইংরেজি— এ তিন ভাষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী লিখেছেন বলে দাবি করেন আবু রেজা নদভী। অথচ বইগুলো তিনি আইআইইউসি’র কয়েকজন শিক্ষককে দিয়ে লিখিয়ে নেন। ইংরেজি ভাষায় লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান সরোয়ার আলম, তাহের হোসেন, ইফতেখার উদ্দিন, রিয়াজ মাহমুদ ও সহকারী অধ্যাপক আজিজুল হককে। আরবি ভাষায় রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় নাজমুল হক নদভী, সৌদ, আব্দুর রহিম, আমিন নদভী ও শাকের আলমকে। বাংলায় লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. সাঈদ ও আমিন নদভীকে। এসব বই লেখা নিয়ে অন্তত ২০টি মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। যাতে সিটিং অ্যালাউন্সবাবদ তারা নেন প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।
যদিও এসব বই প্রথমবার ১০ লাখ টাকা দিয়ে মুদ্রণ করা হয়েছিল। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ভুল, এমনকি বঙ্গবন্ধুর নামের বানান ভুল থাকায় সেই প্রকাশিত বই বাতিল করা হয়। আবারও ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে সেই বইগুলো পুনঃমুদ্রণের জন্য চুক্তি করা হয়। এসব বই প্রকাশে অন্তত ২৭ লাখ টাকা আইআইইউসি’র ফান্ড থেকে ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে। কিন্তু এখনও তা প্রকাশিত হয়নি।
৭০ হাজার টাকা বেতনে নদভীর ছেলেকে নিয়োগ
আইআইইউসি দখলের পর আবু রেজা নদভী তার ছেলে জাওয়াদ মাহাদিকে ৭০ হাজার টাকা বেতনে প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি দেন। তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় আইসিটি উপদেষ্টা হিসেবে। যদিও এ পদে তার এক দিনও চাকরি করার অভিজ্ঞতা ছিল না। আবার নিয়োগের পর তাকে কোনো দিন অফিস করতে দেখা যায়নি। শুধু টাকা হাতিয়ে নিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা। এরপর নদভীর ছেলেকে আইআইইউসি’র পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা বৃত্তি দিয়ে তুরস্কে পাঠানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ বৃত্তির ফান্ড থেকে সেই টাকা দেওয়া হয়। যদিও ওই সময়ে নদভীপুত্র আইআইইউসি’র শিক্ষার্থী ছিলেন না।
আইআইইউসির গাছের চারায় নিজ বাসার সৌন্দর্য বৃদ্ধি
নদভীর বাসার সৌন্দর্য বাড়াতে প্রয়োজন হয় গাছের চারার। কিন্তু সেটিও তার টাকা দিয়ে কেনার প্রয়োজন হয়নি। চারা সংগ্রহ করা হয় আইআইইউসি থেকে। এ সংক্রান্ত একটি কাগজ এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি নদভীর বাসায় কাজ করা আনোয়ার হোসেনের সই দিয়ে চারাগুলো আইআইইউসি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সংক্রান্ত নোটে উল্লেখ করা হয়- আইআইইউসি’র নার্সারি থেকে ফিমেল অ্যাকাডেমিক জোনের চেয়ারম্যান রিজিয়া রেজা চৌধুরীর বাসার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য পাম গাছের চারা নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কমিটি করে আইআইইউসি থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া
আইআইইউসি থেকে সরাসরি বেতন গ্রহণ করতে পারেন না ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা। এজন্য নদভী নিয়েছিলেন ভিন্ন কৌশল। ক্যাম্পাসে অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন কমিটি করেন তিনি। এসব কমিটির প্রায় সবকটিতে নদভী, তার বউ রিজিয়া ও দ্বীন মোহাম্মদ সদস্য হিসেবে ছিলেন। কারণে-অকারণে বৈঠক দেখিয়ে তারা আইআইইউসি থেকে হাতিয়ে নেন বিপুল অঙ্কের টাকা। এমনও হয়েছে, এক দিনে নদভী পাঁচ থেকে ১০টা বৈঠকে উপস্থিতি দেখিয়ে প্রতিটি বৈঠক থেকে পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা অ্যালাউন্স হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি মিটিংয়ের জন্য তারা ট্রাস্টি বোর্ড থেকে পেতেন ১৫ হাজার টাকা, আর সিন্ডিকেট থেকে পেতেন ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বাকি কমিটি থেকে পেতেন পাঁচ হাজার টাকা করে। এর মধ্যে ছিল প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটি, ফাইন্যান্স কমিটি, নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটি, ক্যাম্পাস ডেভেলপমেন্ট কমিটি, বিদেশ বিভাগ ও স্টাফ ডেভেলপমেন্ট কমিটি, পারচেজ কমিটি, অকশন কমিটি, টেন্ডার কমিটি, রিচার্জ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স কমিটি, সেন্টার ফর রিচার্জ কমিটি, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, বঙ্গবন্ধুর জীবনী রচনা সংক্রান্ত কমিটি, ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটি, প্রেস মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন কমিটি ও ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি।
