কাটা-ছেঁড়া ছাড়ছে না ড্যাপকে
এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানদণ্ড প্রণয়ন, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়— সবমিলিয়ে রাজধানী ঢাকার সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট।
ড্যাপ অনুমোদনের আগেও ছিল দীর্ঘ অপেক্ষা, বারবার সেখানে পরিবর্তন আনা হয়। পরে রাজউকের এখতিয়ারভুক্ত এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য ঢাকা মহানগর এলাকায় ড্যাপের (২০১৬–২০৩৫) খসড়া ২০২০ সালে প্রকাশ করা হয়। এরপর খসড়ার ওপর সুপারিশ ও আপত্তি দাখিল করার জন্য সবার কাছে আহ্বান জানানো হয়। পরে আপত্তি ও সুপারিশ বিবেচনা করে মহাপরিকল্পনাটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
ড্যাপে জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এ জন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে স্থপতি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা বেঁকে বসেন। শুরু হয় ড্যাপের নানা সংশোধন। আগে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও ৮/১০ তলা ভবন করা যেত। কিন্তু গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার পর ড্যাপে সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অপ্রশস্ত রাস্তার ক্ষেত্রে ৪/৫ তলা ভবন নির্মাণের বিধান রাখা হয়। এতে জমির মালিক, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপারদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। বছর ঘুরতেই ড্যাপে ভবনের উচ্চতা নিয়ে ফের ইউটার্ন নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বর্তমানে আবারও ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে কাটা-ছেঁড়া ছাড়ছে না ড্যাপকে।
সংশোধিত ড্যাপের প্রস্তাবে বলা হয়ে, আগামী তিন বছরের জন্য সরকারি ও রাজউক অনুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোতে ভবন নির্মাণে আগ্রহী আবেদনকারীকে প্রণোদনা হিসেবে অতিরিক্ত দশমিক ৫ এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত এলাকার মধ্যে খিলক্ষেত, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা, ডেমরা, রায়েরবাজার, কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকাসহ অন্যান্য এলাকায় দশমিক ৫ এফএআর বাড়ানোর সুযোগ প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে, ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১-৬ বিঘা পর্যন্ত আয়তনের ব্লক ২০ শতাংশ আর ১৫ বিঘার আয়তনের ব্লকে ৩০ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন জমির মালিকরা। ফলে সংশোধিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতা বাড়বে
এর আগেও ২০১৫ সালের মার্চে সংশোধিত ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ড্যাপ চূড়ান্ত করার কথা ছিল। সে সময় কাজ শেষ না হওয়ায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। পরে দফায় দফায় সময় আরও বাড়ানো হয়।
ড্যাপ কী
ঢাকা শহরকে নতুন করে পরিকল্পিত নগরীতে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে। সে জন্য প্রণয়ন করা হয় ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। ১৯৫৩ সালের ‘টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট’-এর আওতায় ২০১০ সালে ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রথম ড্যাপের মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয়।
পরবর্তীকালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন ড্যাপ (২০২২-৩৫) তৈরি করে। ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা করা হয়। ড্যাপে ছয়টি স্বতন্ত্র অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে ঢাকাকে। সেগুলো হচ্ছে ‘কেন্দ্রীয় অঞ্চল’- ঢাকা শহর, উত্তর অঞ্চল, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন; ‘পূর্ব অঞ্চল’- কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলা; ‘দক্ষিণ অঞ্চল’- নারায়ণগঞ্জ; ‘দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল’- কেরানীগঞ্জ উপজেলা এবং ‘পশ্চিম অঞ্চল’- সাভার উপজেলা।
আরও পড়ুন
এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানদণ্ড প্রণয়ন, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়— সবমিলিয়ে রাজধানী ঢাকার সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে নাগরিক সুবিধাদি ও পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা নির্ধারণ করে শহরের সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সে ক্ষেত্রে কোন এলাকার উন্নয়নে কতটুকু অনুমোদন দেওয়া হবে, তা নির্ভর করবে ওই এলাকার সুবিধাদিপ্রাপ্তির ওপর।