আবেদন ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনে, টাকা দিত আইআইইউসি থেকে
২০২২ সালের মার্চে লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা মাওলানা শোয়াইব চৌধুরী নামে একজন নদভীর আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনে চিকিৎসা সহায়তার জন্য আবেদন করেন। আবেদনটিতে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইআইইউসি’র তৎকালীন ট্রেজারারকে মেনসন করেন নদভী। এ ছাড়া একই উপজেলার এবাদুর রহমান নামে আরেকজন নদভীর কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করেন। ওই আবেদনটিতেও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইআইইউসি ট্রেজারারকে মেনসন করেন তিনি।
দুদক কর্মকর্তার মসজিদে ১০ লাখ টাকার অনুদান
আইআইইউসিকে কবজায় নেওয়ার পর নদভীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা। আইআইইউসি’র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আ ন ম শামসুল ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। তখন আইনিভাবে একটু বেকায়দায় পড়েন নদভী। এরপরই তিনি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দায়িত্বে থাকা লোকজনের ওপর চড়াও হন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানায় বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কয়েকজন সদস্যকে আসামি করে মামলা করেন। একইসঙ্গে আইআইইউসি থেকে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে দুদকে অভিযোগও জমা দেন নদভী।
দুদকের কর্মকর্তাদের দিয়ে চাপ দেওয়া হয় শামসুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দায়িত্বে থাকা জামায়াত নেতাদের। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন দুদকের উপ-পরিচালক (ডিডি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। মোহাম্মদ সিরাজুল হক নামের ওই কর্মকর্তা এখন দুদক প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া হওয়ায় আগে থেকে নদভীর সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সদস্যদের বেকায়দায় ফেলার পুরস্কারস্বরূপ নদভীর পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন থেকে ৩০ লাখ টাকা মসজিদের জন্য অনুদান দিতে আবেদন করেন দুদকের ওই কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর চকরিয়ার উত্তর বিনামারা আল আকসা মসজিদের পক্ষ থেকে নির্মাণকাজের জন্য সহায়তা চেয়ে আবেদনটি করা হয়। একই বছরের ১৪ নভেম্বর আইআইইউসি’র কর্মকর্তা এ কে এম আসাদুজ্জামান সোনালী ব্যাংকে গিয়ে চকরিয়ার উত্তর বিনামারা আল আকসা মসজিদের অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা জমা দেন।
সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতা আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া আইআইইউসি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা পলাতক থাকায় তারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
নদভীর আমলে রেজিস্ট্রারের দায়িত্বপালনকারী রেজিস্ট্রার আখতারুজ্জামান কায়সারও এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ যায় আগের জামায়াতপন্থি ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে। বোর্ডের বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান ও জামায়াতের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ শাহজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদভী চর দখলের মতো করে আইআইইউসি দখল করেছিলেন। এক কথায় প্রতিষ্ঠানটিতে তার নির্দেশে যত কাজই হয়েছে সব অবৈধ। নদভী বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছেন।
এমআর/