বিতর্কের শুরু যেভাবে
নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, ঢাকায় ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিক সুবিধা ও সড়কের প্রশস্ততা অনুযায়ী। যে সব এলাকায় প্রশস্ত রাস্তা ও নাগরিক সুবিধা যেমন- পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা বেশি থাকবে সে সব এলাকায় বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ভবনের উচ্চতা নিয়ে বাধা থাকবে না। অন্যদিকে, যে সব এলাকায় বা প্লটের সামনে প্রশস্ত রাস্তা নেই সে সব এলাকার ভবন নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের শর্ত দেওয়া হয় নতুন ড্যাপে। প্লটের সামনে প্রশস্ত রাস্তা কম হলে সে সব ভবন নির্মাণে মানতে হবে ড্যাপের নতুন নিয়ম। এর মানে পাঁচ কাঠার একটি জমির সামনে যদি প্রশস্ত রাস্তা না থাকে তাহলে সেখানে চার তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাবে। আগে একই পরিমাণ জমিতে আট তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হতো।
নতুন ড্যাপে ১২ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত রাস্তার পাশে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) ধরা হয়েছে ১.৭৫ অর্থাৎ এমন প্রশস্ত রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠার প্লটে পার্কিংসহ পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করা যাবে। এমন হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নতুন ড্যাপে ৬-৮ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশে ফ্ল্যাটের ফার ধরা হয়েছে ১.২৫। ৮-১২ ফুট প্রশস্তের রাস্তার ফার ১.৫, ১৬-২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ২, ২০ ফুট রাস্তার ফার ২.৫, ৩০ ফুট রাস্তার ফার ৩, ৪০-৬০ ফুট রাস্তার ফার ৩.৫ থেকে ৩.৭৫ ধরা হয়েছে। ফলে পাঁচ কাঠার একটি জমিতে আগে আট ও দশ তলার নকশা পাওয়া যেত, এখন পাওয়া যাবে পাঁচ তলার। ভবনের ব্যবহারযোগ্য স্পেসের পরিমাণও সেই অনুপাতে হবে। আগে যেখানে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও ৮/১০ তলা ভবন করা যেত, এখন সেখানে অনুমোদন পাওয়া যাবে ৪/৫ তলার। এ কারণে স্বল্প প্রস্থের রাস্তার পাশের জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দাম বেড়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাটের। সেই সঙ্গে আবাসন বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এরপর থেকেই বেঁকে বসেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। শুরু হয় ড্যাপ সংশোধনের চাপ।
আরও পড়ুন
বছর ঘুরতেই ইউটার্ন ড্যাপের
স্বল্প প্রস্থের রাস্তার পাশের জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সেই সঙ্গে আবাসন বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে, বাড়বে ভাড়াও। অন্যদিকে রাজউক বলেছিল, ঢাকার বাসযোগ্যতা ফেরাতে এটির কোনো বিকল্প নেই। প্রশস্ত রাস্তা না থাকলে এলাকাভেদে ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির সুযোগ নেই।
পরে অবশ্য সেই জায়গা থেকে সরে আসে রাজউক। প্রভাবশালী হাউজিং ও ডেভেলপারদের চাপে রাস্তার প্রশস্ততাসাপেক্ষে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের জায়গা থেকে সরে আসে তারা। আগামী তিন বছরের জন্য আবাসন প্রকল্পে ভবনের উচ্চতায় ছাড় দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বছর ঘুরতেই ড্যাপের ইউটার্নের ফলে উচ্চতা নিয়ে আর কোনো বাধা থাকল না।
পরে সংশোধিত ড্যাপের প্রস্তাবে বলা হয়ে, আগামী তিন বছরের জন্য সরকারি ও রাজউক অনুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোতে ভবন নির্মাণে আগ্রহী আবেদনকারীকে প্রণোদনা হিসেবে অতিরিক্ত দশমিক ৫ এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত এলাকার মধ্যে খিলক্ষেত, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা, ডেমরা, রায়েরবাজার, কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকাসহ অন্যান্য এলাকায় দশমিক ৫ এফএআর বাড়ানোর সুযোগ প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে, ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১-৬ বিঘা পর্যন্ত আয়তনের ব্লক ২০ শতাংশ আর ১৫ বিঘার আয়তনের ব্লকে ৩০ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন জমির মালিকরা। ফলে সংশোধিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতা বাড়বে।
আবারও সংশোধন
সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খসড়া ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০২৪ এবং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) (২০২২-২০৩৫) সংশোধনের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত মতামতের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে। সেখানে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০২৪ এবং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) (২০২২-২০৩৫) কোন মূলনীতির ভিত্তিতে সংশোধন করা হবে, তা সংশোধনের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।
অন্যদিকে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক প্রণীত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়ন, মনিটরিং ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনীর সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে সরকার।
সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে সই করেছেন অতিরিক্ত সচিব জাহেদা পারভীন। সাত সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ভূমি উপদেষ্টাকে। এ ছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা; গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
এ ছাড়া সহায়তাদানকারী কর্মকর্তা হিসেবে কমিটিতে থাকছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব; ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব; গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব; বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব; রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব; আইন ও বিচার বিভাগের সচিব; স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব এবং সেতু বিভাগের সচিব। কমিটিতে ‘সচিব’ বলতে সিনিয়র সচিবও অন্তর্ভুক্ত হবেন বলে জানানো হয়েছে।
কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক প্রণীত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়ন, মনিটরিং ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনী আনার সুপারিশ করা। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপট করতে পারবে। কমিটির সভা প্রয়োজন অনুসারে অনুষ্ঠিত হবে।
ড্যাপ সংশোধন চান ভূমির মালিক ও ব্যবসায়ীরা
ঢাকা শহরের সব এলাকায় ২০০৮ সালের বিধিমালা মোতাবেক ভবন নির্মাণের অনুমতিসহ বিধি অনুসারে রাস্তা অনুযায়ী যেখানে যত তলা পাওয়া যেত, তত তলার অনুমোদন দেওয়া হতো। ঢাকা শহরের সব রাস্তাকে কমপক্ষে ২০ ফিটে উন্নীত করা; জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট বন্ধ করা; ধানি জমিতে ভবন নির্মাণের অনুমতি বন্ধ করা; নির্মাণ অনুমোদন সহজ এবং রাজউকের হয়রানি বন্ধ করাসহ বেশকিছু দাবি জানিয়েছে ঢাকা শহরের ভূমির মালিকরা। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলন করে তারা এসব দাবি জানান। তারা বলেন, ড্যাপ সংশোধন না করলে আগের নির্মাণ করা ১০ তলা বা তার ওপরে করা ভবন ভেঙে সব পাঁচ তলা করতে হবে। কারণ, একই পরিমাণ জমিতে আগে ১০ তলা হলে এখন পাঁচ তলার বেশি হবে— এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
চূড়ান্ত ড্যাপে ঢাকার অপরিকল্পিত এলাকা জিনজিরার জনঘনত্ব কাঠাপ্রতি পরিবার সংখ্যা ১.২ বা একরপ্রতি ১৫০ দেওয়া থাকলেও ১৮ নভেম্বর রাজউক প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ১৫০ শতাংশ বেড়ে কাঠাপ্রতি পরিবার সংখ্যা ৩.০ বা একরপ্রতি প্রায় ৩৫০ জন প্রস্তাব করা হয়েছে। এই এলাকার আগে প্রস্তাবিত এফএআর মান ১.৩ থেকে ১৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩.৩
এ বিষয়ে ঢাকা শহরের ভূমির মালিকদের সমন্বয়ক ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাদ বলেন, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে স্বৈরাচারী দলের দোসর ও রাজউকের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় ঢাকা শহরের বহুবিধ সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে একমাত্র ভবন নির্মাণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ড্যাপ ২০২২-৩৫ প্রণয়ন করা হয়। যা ঢাকা শহরের নাগরিকদের মধ্যে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, ড্যাপে ঢাকা শহরের মাত্র ২০ শতাংশ পরিকল্পিত এরিয়ায় সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা রেখে অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ এরিয়াকে অপরিকল্পিত এরিয়ার ট্যাগ দিয়ে ভবনের উচ্চতা ও আয়তন হ্রাস করে দেওয়া হয়, যাতে ঢাকা শহরের প্রকৃত ভূমির মালিকরা কোনোভাবেই ভবন নির্মাণ করতে না পারেন। যার ফলশ্রুতিতে আমরা নগরবাসী নতুন করে কোনো ভবন নির্মাণ করতে গেলে দেখতে পাই যে, একই পরিমাণ জমিতে আগে যেখানে ১০ তলা ভবন হতো এবং যে আয়তন পাওয়া যেত এখন সেখানে পাঁচ তলা ভবন ও অর্ধেক আয়তন পাওয়া যাচ্ছে। এতে আমরা ব্যাপক ক্ষতি ও চরম বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছি।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আবাসন খাতের কয়েকটা সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বৈষম্যমূলক ড্যাপ। ২০২২ সালে নতুন বৈষম্যমূলক ড্যাপের কার্যক্রম শুরু হয়। দুই বছর আগেই আমরা বলেছিলাম, নতুন ড্যাপের কারণে মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) হ্রাসের কারণে মূল ঢাকার বেশির ভাগ ভবনের উচ্চতা কমে যাবে। ফলে ভবিষ্যতে আবাসনের সংকট আরও প্রকট হবে। ফ্ল্যাটের দামও বাড়বে।
তিনি বলেন, বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, আবাসনপ্রতিষ্ঠান ও জমির মালিকরা বাড়ি নির্মাণ করছেন না। সে কারণে অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা বাড়লেও জোগান কম, দামও বাড়তি।
বারবার ড্যাপ সংশোধন কার স্বার্থে
বারবার ড্যাপ সংশোধন ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। এ কারণে বাসযোগ্যতার সংকট বাড়বে বলে মনে করছেন পরিকল্পনাবিদরা।
এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আবাসন ব্যবসায়ী ও কিছুসংখ্যক পেশাজীবী ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত, সংশোধন চায়। তাদের লক্ষ্য শুধু ভবন নির্মাণে বেশি ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (এফএআর) মান বাড়ানো। ফলে ড্যাপে প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতাকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে বলে আমি মনে করি। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে দেশের সব অঞ্চলের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কেবল বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকার আবাসন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা বলেন, একটি শহরের ধারণক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনার সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের কেবল মুনাফা লাভের চিন্তা, শহরের উন্নয়ন নয়।
আইপিডির পক্ষ থেকে বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বড় শহরের জনঘনত্ব সাধারণত একরপ্রতি ১০০-১০০ জন বা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫-৩০ হাজার হয়। এই জনঘনত্বও শহরের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু নগর এলাকায় থাকে, যা শহরের প্রান্তের দিকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। চূড়ান্ত ড্যাপে ঢাকার অপরিকল্পিত এলাকা জিনজিরার জনঘনত্ব কাঠাপ্রতি পরিবার সংখ্যা ১.২ বা একরপ্রতি ১৫০ দেওয়া থাকলেও ১৮ নভেম্বর রাজউক প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ১৫০ শতাংশ বেড়ে কাঠাপ্রতি পরিবার সংখ্যা ৩.০ বা একরপ্রতি প্রায় ৩৫০ জন প্রস্তাব করা হয়েছে। এই এলাকার আগে প্রস্তাবিত এফএআর মান ১.৩ থেকে ১৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩.৩। একইসঙ্গে ওয়েবসাইটে আপলোড করা প্লটভিত্তিক ফার সূচকে এ থ্রি (ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি) ক্যাটাগরির ফার মানসমূহ যেভাবে অপরিপক্কভাবে কেটে দিয়ে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক।
ব্লক ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক ফার বোনাস সাধারণত ১৫-২০ শতাংশ হয়ে থাকে। অথচ রাজউক এলাকাভিত্তিক ফার মানের তুলনায় ব্লকভিত্তিক ফারমান ৯০-১২০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রস্তাব করেছে, যা বৈশ্বিক পরিকল্পনা কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এভাবেই অনেক এলাকার ফার মান অযাচিতভাবে বেড়েছে। ফলে এসব এলাকার বাসযোগ্যতা আরও সংকটে পড়বে বলে মনে করে আইপিডি।
এদিকে, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) সংশোধনী প্রস্তাবনার বিষয়ে জনসাধারণের মতামত নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) মো. কামরুজ্জামান বলেন, গেজেটকৃত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (২০২২-৩৫) কিছু সংশোধনী ও সংযোজন গেজেট আকারে প্রকাশের পূর্বে জনসাধারণের মতামত গ্রহণের জন্য সংশোধনী খসড়া রাজউকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে। জনস্বার্থ বিবেচনায় ড্যাপ নিয়ে পদক্ষেপ নেবে রাজউক।
এএসএস/